বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে যুক্ত। খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গ্রামীণ জীবনের টেকসই অগ্রগতির জন্য উর্বর মাটি অপরিহার্য। কিন্তু অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, একফসলী চাষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটির উর্বরতা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। তাই মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা আজ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নিচে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
Table of Contents
বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা
১. মাটির স্বাস্থ্য বলতে কী বোঝায়
মাটির স্বাস্থ্য বলতে বোঝায়—মাটির এমন একটি সক্ষম অবস্থা, যেখানে এটি ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ও মানবজীবনের সহায়ক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে অব্যাহত রাখে। একটি সুস্থ মাটির বৈশিষ্ট্য হলো—
- পর্যাপ্ত জৈব পদার্থের উপস্থিতি
- সুষম পুষ্টি উপাদান
- ভালো পানি ধারণ ক্ষমতা
- জীবাণু, কেঁচোসহ মাটির জীববৈচিত্র্য
- দূষণমুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ গঠন
২. বাংলাদেশের মাটির বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে প্রতি বছর কৃষিজমির উপর চাপ বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যায়—
- প্রায় ৬০% কৃষিজমির জৈব পদার্থের পরিমাণ ১.৭% এর নিচে, যা অত্যন্ত কম।
- রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মাটির স্বাভাবিক পিএইচ স্তর নষ্ট হচ্ছে।
- একফসলী চাষ ও জমির অবিরাম ব্যবহার মাটিকে ক্লান্ত করে তুলছে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা (বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে) এবং মরুকরণ (উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে) বাড়ছে।
ফলস্বরূপ ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
৩. মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার কারণসমূহ
১. অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার – জৈব উপাদানের ঘাটতি তৈরি হয়, মাটির জীবাণু ধ্বংস হয়।
২. একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ – পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হয়।
৩. অপ্রতুল জৈবসার ব্যবহার – গোবর, কম্পোস্ট বা সবুজ সার কম ব্যবহারের কারণে মাটির জৈব উপাদান হ্রাস পাচ্ছে।
৪. সেচের অতিরিক্ত চাপ – ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ হচ্ছে এবং মাটির প্রাকৃতিক গুণাবলি নষ্ট হচ্ছে।
৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন – ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার প্রভাবে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
৪. মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই কয়েকটি কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে—
- সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (SRDI) এর মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য কার্ড সরবরাহ।
- কৃষকদের জন্য সুষম সার ব্যবহারের পরামর্শ।
- জৈবসার ব্যবহার উৎসাহিত করতে ভর্তুকি।
- লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন।
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ।
৫. মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয়
ক) জৈব উপাদান বৃদ্ধি
- প্রতি মৌসুমে কম্পোস্ট, গোবর, সবুজ সার প্রয়োগ।
- ফসলের অবশিষ্টাংশ মাঠে রেখে জৈবপদার্থ হিসেবে ব্যবহার।
- কৃষিতে বায়োগ্যাস স্লারি ও ভার্মি কম্পোস্টের ব্যবহার।
খ) সুষম সার ব্যবহার
- ইউরিয়া কমিয়ে পটাশ, ফসফরাস, সালফারসহ অন্যান্য সার নির্ধারিত পরিমাণে প্রয়োগ।
- মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভিত্তিতে সার প্রয়োগ করা।
গ) ফসলের বহুমুখীকরণ
- একফসলী চাষ পরিহার করে ডাল, তেলবীজ, সবজি ও শস্য পর্যায়ক্রমে চাষ।
- শস্য পর্যায় অনুসরণ করলে মাটির পুষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে।
ঘ) জৈব কীটনাশকের ব্যবহার
- নিম তেল, জৈব কীটনাশক, ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার।
- রাসায়নিক কীটনাশকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এড়ানো।
ঙ) সংরক্ষণমূলক কৃষি (Conservation Agriculture)
- জমিতে ন্যূনতম চাষাবাদ (minimum tillage)।
- মাটিকে আচ্ছাদিত রাখা (cover crops)।
- শস্য পর্যায় ও ফসলের বহুমুখীকরণ।
চ) পানি ব্যবস্থাপনা
- অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার কমিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ।
- আধুনিক সেচ পদ্ধতি (ড্রিপ ইরিগেশন, স্প্রিঙ্কলার) ব্যবহার।
ছ) কৃষক সচেতনতা বৃদ্ধি
- মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ।
- বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাটি সংরক্ষণ বিষয়ক শিক্ষা।
- মিডিয়ার মাধ্যমে কৃষি সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।
৬. মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
১. মাটির স্বাস্থ্য কার্ড (Soil Health Card) – প্রতিটি কৃষক জমির মাটির ধরন ও পুষ্টি জেনে সার ব্যবহার করতে পারে।
২. GIS ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি – কোথায় কী ধরনের মাটির সমস্যা হচ্ছে তা সনাক্ত করা যায়।
৩. ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা – মোবাইল ও অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা সঠিক পরামর্শ পান।
৪. বায়ো–ফার্টিলাইজার ও মাইক্রোবিয়াল ইনোকুল্যান্টস – মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক।
৭. জলবায়ু পরিবর্তন ও মাটির স্বাস্থ্য
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি মাটির উপর পড়ছে।
- দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরুকরণ তীব্র হচ্ছে।
- ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় উর্বর টপসয়েল হারিয়ে যাচ্ছে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী, পানি সংরক্ষণ, লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের চাষ অপরিহার্য।
৮. টেকসই কৃষির জন্য ভবিষ্যৎ করণীয়
- জাতীয় মাটি সংরক্ষণ নীতি আরও শক্তিশালী করা।
- কৃষক পর্যায়ে জৈব কৃষি চর্চা বাড়ানো।
- কৃষি গবেষণা ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করা।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাটি স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা।
- এনজিও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা।
বাংলাদেশের কৃষি টেকসই করতে হলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা অপরিহার্য। এটি শুধু খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নীতি, প্রযুক্তি, গবেষণা ও কৃষকের সচেতনতা একত্রে কাজ করলে বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা আবারও ফিরে আসবে এবং দেশ একটি নিরাপদ খাদ্যশস্য ভাণ্ডার হিসেবে সমৃদ্ধ থাকবে।