বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উর্বর মাটি, সঠিক বীজ এবং পর্যাপ্ত পানি যেমন জরুরি, তেমনি সমানভাবে প্রয়োজন সময়োপযোগী সার প্রয়োগ। কৃষকেরা যেন সঠিক সময়ে সঠিক ফসলের জন্য সঠিক সার ব্যবহার করতে পারেন, সেজন্য তৈরি করা হয়েছে সার ক্যালেন্ডার। এটি মূলত একটি নির্দেশিকা—যেখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে কোন ফসলে কোন ধরনের সার প্রয়োগ করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে।
Table of Contents
বাংলাদেশের সার ক্যালেন্ডার
সার ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা
- ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি: সঠিক সময়ে সঠিক সার প্রয়োগ ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ায়।
- মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা: এলোমেলো সার ব্যবহারে মাটির জৈব গুণ নষ্ট হয়, সার ক্যালেন্ডার মাটির ভারসাম্য রক্ষা করে।
- অর্থনৈতিক সাশ্রয়: কৃষকেরা অতিরিক্ত সার কিনতে বাধ্য হন না; সঠিক পরিমাণ ব্যবহার করে খরচ কমানো যায়।
- পরিবেশ সংরক্ষণ: অযথা সার প্রয়োগে জলাশয় দূষিত হয়, যা ক্যালেন্ডারভিত্তিক সঠিক প্রয়োগে রোধ করা যায়।
বাংলাদেশের কৃষিতে ব্যবহৃত প্রধান সারসমূহ
বাংলাদেশে সাধারণত দুটি ভাগে সারের ব্যবহার হয়—রাসায়নিক ও জৈব।
- রাসায়নিক সার
- ইউরিয়া (N)
- টিএসপি (ফসফরাস)
- এমওপি (পটাশ)
- জিপসাম (সালফার)
- দস্তা (Zn)
- বোরন (B)
- জৈব সার
- গোবর
- কম্পোস্ট
- ভার্মি কম্পোস্ট
- সবুজ সার
সার ক্যালেন্ডারের মূল কাঠামো
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) যৌথভাবে সার ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে। এতে মৌসুমি ফসলভিত্তিক সারের ধরণ, প্রয়োগের সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
১. আমন ধান (জুলাই–ডিসেম্বর)
- জমি প্রস্তুতের সময়: টিএসপি, এমওপি, জিপসাম
- চারা রোপণের ১৫ দিন পর: ইউরিয়ার প্রথম কিস্তি
- কুশি বের হওয়ার সময়: ইউরিয়ার দ্বিতীয় কিস্তি
- ফুল আসার সময়: ইউরিয়ার শেষ কিস্তি
২. বোরো ধান (ডিসেম্বর–মে)
- জমি তৈরির সময়: টিএসপি, এমওপি, দস্তা
- রোপণের ২০–২৫ দিন পর: ইউরিয়া
- কুশি পর্যায়ে: ইউরিয়া + এমওপি
- ফুল আসার সময়: ইউরিয়ার শেষ কিস্তি
৩. গম (নভেম্বর–মার্চ)
- জমি তৈরির সময়: টিএসপি + এমওপি + জিপসাম
- বপনের ২০–২৫ দিন পর: ইউরিয়া
- শীষ গঠনের সময়: ইউরিয়া
৪. ভুট্টা (অক্টোবর–মার্চ)
- বপনের আগে: টিএসপি + এমওপি + জিপসাম + দস্তা
- বপনের ২৫ দিন পর: ইউরিয়া
- ৪০–৪৫ দিন পর: ইউরিয়া + এমওপি
- শীষ আসার সময়: ইউরিয়া
৫. ডাল ফসল (মসুর, মুগ, মাষকলাই)
- বপনের সময়: টিএসপি + এমওপি + জিপসাম
- ফুলের আগে: অল্প ইউরিয়া প্রয়োগ
৬. তৈলবীজ (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী)
- বপনের আগে: টিএসপি + এমওপি + বোরন
- ২৫–৩০ দিন পর: ইউরিয়া
- ফুল ফোটার আগে: ইউরিয়ার শেষ কিস্তি
৭. আলু (অক্টোবর–ফেব্রুয়ারি)
- জমি তৈরির সময়: টিএসপি + এমওপি + জিপসাম + দস্তা + গোবর
- রোপণের ২০ দিন পর: ইউরিয়া
- কন্দ গঠনের সময়: ইউরিয়া + এমওপি
৮. সবজি (বেগুন, টমেটো, মরিচ, বাঁধাকপি ইত্যাদি)
- জমি তৈরির সময়: জৈব সার + টিএসপি + এমওপি + বোরন
- ২০ দিন পর: ইউরিয়া
- ফুল আসার সময়: ইউরিয়া + এমওপি
৯. ফল ফসল (আম, লিচু, কলা, পেঁপে)
- বর্ষার আগে ও পরে বছরে দু’বার সার প্রয়োগ
- জৈব সার আবশ্যক, সঙ্গে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি
সারের সঠিক প্রয়োগের ধাপ
- জমি প্রস্তুতকালে: জৈব সার ও প্রাথমিক টিএসপি, এমওপি প্রয়োগ।
- চারা বা বপনের পর: পর্যায়ক্রমে ইউরিয়ার কিস্তি ভাগ করে প্রয়োগ।
- ফুল বা কন্দ গঠনকালে: অতিরিক্ত পুষ্টির জন্য ইউরিয়া ও পটাশ দেওয়া জরুরি।
সারের ভুল প্রয়োগে সমস্যা
- অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করলে গাছ সবুজ হয় কিন্তু ফলন কমে।
- টিএসপি কম হলে গাছ দুর্বল ও রোগপ্রবণ হয়।
- এমওপি না দিলে গাছের শক্তি কমে ও ফলের গুণমান খারাপ হয়।
- মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (দস্তা, বোরন) না দিলে ফলন অনেক কমে যায়।
সার ক্যালেন্ডারের সফলতা
- ধান, গম ও আলুর উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে।
- কৃষকেরা সারের খরচ ১৫–২০% পর্যন্ত কমাতে পেরেছেন।
- পরিবেশ দূষণ হ্রাস পেয়েছে।
- কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
- অনেক কৃষক এখনো সার ক্যালেন্ডার সম্পর্কে অবগত নন।
- বাজারে নকল ও ভেজাল সার পাওয়া যায়।
- সার সরবরাহে অনিয়ম ও দেরি হয়।
করণীয়:
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে প্রচার বাড়াতে হবে।
- কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
- সারের গুণগত মান কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
- ডিজিটাল অ্যাপ/এসএমএসের মাধ্যমে সার ক্যালেন্ডার পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় সার ক্যালেন্ডার এক অনন্য উদ্ভাবন। এটি শুধু উৎপাদন বাড়াচ্ছে না, মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করছে। তবে এর সুফল পেতে হলে কৃষক পর্যায়ে কার্যকর প্রচার, সঠিক সার সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, আর সার ক্যালেন্ডার হলো সেই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী রাখার অন্যতম হাতিয়ার।