বাছুর পালন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাছুর পালন – যা কৃষিজ উৎপাদন: গৃহপালিত পশুপাখি পালন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত। বাছুর হলো গরু-মহিষের শৈশবকাল। অর্থাৎ জন্মের পর থেকে এক বছরের বেশি বয়সের গরু-মহিষের বাচ্চাই সচরাচর বাছুর নামে পরিচিত। মাংস উৎপাদন বা দুগ্ধ খামারের ভবিষ্যত নির্ভর করে বাছুরের সন্তোষজনক বৃদ্ধির ওপর । কারণ আজকের বাছুরই ভবিষ্যতের মাংস উৎপাদনকারী পরু, উন্নতমানের প্রজনন উপযোগী ষাঁড় বা দুধ উৎপাদনশীল গাভী।

বাছুর পালন

 

বাছুর পালন

 

এদেশে পালিত গবাদিপশুর প্রায় এক-চতুর্থাংশই (২৫%) বাচ্চুর। এরা অত্যন্ত রোগ সংবেদনশীল হয়। তাই সুস্থ- সবল বাচ্চুর পেতে হলে একদিকে যেমন গর্ভাবস্থায় গাভীর পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য ও যত্ন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন প্রসবকালীন ও জন্মের পর নবজাতক বাছুরের সঠিক পরিচর্যা।

 

বাছুরের বাসের স্থান

বাছুরের জন্মকালীন গড় ওজন জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে, যেমন:- দেশী ও উন্নত জাতের বাছুরের ওজন যথাক্রমে ১৫- ২০ কেজি হয়। অবশ্য উন্নত ও সংকর জাতের বাছুরের জন্মকালীন ওজন প্রায় ২৫-৩০ কেজি হতে পারে। মূলত বাছুরের আকারের ওপর নির্ভর করে এর বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ । বাছুরের ঘর নির্মাণে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। যথা:-

  • প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধা রয়েছে এমন জায়গায় বাছুরের ঘর তৈরি করতে হবে।
  • ঘরে প্রতিটি বড় আকারের বাছুরের জন্য ৩.২৪ বর্গ মিটার ও ছোট আকারের বাছুরের জন্য ১.১১ বর্গ মিটার জায়গা বা খোপের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • বাছুরের বাসস্থান কাঁচা বা পাকা যাই হোক না কেন এতে মলমূত্র নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
  • মেঝে পাকা না হলে তা যেন কর্দমাক্ত ও স্যাঁতসেঁতে না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে ।
  • বাছুরের খোপে খড়-বিচালি দিয়ে বিছানা তৈরি করতে হবে।

 

বাছুরের নিয়মিত পরিচর্যা

বাছুরের পরিচর্যা বলতে এদেরকে সময়মতো ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাদ্য পরিবেশন, কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান, রোগবালাইয়ের চিকিৎসা করা ও অন্যান্য যত্ন-আত্তি করাকে বোঝায়।

যদিও গবাদিপশু বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী বাছর ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে দৈহিক পরিপক্কতা অর্জন করে সাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত এদেরকে পরিচর্যা করতে: হয়, কিন্তু এদেশে এটি তেমনভাবে মানা হয় না। তবে ভবিষ্যতে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়ার জন্য বাছুরের সুষ্ঠু পরিচর্যা দরকার। এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে বাছুরের পরিচর্যার কলাকৌশল নিম্নে বর্ণিত হলো:-

  • বাছুরকে শালদুধ পান করানো: নবজাতক বাছুরকে জন্মের এক ঘন্টা পর থেকে ৩-৪ দিন পর্যন্ত মায়ের বাট থেকে নিঃসৃত গাঢ় বা হালকা হলদে রঙের শালদুধ বা কাচলা দুধ (colostrum) পান করাতে হবে। শালদুধে বাছুরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি (antibody) থাকে। এছাড়াও শালদুধে প্রচুর পরিমাণে শর্করা, আমিষ ও ভিটামিন-এ থাকে। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই অজ্ঞতার জন্য এ শালদুধ বাচ্চুরকে খেতে দেয় না, দোহন করে ফেলে দেয়। এটা কখনোই করা উচিত নয়।
  • বাছুরকে গাভীর দুধ পান করা শেখানো: জন্মের পরই কিন্তু বাহুর স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাভীর বাট চুষে দুধ পান করতে পারে না বা জানে না । বাছুরকে তাই বাট মুখে পুরে দুধ চুষে পান করতে শেখাতে হয় । খামার পর্যায়ে বাছুর চিহ্নিতকরণ বা ট্যাগ নম্বর লাগানো পারিবারিক খামারে বাছুর চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন না হলেও খামারে পালিত বাছুরের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে বাছুরের সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণে সুবিধা হয় এবং খামার ব্যবস্থাপনাও সহজ হয়ে যায়।
  • পরিমিত খাদ্য পরিবেশন: বাছুর পালনে দৈনিক পরিমিত খাদ্য পরিবেশনের কোন বিকল্প নেই। বর্ধিষ্ণু বাছুরের
    চাহিদা অনুযায়ী জন্মের পর থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত খাদ্যতালিকা অনুযায়ী নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে
    হবে।
  • মলমূত্র নিষ্কাশন ও বিছানা পরিষ্কার করা: স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালনের জন্য বাছুরের শোয়ার ঘর ও রক্ষনাবেক্ষণের ঘরটিতে মলমূত্র নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা মলমূত্র থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় ও বাছুর কৃমিসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। বাছুরের খোপে বিছানা হিসেবে যে খড় দেয়া হয় তাও মাঝেমধ্যে পরিষ্কার করে শুকনো রাখতে হবে।
  • সময়মতো বাছুর খোপে ওঠানো ও নামানো: বাছুরকে নিয়মিত খোপে ওঠানামা করাতে হয়। এদেরকে যেমন সারাদিন খোপে আবদ্ধ করে রাখা ঠিক নয়, তেমনি দিনভর খোলা জায়গায় বিচরণ করতে দেয়াও উচিত নয়। এটা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা নির্বিশেষে সব মৌসুমে করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত শীতে বা বৃষ্টিতে ভিজলে বাচ্চুর নিউমোনিয়া বা ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হতে পারে।
  •  বাছুরের প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষণ : প্রাতাহিক পর্যবেক্ষণ বাচ্চুর পরিচর্যার অন্যতম করণীয় কাজ। তাছাড়া মাঝে মাঝে এদের দৈহিক বৃদ্ধি বা অবণতির পরিমাপ করতে হবে। জন্মের দিন থেকে দৈনিক ওজন মাপা হলে এদের দৈনিক বৃদ্ধির হার সহজেই বোঝা যাবে। পারিবারিকভাবে না হলেও খামারভিত্তিতে এটি পালন করতে হবে ।
  • রোগপ্রতিরোধ ও রোগচিকিৎসা: বাছুরকে নিয়মিত টিকাদান করতে হবে ও কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। বাছুর রোগাক্রান্ত হলে দ্রুত ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, সুস্থ্য-সবল গাভী থেকেই সঠিক উৎপাদন পাওয়া যাবে।

 

বাছুরের খাদ্য

উন্নত বিশ্বে জন্মের পরপরই বাছুরকে যা থেকে আলাদা করে নিয়ে পালন করা হয়। অন্যদিকে, এদেশে পারিবারিক বা খামার উভয় পদ্ধতিতেই বাচ্চুরকে মায়ের সঙ্গে রেখে অন্তত ৬ মাস পালন করা হয়।

এ সময় বাচ্চুর মূলত মায়ের দুধ পান করে বড় হয়। তবে যেভাবেই পালন করা হোক না কেন লক্ষ্য রাখতে হবে এরা যেন খাদ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টি পায়। তা না হলে পরবর্তীতে এদের থেকে কাঙ্খিত মাংস বা দুধ উৎপাদন পাওয়া যাবে না। সারণি ১৫-এ বাছুরের জন্য দু’টি খাদ্য মিশ্রণ দেখানো হয়েছে। এছাড়াও সারণি ১৬-এ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাছুরকে কি পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে তা দেখানো হয়েছে।

সারণি ১৫: বাছুরের জন্য দানাদার খাদ্য মিশ্রণ

 

বাছুর পালন

 

সারণি ১৬: বয়স বাড়ার সঙ্গে বাছুরের খাদ্য পরিবেশন

 

বাছুর পালন

 

বাছুর পালন

 

এই পাঠের সারসংক্ষেপ:

বাঙুর হলো গরু-মহিষের শৈশবকাল। মাংস উৎপাদন বা দুগ্ধ খামারের ভবিষ্যত নির্ভর করে বাছুরের সন্তোষজনক বৃদ্ধির ওপর। মূলত বাস্তুরের আকারের ওপর নির্ভর করে এর বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ। তাই বাসস্থানে বাছুরের আকার অনুযায়ী বছরপ্রতি ১.১১-৩.২৪ বর্গ মিটার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।

বাছুরের পরিচর্যা বলতে এদেরকে সময়মতো ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাদ্য পরিবেশন, কৃমিনাশক ও টিকা প্রদান, রোগবালাইয়ের চিকিৎসা করা ও অন্যান্য যত্ন-আত্তি করাকে বোঝায়। বাছুরকে আলাদাভাবে বা মায়ের সঙ্গে রেখে যেভাবেই পালন করা হোক না কেন লক্ষ্য রাখতে হবে এঁরা যেন খাদ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টি পায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেরকে সঠিক নিয়মে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য পরিবেশন করতে হবে।

 

Leave a Comment