আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বিরূপ আবহাওয়া সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত – যা কৃষি ও জলবায়ু এর অন্তর্ভুক্ত ।
Table of Contents
বিরূপ আবহাওয়া সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করে। শীতকালে অতি শৈত্য বা কম শৈত্য পড়া, গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা, খরা, লবণাক্ততা, বন্যা বা জলাবদ্ধতা হলো বাংলাদেশের ফসল উৎপাদনে প্রতিকূল পরিবেশ ও বিরূপ আবহাওয়া। পূর্বপ্রস্তুতি ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকলে এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ বা বিরূপ আবহাওয়ায় ফসলের ফলন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
বিরূপ আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশে ফসল উৎপাদনের পূর্ব শর্ত হলো উপযোগী ফসল বা ফসলের-জাত নির্বাচন। বিভিন্ন ধরনের বিরূপ আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশ-সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের-জাত রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু ফসলের প্রতিকূল পরিবেশ-সহিষ্ণু নতুন জাত বের করেছেন এবং আরও জাত বের করার জন্য পবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এখন বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল আবহাওয়া-সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের-জাত নিয়ে আলোচনা করব।
শৈত্য সহিষ্ণু ফসল
বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীতকাল। শীতকালে দেশের চরম সর্বনিম্ন তাপমাত্রা জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে হয়ে থাকে। শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে শৈত্য বেশি পড়লে এবং শৈত্যতা দীর্ঘস্থায়ী হলে শীতকালীন ফসল, যেমন- গোলআলু ও গমের ফলন ভালো হয়। তবে রোপা আমন ও বোরো ধানের পরাগায়ণ ও দানা গঠনের সময় শৈত্য বেশি পড়লে অর্থাৎ তাপমাত্রা কমে গেলে চিটা হয়ে ফলন কমে যায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের ঠাণ্ডাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান ৩৬ জাতটি বের করে।
বীজ বপনের সময় যে সব এলাকায় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি খুবই উপযোগী। ব্রি ধান ৫৫ জাতটি মাঝারি শৈত্য সহ্য করতে পারে বলে দেশের শৈত্য প্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়।
খরা সহিষ্ণু ফসল
অনাবৃষ্টি বা বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার কারণে জমিতে মৃত্তিকা পানির ঘাটতি দেখা যায়। ফলে উদ্ভিদ দেহে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি দেখা দেয় এ অবস্থাকে খরা কবলিত বলা হয়। প্রতি বছর দেশে রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে ৩০-৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় খরার সম্মুখীন হয়। সাধারণত খরা সহিষ্ণু ফসলের মূল খুব দৃঢ় ও শাখা-প্রশাখাযুক্ত এবং গভীরমূলী হয়। এ সব ফসলের পাতা ছোট, সরু, পুরু বা পেঁচানো হয়ে থাকে ।
খেজুর, কুল, অড়হর, তরমুজ, অনেক জাতের গম ইত্যাদি খরা সহিষ্ণু ফসল। ব্রি ধান ৫৬ ও বিধান ৫৭ দুইটি খরা সহিষ্ণু ধানের জাত। এর মধ্যে ব্রি ধান ৫৭ প্রজনন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৮-১৪ দিন বৃষ্টি না হলেও ফলনের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।
খরা কবলিত অবস্থায় জাতটি হেক্টর প্রতি ৩.০-৩.৫ টন ফলন দিতে সক্ষম। ব্রি ধান৫৬ ও ব্রি ধান ৫৭ এর জীবনকাল কম বলে এরা খরা সহ্যের পাশাপাশি খরা এড়াতেও পারে বারি গম ২০ (গৈৱব) ও বারি গম ২৪ (প্রদীপ) দুইটি খরা সহিষ্ণু গমের জাত। ঈশ্বরদী ৩৩ ও ঈশ্বরদী ৩৫ খরা সহিষ্ণু আখের জাত।
লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল
লবণাক্ত মাটি থেকে ফসলের পানি সংগ্রহ করতে অসুবিধা হয়। লবণাক্ততার মাত্রা বেশি হলে ফসল জন্মাতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের-জাতের আবাদ এলাকা বাড়াতে হবে। উপকূলীয় লবণাক্ততা এলাকায় ধান প্রধান ফসল। ধানের কিছু স্থানীয় ও উন্নত জাত রয়েছে যারা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
স্থানীয় জাতের মধ্যে রয়েছে-যাতা, রাজাশাইল, কাজলশাইল, বাজাইল, কালামানিক, গরচা, গাবুরা ইত্যাদি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে বেশ কিছু লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের ধান বের করেছে। যেমন-ব্রি ধান ৪০, ব্রি ধান 83. ধান-৪৭, ব্রি ধান ৫৩, ব্রি ধান ৫৪ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে লবণাক্ততা সহিষ্ণুজাতের আলু (বারি আলু ২২) বের হয়।
এ জাতের আলুর আকার লম্বাটে গোল এবং লাল রঙের। জাতটির ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর। বারি সরিষা-১০ জাতটি লবণাক্ততার পাশাপাশি ঘরাও সহ্য করতে পারে। এ জাতের সরিষার গাছ খাটো, উচ্চতা ৮০-১০০ সেমি, জীবনকাল ৮৫-৯০ দিন এবং ফলন ১.২-১.৪ টন/হেক্টর।
বন্যা বা জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ফসল
বাংলাদেশে প্রতিবছর কম-বেশি বলা হয়ে থাকে। বন্যাজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা ছাড়াও দেশের কিছু অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে যেমন-খুলনা ও যশোর জেলার ভবদহ এলাকা। বন্যার কারনে বা অন্য কোনো কারনে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা, জলজ উদ্ভিদ ছাড়া বেশিরভাগ উদ্ভিদ সহ্য করতে পারে না। দেশের বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ এলাকার প্রধান ফসল ধান । বন্যা সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের গভীর পানির আমন ধানের মধ্যে রয়েছে- বাজাইল ও ফুলকড়ি।
বন্যার পানির উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে এ সব জাতের ধান গাছের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। এমনকি দিনে ২৫ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং ৪ মিটার গভীরতায়ও বেঁচে থাকতে পারে। উঁচু জাতের আমন ধানের মধ্যে আছে ব্রি ধান ৪৪। এ জাতের ধান জোয়ার- ভাটা অঞ্চলে ৫০ সেমি উচ্চতার প্লাবন সহ্য করতে পারে। বন্যাপ্রবণ এলাকার বন্যার পানি নেমে গেলে নাবী জাতের আমন ধান চাষ করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। নাবী জাতের মধ্যে রয়েছে বিআর ২২ (কিরণ) ও বিজার ২৩ (দিশারী)।
কিরণ ও দিশারী জাত দুটো দেশের বন্যা প্রবণ এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে ১৫ আশ্বিন পর্যন্ত রোপণ করা যায়। জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে ৪০-৫০ দিনের চারাও রোপণ করা যায়। ফলে উঁচু জোয়ার থেকে ফসল বাঁচে (আমন মৌসুমে এ এলাকার চাষাবাদের জন্য বের হওয়া জাত দুটি হলো-ব্রি ধান৫১ ব্রি ধান ৫২। ঈশ্বরদী ৩২ জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু আখের জাত। বন্যা বা জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু এ জাতটির ফলন হেক্টর প্রতি ১০৪ টন ।
সারসংক্ষেপ
দেশের খাদ্যভান্ডারে মজুদ বর্ধন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের শুধু মাত্র মৌসুম ভিত্তিক ফসল কিংবা অনুকূল পরিবেশে ফসল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নিচে বসে থাকলে চলবেনা। আগামীর সুনিশ্চিত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে একদিকে যেমন লবণাক্ত জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে, তেমনি বৈরি আবহাওয়াকে মোবাবেলার করার জন্যও শৈত্য সহিষ্ণু কিংবা খরা সহিষ্ণু নতুন ফসলের-জাতের উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
আশার কথা আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু বৈরি আবহাওয়া উপযোগী ফসল কৃষকের মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । অদূর ভবিষ্যতে এ প্রচেষ্টা এক নতুন কৃষি বিপ্লবের সূচনা করবে ।