প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়ায় ফসল ও পশুপাখি রক্ষার কৌশল নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ৬ নং ইউনিটের “কৃষি জলবায়ু” ৬.৫ নং পাঠ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য শারীরব তীয় ও জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের দ্বারা খাপ খাইয়ে নেয়। ফসল উৎপাদন সময়ে যদি আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ফসলের ক্ষতি হয় তখন তাকে আমরা বলি প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়া।
Table of Contents
প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়ায় ফসল ও পশুপাখি রক্ষার কৌশল
প্রতিকূল বা বিরূপ জলবায়ুর সময়কাল খুব কম। কিন্তু এ স্বল্পকালীন অবস্থায় ফসলের মারাত্নক ক্ষতি হতে পারে। ফসল সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জলাবদ্ধতা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, খরা, অত্যাধিক গরম, প্রচন্ড ঠান্ডা ইত্যাদি প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়ার উদাহরণ।
বাংলাদেশে প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়া এবং সে আবহাওয়ায় ফসল রক্ষার কৌশল নিচে আলোচনা করা হল :
বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ফসল রক্ষার কৌশল :
১. অতিবৃষ্টি :
বাংলাদেশে জুন থেকে অক্টোবর মাসে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ সময়ে কখনো কখনো একটানা কয়েকদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে একে অতিবৃষ্টি বলে। অনেক ফসলের গাছের গোড়া নেতিয়ে বা হেলে পড়ে। এক্ষেত্রে গাছের চারার গোড়ায় মাটি দিয়ে সোজা করে বাঁশের খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। এ সময় শাক সবজির মাঠ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. অনাবৃষ্টি :
যদি শুষ্ক মৌসুমে একটানা ১৫ দিন বা এর বেশীদিন বৃষ্টি না হয় তখন আমরা তাকে অনাবৃষ্টি বলি। অনাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য আমরা সেচ দিয়ে থাকি। বৃষ্টি নির্ভর আমন ধান চাষের ক্ষেত্রে যদি অনাবৃষ্টি দেখা দেয় তবে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। জমিতে নিড়ানি দিতে হবে। শীতকালীন সবজি ক্ষেতে জাবড়া প্রয়োগ করে পানি সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. শিলাবৃষ্টি :
বাংলদেশে সাধারণত মার্চ এপ্রিল মাসে শিলাবৃষ্টি হয়। শিলাবৃষ্টির কারণে বিশেষ করে রবি ফসল, যেমন: পেঁয়াজ, রসুন, গম, আলু ইত্যাদি নষ্ট হয়। শিলার আকার ও পরিমাণের ওপর ক্ষতি নির্ভর করে। ক্ষতি বেশি হলে এসব ফসল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে ফেলতে হবে। কিছু ফসল বাড়ন্ত অবস্থায় শিলার আঘাতে ডালপালা ভেঙে নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে ভাঙা ডালপালা ছাটাই করে সার ও সেচ দিয়ে যত্ন নিলে ফসলকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
৪. জলাবদ্ধতা :
অতিবৃষ্টি বা বন্যার কারণে কোনো স্থান জলাবদ্ধ হয়ে পড়াকে জলাবদ্ধতা বলে। পাহাড়ি ঢলের কারণে জলাবদ্ধতায় হাওর অঞ্চলে বোরো ধান পাকার সময় তলিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় জমি থেকে ধানের শীষ কেটে ফসল সংগ্রহ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিষ্কাশন নালা কেটে জলাবদ্ধ জমি থেকে পানি বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
খরা অবস্থায় ফসল রক্ষার কৌশল:
খরা বাংলদেশের একটি অতি পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতিবছরই শুকনো মৌসুমে খরা কবলিত হয়। বৃষ্টির অভাবে জনজীবনে অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করে। খাল—বিল, ডোবা—নালা, নদ—নদী শুকিয়ে যায় বা পানির পরিমাণ খুবই হ্রাস পায়। খরার কারণে প্রতি বছরই ব্যাপক শস্যহানি ঘটে। মাঠ—ঘাট ফেটে চৌচির হয়। ফসল ফলে না, ঘাসও শুকিয়ে যায়। খরা কবলিত অঞ্চলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল চাষ করলে বা লাভজনকভাবে ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিচে আলোচনা করা হল :
১. উপযুক্ত ফসল বা ফসলের জাত ব্যবহার :
খরা শুরু হওয়ার আগেই ফসল তোলা যাবে এমন স্বল্পায়ু জাতের অথবা খরা সহ্য করতে পারে এমন জাতের চাষ করতে হবে। যেমন: আমন মৌসুমে বিনা ধান ৭, ব্রি ধান ৩৩ এক মাস আগে পাকে। ফলে সেপ্টম্বর—অক্টোবর মাসের খরা থেকে ফসল রক্ষা করা যায়। বিজয়, প্রদীপ গমের দুটি খরা সহনশীল জাত।
২. মাটির ছিদ্র নষ্টকরণ :
খরা কবলিত এলাকায় বৃষ্টির মৌসুম শেষ হওয়ার পর মাটিতে অগভীর চাষ দিয়ে রাখতে হবে। এতে করে মাটির উপরিভাগের সুক্ষ্ম ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
৩. অগভীর চাষ :
অগভীর চাষ দিয়ে মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করতে হবে। প্রতি চাষের পর মই দিয়ে মাটিকে আঁাটসাট অবস্থায় রাখতে হবে। এতে মাটিতে পানির অভাব পূরণ হবে।
৪. জাবড়া প্রয়োগ :
শুকনো খড় লতাপাতা, কচুরিপানা দিয়ে বীজ বা চারা রোপনের পর মাটি দ্বারা ঢেকে দিলে আর্দ্রতা সংরক্ষিত থাকে। এর ফলে সূর্যের তাপে পানি বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। অনেক দেশে কালো পলিথিন শিটও ব্যবহার করা হয়। এতে আগাছার উপদ্রবও কম হয়।
৫. পানি ধরা :
যে অঞ্চলে বৃষ্টি খুব কম হয়, সে অঞ্চলে বৃষ্টির মৌসুমে জমির বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট নালা বা গর্ত তৈরি করে রাখা হয়। এর ফলে পানি গড়িয়ে জমি থেকে বাইরে চলে যায় না। মাটি কতৃর্ক সম্পূর্ণ পানি শোষিত হয়।
প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়ায় পশু—পাখি রক্ষার কৌশল বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুযোর্গ দেখা দেয়।
এসব প্রাকৃতিক দুযোর্গের ফলে ব্যাপক সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি ব্যতিতও মানুষ ও পশু পাখির জীবন বিপন্ন হয়। এসব দুযোর্গের প্রতিক্রিয়া হয় সুদূর প্রসরী। গবাদি পশু এসব দুযোর্গের সময় ও পরবতীর্তে খাদ্যভাবে ভোগে ও নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। খরা, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক পশুপাখির জীবনহানি হচ্ছে। অনেক পশু খাদ্যভাবে মারা যাচ্ছে বা অপুষ্টিতে ভুগছে। আবার অনকে পশু রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে বা অকেজো হয়ে বেঁচে থাকছে।
খরায় পশুপাখি রক্ষার কৌশল :
খরা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত প্রাকৃতিক দুযোর্গ। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতিবছরই শুকনো মৌসুমে খরা কবলিত হয়। খরা মৌসুমে সবুজ ঘাসের অভাবে কৃষকেরা পশু খাদ্য হিসেবে মূলত খড়ের ওপরেই নির্ভরশীল থাকেন। কিন্তু পশুর স্বাভাবিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য ঘাস না খাইয়ে কেবলমাত্র কেবল খড়ই যথেষ্ট নয়।
পশুকে কেবলমাত্র ছোবড়া জাতীয় খাদ্য খাওয়ালেই চলবে না । খড়ে অল্প পরিমাণ শর্করা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে অন্যান্য খাদ্য উপাদান অনুপস্থিত। তাই কেবলমাত্র খড় বিচালি খেলে পশুপাখি অনিবার্যভাবেই অপুষ্টির শিকার হয়। একারণে খরা পরিস্থিতিতে পশুপাখিকে কাঁাচা ঘাসের সম্পূরক বিভিন্ন ধরনের খাদ্য খাওয়ানো প্রয়োজন। ধান, গম ইত্যাদি শস্য পাখির খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। খরা মৌসুমে গৃহপালিত পাখির খাদ্যের বিরাট সমস্যা হয়ে থাকে।
খরা মৌসুমে পশুপাখির বিকল্প খাদ্য :
খরা মৌসুমে সবুজ ঘাসের অভাব দেখা দেয়। এজন্য খরা মৌসুম আরম্ভ হওয়ার আগেই ঘাস দিয়ে হে বা সাইলেজ করে রাখা প্রয়োজন। খড়কে ইউরিয়া মোলাসেস্ প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ানো উত্তম। এর ফলে গবাদী পশু কেবল শুকনো খড়ের তুলনায় অনেক বেশি খাদ্য উপাদান পাবে। সবুজ ঘাসের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফডার ট্রির পাতা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেমন— ইপিল ইপিল, নীল, শণপাট, জিগা, কাঁঠাল, বাবলা, ডেউয়া, ডুমুর, মান্দার, কৃষ্ণচূড়া, আম পাতা প্রভৃতি।
বসতবাড়ির কাছাকাছি, সড়কের পাশে, পতিত জমিতে, বাঁধের ধারে, পুকুরের পাড়ে এধরনের গাছ লাগিয়ে রাখা যেতে পারে। এর ফলে অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও খাদ্যসংকটের সময়ে এসব গাছের পাতা গবাদি পশুর পুষ্টি চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তদুপরি মনুষ্য খাদ্যের উপজাত দ্রব্যাদিও পশুর—পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
যেমন— গমের ভূষি, চাউলের কঁুড়া, ডালের ভূষি, সরিষা বা তিলের খৈল প্রভৃতি। ঝোলাগুড় ফেলে না দিয়ে বা নষ্ট না করে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে খরা মৌসুমে শুকনো খড়ের সাথে মিশিয়ে পশুপাখিকে খাওয়ালে বেশ সুফল পাওয়া যায়। খড় কুচি কুচি করে কাটতে হবে।
তারপর ভাতের ফ্যানে খড় ভিজাতে হবে। ঐ খড়ের সাথে মানুষের খাদ্যের বিভিন্ন উপজাত প্রয়োজনমত মিশাতে হবে। ঐ মিশ্রণের সাথে যোগ করতে হবে ৫০ গ্রাম লবণ এবং ৩০০ গ্রাম ঝোলাগুড়। এভাবে তৈরী করা যাবে উৎকৃষ্ট মানের পশুখাদ্য মিশ্রণ। এই মিশ্রিত খাদ্য খাওয়ালে পশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাবে। এতে পশুর উৎপাদনক্ষমতা ও কর্মক্ষমতাও অক্ষুণ্ণ থাকবে। খরা মৌসুমে ইউরিয়া মেলাসেস ব্লক তৈরি করে খাওয়ালে গবাদি পশুর খাদ্য চাহিদা মেটে। তবে গবাদি পশুকে প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার পানি খাওয়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
খরা মৌসুমে পশুপাখির রোগ ব্যাধি :
খরা মৌসুমে গবাদি পশু নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। একারণে সংক্রামক রোগের আক্রমণ ঠেকাতে নিয়মিতভাবে প্রতিষেধক টিকা দিতে হয়। খরা মৌসুমে গবাদি পশুর বহি: দেহের পরজীবী, যেমন— আটালি, উকুন এবং মাছির উপদ্রব অনেক বেড়ে যেতে পারে। একারণে এ মৌসুমে অত্যন্ত যত্নের সাথে পশুর শরীর ঘসে ঘসে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। পরজীবীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে পশু চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। খুব বেশি গরম পড়লে পশু—পাখি নিয়মিতভাবে গোসল করাতে হবে।
পশুর অন্য যে কোন ধরনের রোগ লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যায় পশু পাখি রক্ষার কৌশল বন্যা বাংলাদেশে নিয়মিত অতিথির মতই প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এর আগমন ঘটে। দেশের একটি ব্যাপক এলাকা বন্যা প্রবণ। বন্যায় এ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে যায়, অনেক প্রাণহানি ঘটে, ফসল ডুবে যায়। অনেক মানুষের জীবনহানিও ঘটে। অনেক পশু পাখি মারা যায়, ে¯্রাতে ভেসে যায়। এসময়ে পশু পাখি লালন পালন অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
পাখির খাদ্য সংকট প্রবল আকার ধারণ করে। তদুপরি এই সময়ে পশু পাখির বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধির—উপদ্রব দেখা দেয়। বন্যায় পশু পাখির আশ্রয় বিস্তীর্ণ জলমগ্ন এলাকার মধ্য আবাসের জন্যই স্থানভাব দেখা দেয়। এর মধ্যে গবাদি পশুর জন্য স্থান পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।
এ সময়ে পশু পাখি সংরক্ষণে প্রথম করণীয় হবে যথাসম্ভব উঁচু স্থানে এদের থাকার ব্যবস্থা করা। উঁচু সড়কের ধারে বা বাঁধের ওপরে রাখতে পারলেই উত্তম। উঁচু স্থানে আচ্ছাদন তৈরি করে এদেরকে বেঁধে রাখতে পারলে ভাল হয়। পশু পাখিকে কাঁদাপানিতে রাখা যাবে না। কারণ তাতে এদের পায়ে ঘা হবে। পশু যদি জলমগ্ন এলাকায় থাকে বা বারংবার বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে তবে নানা ধরনের রোগের আশঙ্কা থাকে।
বন্যায় পশু পাখির খাদ্য :
চারদিক যখন জলমগ্ন থাকে তখন পশু পাখির খাদ্য সংকট চরমে ওঠে। পশুর জন্য ঘাস পাওয়া যায় না। লতাপাতা বা কচুরিপানা বেশি পরিমাণে খেলে রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। জলমগ্ন এলাকার পঁচা পানি খেয়েও পশুর রোগ হতে পারে। ঘাসের অভাবের কারণে পশু পাখির জন্য এসময়ে বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। খড়, চাউলের কুঁড়া, গমের ভূষি, খৈল প্রভৃতি পশু পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উঁচু স্থানে মাচা তৈরি করে তার ওপরে যত্ন সহকারে রাখলে খড় পঁচার ভয় থাকেনা।
তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন খড় পানিতে না ভেজে। খড় ছাড়াও অন্যান্য দানাদার খাদ্য এমনভাবে সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে যেন তা বৃষ্টির পানিতে না ভেজে। বৃষ্টির পানিতে ভিজলে ঐসব খাদ্য সঁ্যাতসেঁ্যতে হয়ে যেতে পারে। আর এ ধরনের ভেজা সঁ্যাতসঁ্যাতে খাদ্য খাওয়ালে পশু পাখির দেহে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। বন্যার সময় প্রচুর পরিমাণে কচুরিপানা, কলমিশাক, লতা—গুল্মাদি জন্মে। সবুজ ঘাসের অভাবে এসব কলমি শাক, কচিুরপানা বা লতাগুল্ম পশুকে খাওয়ানো যায়। কলাগাছের বাকলও গবাদি পশুকে খাওয়ানো যায়।
তবে এসব খাদ্য খেয়ে অনেক সময় পশু পাখি উদরাময় সহ অন্যান্য পেটের পীড়ায় ভোগে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে মাঠে প্রচুর ঘাস গজিয়ে ওঠে। এসব ঘাস পশুকে খাওয়ানো অনুচিত। তবে দুই এক পশলা বৃষ্টি হলে বা মাঠ শুকানোর পর এসব ঘাস পশুকে খাওয়ানো যায়।
তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলে পশুকে কাঁঠাল পাতা, কলাপাতা, বাঁশপাতা, হিজলপাতা, বাবলা পাতা খাওয়ানো যায়। কচুরিপানা বা এসব ঘাস শুকিয়ে খাওয়ালে রোগব্যাধির আশংকা কম থাকে। এসব খাদ্য অল্প অল্প করে শুকালে দানাদার খাদ্যের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। এসব খাদ্য একসাথে বেশি খাওয়ানো যাবেনা। কারণ তাতে পশুর উদরাময় দেখা দিতে পারে। এমনকি পশুর শরীরে বিষক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। সম্ভব হলে পশুকে ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক খাওয়ানো যেতে পারে।
ডোবা—নালা বা আবদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানি পশু পাখি কোনভাবে খাওয়ানো যাবেনা। তবে পশুকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার নিরাপদ পানি খাওয়াতে হবে। বন্যায় পশু পাখির রোগ বন্যার সময় এবং বন্যা পরবতীর্কালে পশু পাখি বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন—তড়কা, গলাফুলা, ক্ষুরারোগ, বাদলা, ডায়রিয়া, গাভীর বাঁটে ঘা প্রভৃতি। পশুপাখিকে অবশ্যই সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে।
সম্ভব হলে বর্ষা মৌসুমে আগেই পশু পাখি সংক্রামক রোগের টিকা দেওয়া উচিত। বন্যার আগে টিকা দেয়া না থাকলে জরুরী ভিত্তিতে পশু সম্পদ বিভাগের কমীর্দের সাথে যোগাযোগ করে পশু পাখিকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ অবস্থাতেই পশুকে টিকা দেয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ সাধারণত রোগক্রান্ত পশু পাখিকে বাঁচানো যায় না। কোনভাবে বেঁচে গেলেও এসব পশু তার উৎপাদন ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে অকেজো হয়ে যায়। আক্রান্ত পশুর চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে পশু চিকিৎসাকের পরামর্শমত ব্যবস্থা নিতে হবে।
জলোচ্ছাসে পশু পাখি রক্ষার কৌশল :
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই সামুদ্রিক ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রোপকূল এলাকায় এর তীব্রতা অধিক। প্রায় প্রতিবছরই উপকূলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রে যখন নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় তখন তা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আকারে স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসে। এর ফলে সমুদ্রের লোনা পানি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি উঁচু হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই স্থলভাগে ঢুকে পড়ে। তখন তাকে জলোচ্ছ্বাস বলা হয়।
জলোচ্ছ্বাসের ফলে মানুষের প্রাণহানি ঘটে, বসতবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, ফসল বিনষ্ট হয়, পশু পাখি ও হাঁস—মুরগির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অনেক পশু পাখি মারা যায়। কিছু কিছু পশু মারাত্মকভাবে আহত হয়। আবার জলোচ্ছ্বাসের পরপরই নানা ধরনের রোগও দেখা দেয়। জলোচ্ছ্বাসের পরবতীর্তে পশু খাদ্যেরও সংকট দেখা দেয় এবং অপরিচ্ছন্ন পানি খেয়েও অনেক পশু রোগাক্রান্ত হয়।
জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে পশুসম্পদকে রক্ষার জন্য জরুরী প্রয়োজন হল এদের জন্য যথাযথ আশ্রয়স্থল, খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা এবং এদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। জলোচ্ছ্বাসের সংকেত পাওয়া গেলেই পশু পাখিকে আশ্রয়স্থানে নিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। সেখানে পশুপাখির জন্য উপযুক্ত খাদ্যেরও ব্যবস্থা করতে হয়। কাঁচা ঘাসের বদলে এসময়ে গবাদি পশু শুকনো খড় ও পাখিকে দানাদার খাদ্য; যেমন— চাউলের কঁুড়া, গমের ভূষি, খৈল প্রভৃতি খাওয়াতে হয়। পশুকে হে বা সাইলেজ খাওয়াতে পারলেও ভালো হয়।
জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের ফলে মানুষও যেমন মারা যায়, তেমনি নানা ধরনের প্রাণী ও পাখিও মারা যায়। প্রতিকূল অবস্থায় মৃত মানুষ, পশু, পাখির সৎকার করা অনেক সময় সম্ভব হয়না। মৃত প্রাণী নদী— নালা, খাল— বিল ও মাঠে— ঘাটে পড়ে থাকে। ফলে মৃত প্রাণী থেকে দুর্গন্ধ বের হয় এবং চারপাশের পরিবেশ দূষিত হয় এবং ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
জলোচ্ছ্বাসের পর গবাদিপশু নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন— তড়কা, গলাফুলা, ক্ষুরারোগ, বাছুরের বাদলা রোগ, গাভীর বাঁটে ঘা, ছাগল— ভেড়ার গুটি ও সর্দি— কাশি প্রভৃতি। তদুপরি দূষিত পানি খেয়েও পশু পাখি উদরাময়সহ নানা ধরনের পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। ঝড়— জলোচ্ছ্বাসে আহত পশু পাখির দেহে ক্ষত সৃষ্টি হয়। ক্ষতস্থানে রোগজীবাণুর সংক্রামণ ঘটে এবং অনেক রোগের আক্রমণ ঘটে।
অসুস্থ এবং আহত সকল পশুর চিকিৎসা এসময়ে খুবই প্রয়োজন। অন্যথায় রোগ মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করতে পারে। দুযোর্গপূর্ণ এলাকায় এ সময়ে সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি পশু চিকিৎসার জন্য টিমও গঠন করা হয়। পশুর মালিকদের অবশ্যই এসব পশু— চিকিৎসক টিমের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্যোগের আগেই পশু পাখিকে সংক্রামক রোগের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পশুর দেহের ক্ষতের সুচিকিৎসা করতে হবে এবং ক্ষতস্থানে যাতে মাছি না বসে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কষ্ট করে হলেও পশুকে পরিষ্কার পানি খাওয়াতে হবে। পশু যেন কোন অবস্থাতেই পঁচা বা দূষিত পানি না খেতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবেই জলোচ্ছ্বাস পরবতীর্ পশু পাখি সংরক্ষণ করা সম্ভব।