বীজমান নিয়ন্ত্রণ

কৃষিতে উচ্চ ফলন ও টেকসই উৎপাদনের মূল চাবিকাঠি হলো মানসম্মত বীজ। অথচ এই বীজের গুণগত মান নিশ্চিত না হলে কৃষকের পরিশ্রম ও উৎপাদনশীলতার উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাই বীজের গুণমান নিয়ন্ত্রণ বা বীজমান নিয়ন্ত্রণ কৃষি প্রযুক্তির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অংশ।

আজকের আলোচনায় আমরা জানতে চেষ্টা করব—বীজমান নিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝায়, কেন এটি প্রয়োজনীয়, কীভাবে এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা হয়, এবং বাংলাদেশে বীজমান নিয়ন্ত্রণের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেমন। এই পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বীজমান যাচাই, পরীক্ষণ, প্রত্যয়ন ও তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করবে, যা বাস্তব কৃষি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(বীজ ও বীজ প্রযুক্তি | ইউনিট: ৩ | পাঠ: ৩.৩)

বীজমান নিয়ন্ত্রণ

 

বীজমান নিয়ন্ত্রণ

 

বীজমান কী?

বীজের মান বা বীজমান নির্ধারিত হয় একাধিক উপাদানের ভিত্তিতে। এর মধ্যে প্রধান হলো—বীজের বিশুদ্ধতা, অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা, স্বাস্থ্য এবং কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা।

বীজের বিশুদ্ধতা বলতে বোঝানো হয় একটি বীজের নমুনায় কতটুকু ধুলাবালি, কাঁকড়, মাটি, আগাছার বীজ, অন্যান্য ফসলের বীজ বা উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ উপস্থিত রয়েছে। এই বিশুদ্ধতার মাত্রাই অনেকাংশে বীজের সামগ্রিক গুণমানকে নির্ধারণ করে।

ইতঃপূর্বে আমরা বীজের অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতা, স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি।

 

বীজের মান নিয়ন্ত্রণ প্রত্যয়ন

বীজমান নিশ্চিতকরণে বীজ প্রত্যয়ন কার্যক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উন্নত ও মানসম্মত বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করতে এই কার্যক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশে বীজ প্রত্যয়ন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭৪ সালে শস্য বীজ প্রকল্পের আওতায়, যখন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে, এই কার্যক্রমকে আইনগত বৈধতা দিতে প্রণয়ন করা হয় বীজ অধ্যাদেশ ১৯৭৭ এবং বীজ বিধিমালা ১৯৮০

 

বীজের মান নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যক্রম

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজনন ও ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে। এই বীজসমূহ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বি..ডি.সি) বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ করে, এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি সেগুলোর প্রত্যয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে।

বীজ অধ্যাদেশ ১৯৭৭ ও বীজ বিধি ১৯৮০ অনুযায়ী, বীজের উৎপাদন, প্রত্যয়ন, বাজারজাতকরণ প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিধিমালার আওতায় বীজের বংশগত বিশুদ্ধতা, বাহ্যিক বিশুদ্ধতা, আর্দ্রতাঅঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতার নির্ধারিত মান যাচাই করা হয়।

বি.এ.ডি.সি বীজ উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ অনুসরণ করে। বীজ বপনের শুরু থেকে ফসল কাটার পর গুদামজাত করার শেষ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিয়মিত তদারকি ও পর্যবেক্ষণ চালানো হয়।

 

মাঠপর্যায়ে বীজের মাননিয়ন্ত্রণ যাচাই

বীজ ফসলের মাঠ নিয়মমাফিক রোগিং করা হয় এবং বি.এ.ডি.সি ও বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি যৌথভাবে মাঠ পরিদর্শন করে থাকে। কেবলমাত্র নির্ধারিত মানসম্পন্ন ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে যথাযথভাবে গ্রেডিং, ক্লিনিং এবং প্রস্তুতকরণ কার্যক্রম সম্পাদিত হয়।

বিতরণ মৌসুমের আগে প্রতিটি বীজ লট বি.এ.ডি.সি এবং বীজ প্রত্যয়ন প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ পরীক্ষাগারে পৃথকভাবে পরীক্ষা করে। গুণগত মান নিশ্চিত হলে যৌথ ট্যাগযুক্ত প্যাকেট আকারে সরবরাহ করা হয়।

জাতীয় বীজ বোর্ড নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ফসলের মাঠমান ও বীজমান নির্ধারণ করে থাকে, যা দেশের সার্বিক কৃষি উৎপাদনে মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

 

 

বীজমান নিয়ন্ত্রণ

 

বীজের মানের অবনতি:

বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের যে কোন স্তরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটার কারণসমূহ নিম্নে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো :

বীজ ফসল কাটার পূর্বে বীজের মানের অবনতি :

বীজ ফসল কাটার পূর্বে অর্থাৎ ফসল মাঠে থাকা অবস্থায়ই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটতে পারে। যে সব কারণে ফসল মাঠে থাকা অবস্থায়ই বীজ মানের অবনতি ঘটে তা মোটামুটি নিম্নরূপ :

(ক) বৃদ্ধিকালে বীজের মানের অবনতি :

অতিরিক্ত শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়া থাকলে বীজ স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি লাভ করতে পারে না এবং দ্রুত পরিপক্কতা লাভ করে। ফলে বীজ ছোট আকারের ও নিম্ন তেজ সম্পন্ন হয় এবং অনেক বীজ অপুষ্ট থেকে যায়।

(খ) বীজ পরিপক্কতা লাভ কালে বীজের মানের অবনতি :

অতিরিক্ত শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়া থাকলে বীজ দ্রুত শুকাতে থাকে। ফলে বীজ আবরণী ও বীজদলে ফাটলের সৃষ্টি হয়। এমনকি ভ্রূণেও ফাটলের সৃষ্টি হতে পারে। এ ফাটল বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটায়। এ ধরনের বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদগমকালে বিভিন্ন রোগজীবাণু দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয় এবং সাধারণতঃ অস্বাভাবিক চারার জন্ম দেয়।

(গ) বীজ পরিপক্কতা লাভের পর বীজের মানের অবনতি :

হঠাৎ করে বৃষ্টি হলে বীজ ভিজে যায়। চরম ক্ষেত্রে গাছে লেগে থাকা অবস্থায়ই বীজ গজিয়ে যেতে পারে।

(ঘ) বীজ পরিপক্কতা লাভের পরও বীজ ফসল কাটতে দেরী হলে বীজের মানের অবনতি :

কোন কোন পরিস্থিতিতে ক্ষেতের চরম পারিপার্শ্বিক অবস্থা বীজের মান নষ্ট করতে পারে। দিন ও রাত্রের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তারতম্যও শুষ্ক বীজের ক্ষতি সাধন করে।

 

বীজফসল কাটা থেকে শুরু করে সংরক্ষণের পূর্ব পর্যন্ত বীজের মানের অবনতি:

বীজ ফসল কাটা ও মাড়াই কালে এবং বীজ শুকানো ও প্রক্রিয়াজাত করার সময় বিভিন্নভাবে বীজের মান নষ্ট হতে পারে। এর যে কোনো পর্যায়ে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও পতনের ফলে বীজ আঘাত প্রাপ্ত হলে বীজের আবরণ, বীজদল ও ভ্রূণে ফাটল ধরতে পারে। বীজ শুকানোর সময় উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবেও বীজের মান নষ্ট হতে পারে।

 

বীজ সংরক্ষণকালে বীজের মানের অবনতি:

যথাযথভাবে বীজ সংরক্ষণ করতে না পারলে উন্নত মানের বীজেরও অবনতি হতে পারে। সদ্য সংগৃহীত উচ্চ তেজ সম্পন্ন বীজও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে তার মানের দ্রুত অবনতি ঘটবে। সংরক্ষণ কালে বীজে অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াসমূহের মাত্রা যত বেশি থাকবে বীজের তেজ তত তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। বীজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াসমূহের মাত্রা আবার নির্ভর করে বিরাজমান তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার উপর। তাই বীজের তেজ ও মান দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে বীজ এমন অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে যেখানে বীজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াসমূহের মাত্রা থাকবে নিম্নতম। অতএব তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ বীজ সংরক্ষণের চাবিকাঠি। এ ছাড়াও সংরক্ষণ অবস্থার ওপর নির্ভর করে পোকামাকড় ও ইঁদুরের আক্রমণে বীজের মান নষ্ট হতে পারে।

সংরক্ষণাগারে বীজের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার তেজ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। এর প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে উক্ত বীজ থেকে উৎপাদিত চারার বৃদ্ধি কমে আসে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বীজের তেজ আরো কমে গেলে সে বীজ প্রতিকূল অবস্থায় শুষ্ক মাটি ও নিম্ন তাপমাত্রায় অংকুরিত হতে পারেনা এবং শেষ পর্যায়ে বীজের মৃত্যু ঘটতে পারে। সময়ের ব্যবধানে সংরক্ষণাগারে বীজের মান কত দ্রুত নষ্ট হবে তা নির্ভর করে বীজের প্রাথমিক তেজ বা গুণগত মান, বীজে রোগজীবাণুর উপস্থিতি, গুদামজাত করার শুরুতে বীজে জলীয় ভাগ ও সংরক্ষণাগারের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর।

যথাযথ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করে সংরক্ষণাগারে বীজের মান নষ্ট হওয়ার গতিকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণভাবে বলা যায় যে, সংরক্ষণাগারের তাপমাত্রা ও বীজের জলীয় ভাগ যত বেশি হবে, বীজের তেজ তত দ্রুত নষ্ট হবে। বীজের জলীয়ভাগ অবশ্য সংরক্ষণাগারের আর্দ্রতার ওপর নির্ভরশীল। বীজ বিজ্ঞানী হ্যারিংটন তার নিজস্ব গবেষণা ও অন্যান্য গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বীজ সংরক্ষণের ওপর নিম্নলিখিত দুটি মতবাদ ব্যক্ত করেছেন (হ্যারিংটন-১৯৭০) :

 

বীজ বিজ্ঞানী হ্যারিংটনের দুটি মতবাদ:

  •  সংরক্ষণাগারে বীজের তাপমাত্রা প্রতি ৫ সেন্টিগ্রেড কমানোর ফলে বীজের সংরক্ষণকাল দ্বিগুণ হবে। এ নিয়ম ৫০ – ০° সেঃ তাপমাত্রা সীমার মধ্যে প্রযোজ্য।
  • সংরক্ষণাগারে বীজের জলীয়ভাগ ১% কমানোর ফলে বীজের সংরক্ষণকাল দ্বিগুণ হবে। এ নিয়ম বীজের ১৪৪% জলীয়ভাগ সীমার মধ্যে প্রযোজ্য।

 

হ্যারিংটন উদাহরণস্বরূপ দেখিয়েছেন যে, পেয়াজ বীজ ১২% জলীয় ভাগ ও ৪০° সেঃ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে ১ সপ্তাহের মধ্যে মরে যাবে, কিন্তু ৭% জলীয় ভাগ ও ১০° সেঃ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে ২০ বৎসর পরও তা অঙ্কুরিত হবে। বীজ সংরক্ষণের জন্য অপর একটি প্রচলিত সহজ নিয়ম হচ্ছে- সংরক্ষণাগারের আপেক্ষিক আর্দ্রতা (%) ও তাপমাত্রার (ফারেনহাইটে) যোগফল ১০০ এর অধিক হবে না।

সংরক্ষণকালে বীজের অভ্যন্তরে জলীয় ভাগের বিভিন্ন পরিমাণ বীজের মানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। নিম্নে তার একটি বিবরণ দেয়া হলো :

উচ্চ তাপমাত্রা ও অধিক জলীয় অংশে বীজ সংরক্ষণের ফলে বীজ মানের দ্রুত অবনতি ঘটলেও শুধুমাত্র তাপমাত্রা কমিয়ে কিংবা বীজের জলীয় ভাগ কমিয়ে বীজের সংরক্ষণকাল আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

 

সূত্র:

  • বীজমান নিয়ন্ত্রণ , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি , ইউনিট-৩ , পাঠ-৩.৩

Leave a Comment