বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা

আজকের পাঠে আমরা আলোচনা করব বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা নিয়ে, যা বীজ বীজ প্রযুক্তি বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক অংশ। এই পাঠে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয় করা হয় এবং এই পরীক্ষায় কী ধরনের যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা কী?

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা বলতে বোঝায়—কোনো নির্দিষ্ট বীজ নমুনায় ওজনের ভিত্তিতে শতকরা কত ভাগ মূল শস্যের বিশুদ্ধ বীজ রয়েছে, তা নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় নমুনায় অবাঞ্ছিত উপাদান কতটা বিদ্যমান এবং কৃষকের জন্য তা কতটা উপযোগী।

বীজ নমুনার প্রধান উপাদানসমূহ

একটি সাধারণ বীজ নমুনায় সাধারণত নিচের চারটি উপাদান থাকে:

১. বিশুদ্ধ বীজ (Pure Seed): যে বীজটি মূলত চাষের উদ্দেশ্যে নির্বাচন করা হয়েছে।
২. অন্য ফসলের বীজ (Other Crop Seed): অন্য ফসলের অনাকাঙ্ক্ষিত বীজ যা মূল ফসলের সঙ্গে মিশে গেছে।
৩. আগাছার বীজ (Weed Seed): অনিষ্টকারী আগাছার বীজ যা জমিতে গিয়ে ফসলের ক্ষতি করতে পারে।
৪. জড় পদার্থ (Inert Matter): খড়কুটা, পাতা, ধুলাবালি, চিটা, ছাতাগুটি ইত্যাদি অবাঞ্ছিত বস্তু।

 

ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি

সঠিকভাবে বিশুদ্ধতা নির্ধারণের জন্য নিচের যন্ত্রপাতিগুলি ব্যবহার করতে হয়:

  • পিউরিটি বোর্ড (Seed Purity Board)
  • সুনির্দিষ্ট মাপক নিক্তি (যা +0.001 গ্রাম পর্যন্ত ওজন নির্ণয় করতে পারে)
  • ওয়েল পেপার
  • পেট্রিডিস (মাঝারি ও বড় আকারে)
  • চিমটা (Forcep)
  • স্ট্যান্ডযুক্ত ম্যাগনিফায়িং গ্লাস (Magnifying Glass)

 

পরীক্ষার ধাপসমূহ

১. ওজন নির্ধারণ:
মাপক নিক্তি ব্যবহার করে নমুনার মোট ওজন (ধরা যাক G গ্রাম) পরিমাপ করুন।

  1. বীজ ছড়িয়ে দিন:
    পিউরিটি বোর্ডে নমুনার বীজ সমভাবে ছড়িয়ে দিন।
  2. উপাদান পৃথককরণ:
    নিচের চারটি উপাদান আলাদা করুন—চিমটা ব্যবহার করে:

    • বিশুদ্ধ বীজ
    • অন্য ফসলের বীজ
    • আগাছার বীজ
    • জড় পদার্থ
  3. সনাক্তকরণে সতর্কতা:
    যদি কোনো বীজ শনাক্ত করতে সন্দেহ হয়, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ব্যবহার করে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।
  4. পেট্রিডিসে সাজানো ওজন নির্ধারণ:
    পৃথক করা প্রতিটি উপাদান আলাদা পেট্রিডিসে রাখুন এবং আলাদাভাবে প্রতিটির ওজন নির্ণয় করুন।

 

বীজের বিশুদ্ধতার হিসাব:

ধরা যাক—

  • বিশুদ্ধ বীজের ওজন = P গ্রাম
  • কার্য সম্পাদিত মোট নমুনার ওজন = W গ্রাম

তাহলে,
বীজের বিশুদ্ধতার হার = (P ÷ W) × 100

⚠️ গুরুত্বপূর্ণ নোট:
যদি কার্য সম্পাদিত নমুনার ওজন W এবং মূল নমুনা ওজন G এর মধ্যে পার্থক্য ১% এর বেশি হয়, তাহলে পুনরায় পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।

 

বিশুদ্ধ বীজ অংশ :

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে নমুনার প্রতিটি উপাদান সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হয়। এজন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করে বিশুদ্ধ বীজ, অন্য ফসলের বীজ, আগাছা বীজ এবং জড় পদার্থ পৃথক করতে হবে।

 

. বিশুদ্ধ বীজ অংশ (Pure Seed):

বিভিন্ন ফসল বা প্রজাতিভেদে বিশুদ্ধ বীজের সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে নিচের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ বীজ নির্ধারণ করা যায়:

  • ✅ সম্পূর্ণ, অক্ষত ও সুস্থ বীজ
  • ✅ ভাঙা বীজ হলেও যদি ভ্রূণসহ ৫০% বা তার বেশি অংশ অবশিষ্ট থাকে
  • ❌ আংশিক অপূর্ণ বীজ, চিটা বা ফাঁপা বীজ বিশুদ্ধ বীজ হিসেবে গণ্য হবে না
    📌 বিশুদ্ধ বীজ নির্ধারণে সন্দেহ হলে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ব্যবহার করা উচিত।

 

. অন্য ফসলের বীজ অংশ (Other Crop Seed):

যে বীজটি পরীক্ষাধীন ফসলের নির্ধারিত জাত ব্যতীত অন্যান্য জাত বা প্রজাতির অন্তর্গত, সেগুলো এই শ্রেণিতে পড়বে। এর মধ্যে থাকতে পারে:

  • পুষ্ট বীজ
  • আংশিকভাবে পুষ্ট বীজ
  • ভাঙা বীজ (যদি অর্ধেক বা তার বেশি অংশ থাকে)

🔹 এগুলো দেখতে অনেকটা মূল বীজের মতো হলেও ভিন্ন জাত বা ভিন্ন ফসল হওয়ায় বিশুদ্ধ বীজের মধ্যে গণ্য হবে না।

 

. আগাছার বীজ অংশ (Weed Seed):

পরীক্ষাধীন নমুনায় থাকা সমস্ত সনাক্তযোগ্য আগাছার বীজ এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

  • পূর্ণ বীজ
  • ভাঙা বীজ
  • ফাটল ধরা বা অপূর্ণ বীজ

🛑 এইসব বীজ মাঠে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় আগাছা হিসেবে বৃদ্ধি পায়, যা ফসলের ফলন ব্যাহত করে।

 

. জড় পদার্থ (Inert Matter):

উপরে উল্লিখিত তিনটি বিভাগের বাইরে যে কোনো উপাদান জড় পদার্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

  1. মূল শস্য বা অন্য শস্য বীজের ৫০% এর কম অবশিষ্ট অংশ
  2. ছাতাগুটি বা কৃমিসদৃশ গঠন (বাইরে বা ভিতরে) যুক্ত বীজ
  3. চিটা বা ফাঁপা বীজ
  4. খড়কুটা, শুকনো পাতা, কাণ্ড ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ অংশ
  5. ধুলাবালি, মাটি কণা, ইটের টুকরো, নুড়ি
  6. মৃত বা জীবিত পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ

📌 জড় পদার্থ পরীক্ষার মান ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এই উপাদানসমূহ বীজ থেকে পৃথক করা অত্যন্ত জরুরি।

 

✅ পরিশেষে:

বীজ বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের পর প্রতিটি উপাদান যথাযথভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে নোটবুকে লিপিবদ্ধ করুন। এতে আপনি নিজের হাতে বিশুদ্ধতার হার হিসেব করতে সক্ষম হবেন এবং এটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাস এনে দেবে।

 

সূত্র:
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা, বীজ বীজ প্রযুক্তি, ব্যবহারিক, ইউনিট-১, পাঠ-১.৭

Leave a Comment