বীজের সুপ্ততা এবং সুপ্ততার কারণসমূহ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.৪ নং পাঠের অংশ। বীজের সুপ্ততা কোন সজীব বীজকে উপযুক্ত পরিবেশে বপন করলে অংকুরোদগম হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সকল বীজে এরূপ ঘটেনা। কোন কোন বীজের জীবনকালে সকল বৃদ্ধি প্রক্রিয়া থেমে থাকে, যদিও শ্বসন প্রক্রিয়া অতি ধীর গতিতে চলতে থাকে। বীজের এ অবস্হাকে সুপ্ততা বলে। সুপ্ততার অবসান হলে বীজের অংকুরোদগম হয়। বীজের সুপ্ততা বীজ ভেদে কয়েকদিন থেকে কয়েক বৎসর হতে পারে। বীজের সুপ্তাবস্হাকে নিম্নোপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
Table of Contents
বীজের সুপ্ততা এবং সুপ্ততার কারণসমূহ
উপযুক্ত পরিবেশে কোন সজীব বীজের অংকুরোদগম না হওয়াকেই বীজের সুপ্তাবস্হা বলে। উক্ত বীজকে সুপ্ত বীজ বলে। বিভিন্ন কারণে বীজের সুপ্ততা হতে পারে। আলোচনার সুবিধার্থে উক্ত কারণসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় :
(১) প্রাথমিক সুপ্ততা
(২) মাধ্যমিক সুপ্ততা
(৩) বিশেষ প্রকার সুপ্ততা

(১) প্রাথমিক সুপ্ততা :
বীজ মাতৃগাছে পরিপক্ক হওয়া পর্যায়ে বীজের নিজস্ব ভৌত ও শারীরবৃত্তীয় কারণে অংকুরোদগম হয় না। এ অবস্হাকে প্রাথমিক সুপ্ততা বলে। এর স্হায়ীত্ব নিম্নরূপ হবেঃ
- অস্হায়ী বা স্বল্পস্থায়ী
- দীর্ঘস্থায়ী
অস্থায়ী বা স্বল্পস্থায়ী সুপ্ততা কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে এবং দীর্ঘস্হায়ী সুপ্ততা ৩-৬ মাস হতে পারে। বীজের প্রাথমিক সুপ্ততার কারণগুলো নিম্নরূপ :
(ক) অভেদ্য বীজত্বক দৃঢ় বীজাবরণ
(গ) বীজত্বকের অক্সিজেন অভেদ্যতা
(ঘ) অপূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ
(ঙ) সুপ্ত ভ্রূণ
(চ) অঙ্কুরোদগম রোধক দ্রব্যের উপস্হিতি
(২) মাধ্যমিক সুপ্ততা :
বীজ কর্তনের বা সংগ্রহের পরপরই অংকুরোদগমে সক্ষম এমন বীজকে কিছু সময় প্রতিকুল পরিবেশে রাখার দরুণ বীজ সুপ্ততা প্রাপ্তি হলে তাকে মাধ্যমিক সুপ্ততা বলে। এই সুপ্ততাকে কৃত্রিম সুপ্ততা বলা যেতে পারে।
(৩) বিশেষ প্রকার সুপ্ততা :
যে বীজে সুপ্ততা থাকা সত্ত্বেও অংকুরোদগম হওয়ার পর নানা কারণে অংকুরিত ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাকে বিশেষ সুপ্ততা বলে। অনেক বন্য ফুলে স্বাভাবিক বাহ্যিক পরিবেশে বীজের অংকুরোদগম হওয়ার পরও ভ্রূণমূল প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার দরুণ চারাগাছ উৎপন্ন হয় না তাকে এপিকোটাইল সুপ্ততা বলে। উক্ত এপিকোটাইল সুপ্ততা সম্পন্ন বীজ ১-১০° সেন্টিগ্রেডে কয়েকদিন রাখলে সুপ্ততা দূর হয়।

প্রাথমিক সুপ্ততার কারণসমূহের বিশদ বর্ণনা :
নানা কারণে বীজে সুপ্ততা দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশেষ সুপ্ততার কারণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তবে কৃষিতাত্ত্বিক (Agronomic) বিবেচনায় প্রাথমিক কারণগুলিকেই সুপ্ততার কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
অভেদ্য বীজত্বক এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
বীজের আবরণ অপেক্ষাকৃত শক্ত হওয়ার ফলে বীজের ভিতরে পানি ঢুকতে না পারার দরুণ বীজের সুপ্ততা দেখা দেয়। এর সাথে সময়ের বা শারীরবৃত্তীয় পরিপক্কতা লাভের কোন সম্পর্ক নেই। বীজে যতদিন পর্যন্ত পানি প্রবেশের অনুকূল ব্যবস্হা না করা হবে ততদিন উক্ত বীজের ত্বরিৎ অংকুরোদগম হবে না। উদাহরণ স্বরূপ লিগিউম পরিবারের কৃষ্ণচূড়া, ইপিল ইপিল ও জবা পরিবারের তুলা বীজ এর উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সকল বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজত্বক পানি অভেদ্য থাকে। কিন্তু শুষ্ক অবস্থায় সংরক্ষণ করার পর ধীরে ধীরে পানি ভেদ্যতা বাড়তে শুরু করে।
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কমালে বাড়লে পানি ভেদ্যতা দ্রুত বাড়ে। কৃত্রিমভাবে প্রয়োজনীয় ক্ষত সৃষ্টি করলে অংকুরোদগম ত্বরান্বিত হয়। যেমন : ইপিল ইপিল বীজ একটি পিন দ্বারা হালকাভাবে ফুটো করে দিলে সদ্য সংগৃহীত বীজ ৩-৫ দিনের মধ্যে অংকুরিত হয়, অথচ পিন না ফুটালে ১৫ দিনেও অংকুরিত হয় না।
দৃঢ় বীজাবরণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
কিছু কিছু বীজ আছে যাদের আবরণ যথেষ্ট পুরু ও শক্ত থাকে। ফলে পর্যাপ্ত পানি পেলেও ভ্রূণ স্ফীত হওয়ার প্রক্রিয়াটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন : পিগ আগাছা ও কেপসেলা গণের উদ্ভিদের বীজ।
বীজত্বকের অক্সিজেন অভেদ্যতা
বীজত্বকে অক্সিজেন অভেদ্যতার কারণে বীজের সুপ্ততা:
কারণেও বীজ সুপ্ততা দেখা দিতে পারে। ঘাগরা বীজের ত্বক ফাটিয়ে দিলে বা বীজের চারপাশে অক্সিজেনের চাপ বাড়ালে এদের সুপ্ততা ভংগ হয়। গাছের উপরের দিকে বীজের জন্য অক্সিজেনের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি প্রয়োজন হয়। শুষ্ক অবস্থায় রেখে দিলে বা সংরক্ষণ করলে এসকল বীজের অক্সিজেন ভেদাতা বাড়তে থাকে। কিছু ঘাসবীজ ও কম্পোজিটি পরিবারের বীজে বীজত্বকের অক্সিজেনের অভেদ্যতাজনিত সুপ্ততা দেখা যায়।
অপূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
অনেক উদ্ভিদ বীজের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ভ্রূণের বৃদ্ধির হার সংলগ্ন অন্যান্য অংশের কোষকলা অপেক্ষা কম। এমতাবস্হায় বাহ্যিক দিক থেকে বীজটি পুষ্ট হলেও তার ভ্রূণ ক্ষুদ্রাকার থেকে যায় অথচ বাহির থেকে তা বুঝার কোন উপায় নেই। তাই বীজটি উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করার পর উক্ত ভ্রূণের বৃদ্ধি ও পূর্ণতা পেতে যে সময় প্রয়োজন হয়, ততদিন উক্ত বীজের সুপ্তাবস্হা থাকবে। বিভিন্ন প্রকার অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদে এ অবস্হা সচরাচর চোখে পড়ে।
সুপ্ত ভ্রূণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
অনেক বীজে পরিপক্ক ভ্রূণ শারীরবৃত্তীয় কারণেও সুপ্তাবস্হায় থাকতে পারে। এ ধরণের বীজের আবরণ তুলে ফেলে অংকুরোদগমের উপযুক্ত বাহ্যিক পরিবেশে স্হাপন করলেও অংকুরোদগম হবে। না। একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরই কেবল এই সমস্ত বীজের অংকুরোদগম সম্ভব। পাইন ও পীচ বীজে এ জাতীয় সুপ্তাবস্হা বিদ্যমান থাকে।
অংকুরোদগম রোধক দ্রব্যের উপস্থিতির কারণে বীজের সুপ্ততা :
অনেক উদ্ভিদের বীজে নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে। উক্ত পদার্থসমূহ অংকুরোদগমে সরাসরি বাধা প্রদান করে। পেঁপে ও বাঁধাকপির বিভিন্ন জাতের বীজে এরূপ রোধকের উপস্হিতি বিদ্যমান থাকে।

মাধ্যমিক সুপ্ততার কারণসমূহ :
যদি কোন বীজ অংকুরোদগমের অনুপযুক্ত বাহ্যিক পরিবেশগত কারণে সুপ্ততা প্রাপ্ত হয়, তবে তাকে মাধ্যমিক সুপ্ততা বলে। বিভিন্ন কারণে মাধ্যমিক সুপ্ততা হতে পারে, নিম্নে কারণগুলো বর্ণনা করা হলোঃ
কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্হিতির কারণে বীজের সুপ্ততা :
যদি বীজকে উক্ত গ্যাসের ভিতরে কিছু সময় ধরে রাখা হয় এবং পরে অংকুরোদগমের উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনা হয় তবে সুপ্ততা প্রদর্শন করে। সাদা সরিষা বীজে এরকমের সুপ্ততাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
আলোর কারণে বীজের সুপ্ততা :
যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য আলোর উপস্হিতি অত্যাবশ্যক, তাদের কিছুদিন অন্ধকার অবস্থায় রাখলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে। অপরপক্ষে যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য অন্ধকার অত্যাবশ্যক, তাদেরকে আলোতে কিছুদিন রাখলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে।
তাপমাত্রার কারণে বীজের সুপ্ততা :
তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলেও বীজে সুপ্তাবস্হা আসে। যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন তাদের নিম্ন তাপমাত্রায় স্থাপন করলে এবং যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন তাদেরকে উচ্চ তাপমাত্রায় স্থাপন করলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে।
বীজাবরণের পরিবর্তনর কারণে বীজের সুপ্ততা :
অনেক সময় বীজাবরণের পরিবর্তনের ফলে বীজে সুপ্তাবস্হা আসে। উক্ত বীজের আবরণকে সরিয়ে ফেললে ভ্রূণের অংকুরোদগম হয়। কিন্তু পরিবর্তিত বীজাবরণের উপস্হিতি উক্ত বীজে সুপ্তাবস্হা আনয়ন করে।

বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গার উপায়
বীজতত্ত্ববিদগণ বীজের সুপ্ততা ভঙ্গের নানা উপায় খুজে বের করেছেন। এদের একক বা সম্মিলিত পদ্ধতি বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গতে বা কমিয়ে আনতে সক্ষম। কোন পদ্ধতিই এককভাবে সকল বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বীজ এবং সুপ্ততার প্রকৃতি অনুসারে পদ্ধতিরও পার্থক্য হয়।
কোন একটা পদ্ধতি হয়ত কোন জাতের বীজের সুপ্ততা তাড়াতাড়ি ভঙ্গ করতে পারে। সেই পদ্ধতি আবার অন্য জাতে তা দীর্ঘায়ু করতে পারে। তাই বীজের সুপ্ততা ভংগের কাজ অবশ্যই যথাযথভাবে করা বাঞ্ছনীয়। বীজের সুপ্ততা ভংগের বিভিন্ন পদ্ধতি নিচে বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো:
(১) পানিতে ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
এ পদ্ধতিতে বীজকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ফলে যে সমস্ত বীজে সহজে পানি প্রবেশ করতে পারে না সে সকল বীজে পানি প্রবেশ ত্বরান্বিত হয়, বীজ আবরণ নরম হয়, ভ্রূণের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং বীজ আবরণ সহজে অল্প চাপে ফেটে যায়। পানির পরিমাণ এবং ভিজিয়ে রাখার সময় বীজের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল।
(২) যান্ত্রিক ও দৈহিক আঁচড়ানোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
আঁচড়ানোর উদ্দেশ্য হলো শক্ত বীজাবরণকে এমনভাবে পরিবর্তন করে নেয়া যাতে করে বীজের ভিতরে সহজেই পানি ও অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে। যান্ত্রিক উপায়ে বীজকে একটি যন্ত্রে নিয়ে এমনভাবে নাড়াচাড়া করা হয় যাতে বীজের আবরণে কোথাও কোন ফাটল ধরে বা ক্ষয় হয়। দৈহিকভাবেও বীজকে কোন পাথর, ইট, বা এ জাতীয় কোন পদার্থের সাথে ঘর্ষণ বা কোন কিছুর মাঝে রেখে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
যান্ত্রিক বা দৈহিক আঁচড়ানোর কাজ খুব সাবধানে করতে হবে যাতে কোন অবস্হাতেই বীজের ভ্রূণ নষ্ট না হয়। কী পদ্ধতিতে বা কতক্ষণ আঁচড়াতে হবে তা বীজের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।
(৩) অল্পদ্রব্য সহযোগে আঁচড়ানোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
এ পদ্ধতিতে বীজকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হয়। ঘন সালফিউরিক এসিডের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৮৪ হওয়া দরকার। সাধারণত বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ এসিড (নির্দিষ্ট ঘনমাত্রার) একটি কাঁচ বা মাটির পাত্রে নিতে হয়। তারপর বীজকে উক্ত পাত্রে ঢেলে মুখ আটকাতে হবে এবং মাঝে মাঝে কোন কাঠির সাহায্যে বীজকে নাড়াচাড়া করতে হবে।
অতিরিক্ত নাড়াচাড়া উচিত নয়। তবে বীজের চতুপার্শ্বে যেন সমভাবে এসিডের ক্রিয়া হয় এবং উক্ত মিশ্রণের তাপমাত্রা যেন খুব বেড়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ৬০-৮০ ফাঃ।
এই পদ্ধতিতে বীজকে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করতে হবে তা তাপমাত্রা, বীজের প্রকৃতি, এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বীজের স্তুপের উপর নির্ভর করবে। সময়ের পরিমাণ ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। বীজাবরণ যখন পাতলা হয়ে আসে তখন সাবধানে এসিড ঢেলে নিতে হয় এবং তৎক্ষনাৎ বীজগুলোকে প্রবাহমান পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। উক্ত ধোয়া বীজ ভিজা অবস্হায় সরাসরি জমিতে বপন করা চলে। অথবা ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামেও রাখা চলে।
সাবধানতাঃ সালফিউরিক এসিড শরীরের চামড়ায় বা কাপড়ে লাগলে তা পুড়ে যাবে। তাই সাবধানে এসিড নিয়ে কাজ করা উচিত।
(৪) আলোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
আলোর উপস্থিতি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুপস্হিতি বীজের অংকুরোদগমকে ত্বরান্বিত বা প্রতিরোধ করে। এসব ক্ষেত্রে আলো বীজের সুপ্ততা ভংগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। চিহ্নিত আলোর উপস্হিতি বীজের প্রকার, বয়স ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে তার সুপ্তাবস্হাকে ভেংগে দিতে যথেষ্ট সহায়তা করে। পরিপক্কতা লাভের পরপরই আলোর প্রতি বীজের সংবেদনশীলতা বেশি থাকে এবং গুদামজাত করার বয়সের সাথে তা কমতে থাকে।
(৫) গুদামজাতকরণের মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
অনেক বহুবর্ষজীবী লতাগুলোর বীজ বেশ কিছুদিন গুদামজাত না করা পর্যন্ত তাদের অংকুরোদগম হয়না। এই সুপ্ততা কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। স্বাভাবিক অবস্হায় বীজকে শুরুনাবস্হায় বেশ কিছুদিন ঘরে রাখা হয় এবং পরে বপন করার ফলে উক্ত সময়ের মধ্যে বীজের সুপ্ততা প্রাকৃতিকভাবেই ভেংগে যায়।
(৬) সরাসরি বপনের মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
অনেক জাতের বীজ, যেমন : জুনিপার ও ম্যাগনোলিয়ার প্রজাতি সমূহে পরিপক্কতা লাভের পর বীজ শুকিয়ে গেলে বীজাবরণ যথেষ্ট শক্ত হয় ও বীজে সুপ্ততা আসে। এ অবস্হায় উক্ত বীজসমূহকে না শুকিয়ে সরাসরি বপন করলেই সুপ্ততার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
(৭) বীজকে ঠান্ডায় রাখার মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
বহু প্রকার বৃক্ষ ও ঝোপ জাতীয় গাছের বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ঠান্ডা প্রয়োগ ফলপ্রসু হয়েছে। এই ঠান্ডাবেশ বীজে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় যার ফলে বীজের পরবর্তী পরিপক্কতা ত্বরান্বিত হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে ১°-১০° সেঃ তাপমাত্রা, পরিমিত পানি এবং অক্সিজেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখা হয়। প্রথমে বীজকে শুষ্ক অবস্হায় ১২-২৪ ঘন্টার জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় তারপর আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে এমন মাধ্যমে যেমন: বালি, পিট মাটি, করাতের গুঁড়া ইত্যাদির মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ২° –৭° সেঃ তাপমাত্রায় রাখা হয়।
এ পদ্ধতিতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে বীজের প্রকৃতির উপর। তবে অধিকাংশ বীজের জন্য ১-৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনবোধে উক্ত সময়ে মাঝে মাঝে পানি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয় এবং বীজে অংকুরোদগম হতে থাকে। তখনই বীজ বপন করা উচিত।
(৮) তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিনোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে বীজের সুপ্তাবস্হা পরিবর্তন করা সম্ভব। তাপমাত্রার পরিবর্তন দুইভাবে করা যায়ঃ
(ক) শুষ্ক অবস্হায় ও
(খ) ভিজা অবস্হায়।
(ক) শুষ্ক অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে বীজে শুষ্ক অবস্থায় তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটানো হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের পরিমাণ ১০-২০ সেঃ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। 0 যেমন : জনসন ঘাস এর বীজ ৩০° সেঃ তাপমাত্রায় ১৮-২২ ঘন্টা এবং পরে ৪৫ সেঃ তাপমাত্রায় ২-৮ ঘন্টা রেখে সুপ্ততা ভাংগানো সম্ভব হয়েছে।
(খ) ভিজা অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে ভিজা অবস্হায় তাপমাত্রার পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের সীমা অনেক বেশি। প্রথমে শক্ত আবরণ সম্পন্ন বীজকে তাদের প্রায় ৫ গুণ পানিতে ভিজিয়ে ৭৭° – ১০০° সেঃ তাপমাত্রায় কিছুক্ষণ রাখা হয়। তারপর আবার ঠান্ডা পানিতে ১২-২৪ ঘন্টা রাখা হয় এবং তারপর বীজকে সরাসরি বপন করা হয়।
(৯) চাপ প্রয়োগ এর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও বীজের সুপ্ততা ভংগ করা যায়। বীজ শুকানোর আগে এই চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং চাপের প্রভাব শুকানোর পর অথবা গুদামজাত করার দরুণ দূরীভূত হয়না। আলফা আলফা বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ১৮ সেঃ তাপমাত্রা ও ২০০ বায়ুচাপে বীজকে ৫-১০ মিনিট রেখে দেওয়া বেশ কার্যকরী।
(১০) রাসায়নিক উত্তেজক প্রয়োগ এর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উত্তেজক দ্বারা বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা সম্ভব হয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
(ক) পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্বারা বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
অনেক সদ্য আহরিত বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে চোষ কাগজ বসানো একটি পেট্রিডিসে নিয়ে ০.১ থেকে ০.২% দ্রবণ দ্বারা চোষ কাগজ ভিজিয়ে দেয়া হয়। দ্রবণ শুকিয়ে গেলে আর পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ না দিয়ে শুধু পানি দিতে হয়। এভাবে কিছুক্ষণ রাখার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয়।
(খ) সোডিয়াম হাইপো ক্লোরাইড দিয়ে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
ধান বীজের খোসায় পানিতে দ্রবণীয় যে অংকুরোদগম নিরোধক থাকে তা দূরীকরণের জন্য উপরোক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। ১০০ গ্যালন পানিতে ১ গ্যালন সোডিয়াম হাইপো ক্লোরাইড (১% দ্রবণ) মিশিয়ে এ কাজ করা হয়।
(গ) থায়ো ইউরিয়া দিয়ে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
যে সমস্ত বীজ অন্ধকারে ও উচ্চ তাপমাত্রায় গজায় না, তাদের সুপ্তাবস্হা ভাঙ্গার জন্য থায়ো ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে ০.৫–৩% দ্রবণে বীজ ভিজিয়ে রাখতে হয়। তবে ২৪ ঘন্টার বেশি বীজ ভিজিয়ে রাখা যাবে না, কারণ গাছের বৃদ্ধির উপর থায়ো ইউরিয়ার কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে।
(ঘ) জিবারেলিক এসিড দিয়ে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
বীজের সুপ্তাবস্হাজনিত অসুবিধা দূরীকরণে জিবারেলিক এসিড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি বীজ গজাতে, অংকুরোদগম হার বৃদ্ধি এবং চারা গাছের বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহৃত হয়। এমনকি বীজের এপিকোটাইল খাটোজনিত অসুবিধা দূরীকরণের জন্যও ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ১০০-৫০০ গ্রাম এসিড ১০০০ মিঃলিঃ পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করা হয়।
অনেক সময় শক্ত বীজাবরণ ভেংগে দিতে হয় অথবা খোসা খুলে নিতে হয় যাতে দ্রবণ সহজে প্রবেশ করতে পারে। এসিডের দ্রবণ বীজের বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্হার ওপর নির্ভরশীল।