কৃষির প্রাণ হলো বীজ। ভালো মানের বীজ ছাড়া উচ্চ ফলন, মানসম্পন্ন ফসল এবং কৃষির ধারাবাহিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বীজের গুণগত মান সরাসরি নির্ভর করে সঠিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কৌশলের ওপর।
ভালো বীজ ব্যবহার করলে উৎপাদন ১৫–২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তবে অনেক কৃষক এখনও নিম্নমানের বা অনুন্নত বীজ ব্যবহার করেন, ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পান না। তাই বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং স্থানীয় পর্যায়ে বীজ ব্যাংক গড়ে তোলা টেকসই কৃষি নিশ্চিতের অন্যতম প্রধান কৌশল।
Table of Contents
বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ

বীজ উৎপাদনের কৌশল
ফসলের ভালো ফলন পেতে হলে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের বিকল্প নেই। সাধারণ ফসল উৎপাদনের তুলনায় বীজ ফসল উৎপাদন পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। এজন্য বিশেষ পরিচর্যা ও যত্ন প্রয়োজন। এই বীজ থেকেই খাওয়ার জন্য ফসল উৎপাদন করা হয়।
বীজ ফসল উৎপাদনে কয়েকটি কৌশল অনুসরণ করতে হয়:
১. স্থান নির্বাচন
ভালো মানের বীজ উৎপাদনের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত যেখানে:
প্রচুর সূর্যালোক পাওয়া যায়,
মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়,
আবহাওয়া শুষ্ক ও ঠাণ্ডা থাকে,
পরাগায়নের সময় হালকা বাতাস প্রবাহিত হয়।
২. জমি নির্বাচন
উর্বর, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সমতল ভূমি বেছে নিতে হবে।
জমিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকবে এবং আগাছার প্রকোপ কম হবে।
একই জমিতে বারবার একই জাতের ফসল চাষ না করাই শ্রেয়।
বীজ সংগ্রহ
ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য সঠিক উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ অপরিহার্য। এজন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়:
অবশ্যই বীজ অনুমোদনকারী সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের জন্য ভিত্তি বীজ এবং ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য মৌল বীজ সংগ্রহ করা উচিত।
বীজের বস্তা বা প্যাকেটের ট্যাগ পরীক্ষা করতে হবে। সেখানে উল্লেখ থাকবে:
জাতের নাম
ব্যবহারের সময়সীমা
গজাবার ক্ষমতা
আর্দ্রতা
বীজ পরীক্ষার তারিখ
বীজ বপনের আগে এর গজানোর ক্ষমতা, বিশুদ্ধতা এবং জমির উর্বরতা বিবেচনা করতে হবে।
নির্দিষ্ট জমিতে প্রয়োজনীয় বীজের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।

জমি প্রস্ততকরণ :
১. জমি প্রস্তুতকরণ
বিভিন্ন জাতের বীজ ফসলের জন্য জমি ভিন্নভাবে তৈরি করতে হয়।
ধানের জমি (আউশ/আমন): শুকনো অবস্থায় ৪–৬ বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে।
রোপা ধান: জমিতে পানি ধরে কাদা করে প্রস্তুত করতে হয়।
২. বীজ বপনের সময় ও পদ্ধতি
নির্বাচিত বীজ সঠিক সময়ে সারিতে বা ছিটিয়ে বপন করতে হয়।
সারিতে বপন করলে এর সুবিধা:
আলো ও বাতাস সহজে পাওয়া যায়।
পরিচর্যা সহজ হয়।
বীজও কম লাগে।
বপনের গভীরতা নির্ভর করে:
বীজের আকার
মাটির বুনট
আর্দ্রতা
৩. স্বাতন্ত্রিকরণ বা পৃথকীকরণ দূরত্ব
অনাকাঙ্ক্ষিত সংমিশ্রণ রোধে বীজ ফসলের প্লটের চারপাশে নিরাপদ দূরত্ব রাখতে হবে।
ধানের ক্ষেত্রে:
ভিত্তি বীজ প্লট → ৯ মিটার দূরত্ব।
প্রত্যায়িত বীজ প্লট → ৫ মিটার দূরত্ব।
৪. বাছাইকরণ বা রোগিং
ভালো বীজ বপন করলেও অনেক সময় জমিতে অন্য জাতের গাছ জন্মায়। এসব গাছ ফেলে দিতে হয়। একেই রোগিং বলা হয়।
রোগিং সাধারণত তিন পর্যায়ে করা যায়:
১. গাছে ফুল আসার আগে।
২. ফুল আসার সময়।
৩. ফসল পরিপক্ক হওয়ার আগে।
এতে বীজের বিশুদ্ধতা ও গুণগত মান বজায় থাকে।
৫. পরিচর্যা
জমিতে প্রয়োজনমতো সার ও পানি সেচ দিতে হবে।
জলাবদ্ধতা দেখা দিলে অতিরিক্ত পানি বের করে নিতে হবে।
আগাছা হলে নিড়ানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দেখা দিলে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. বীজ সংগ্রহ
ফসল ভালোভাবে পরিপক্ক হওয়ার পর বীজ কাটতে হবে।
এরপর মাড়াই করে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে।
৭. প্রক্রিয়াজাতকরণ
মাড়াই শেষে বীজ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
এসময় বেছে নিতে হবে:
অন্য জাতের বীজ
অন্য ফসলের বীজ
আগাছার বীজ
খড়কুটা ও ভাঙা দানা
ঝাড়াই শেষে ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
৮. সংরক্ষণ
বীজ সংরক্ষণের সময় আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আর্দ্রতার মাত্রা:
৪%–১২% এর মধ্যে থাকলে বীজ দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
১২% এর বেশি হলে পোকা-মাকড় ও রোগবালাই আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ে।
৪% এর নিচে নেমে গেলে বীজের জীবনীশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
বীজ সংরক্ষণের নীতি :
বীজের গুণগত মান বজায় রাখা এবং দীর্ঘদিন ধরে সজীব রাখতে হলে কিছু মৌলিক নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন।
১. শুষ্ক ও ঠাণ্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ
বীজ রাখার জায়গা অবশ্যই শুষ্ক ও ঠাণ্ডা হতে হবে।
২. ভালোভাবে শুকানো
সংরক্ষণের আগে বীজ কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
পরে ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. বায়ুনিরোধক পাত্র ব্যবহার
সহজে সজীবতা হারায় না এমন উন্নতমানের বীজ
বায়ুনিরোধক ধাতব পাত্র বা পলিথিনের ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. পোকা ও রোগ প্রতিরোধ
বীজ রাখার জায়গা অবশ্যই পোকামাকড় ও রোগজীবাণুর আক্রমণমুক্ত হতে হবে।
৫. নিয়মিত পরীক্ষা
নির্দিষ্ট সময় পর পর বীজ পরীক্ষা করতে হবে।
প্রয়োজন হলে আবার শুকিয়ে নিতে হবে।
