ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমিকর্ষণের সময়

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমিকর্ষণের সময়

ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমিকর্ষণের সময়

 

ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমিকর্ষণের সময়

 

ভূমি কর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমি কর্ষণের সময়

সাফল্যজনকভাবে ফসল উৎপাদনের একটি অন্যতম পূর্ব শর্ত হলো ভূমি কর্ষণ। ভূমি কর্ষণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। জমির ভৌত অবস্থা, আর্দ্রতার পরিমাণ, কর্ষণের সময়, শ্রমিকের পর্যপ্ততা, ভূমির বন্ধুরতা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে ভূমি কর্ষণের ধরন নির্ধারণ করা হয়।
ভূমি কর্ষণকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয় যথা:

প্রাথমিক কর্ষণ (Primary tillage)

ফসল মাঠ থেকে সংগ্রহের পর ঐ মাঠে পরবর্তী ফসলের বীজ বোনা ও চারা রোপণের পূর্ব পর্যন্ত যে সমস্ত কর্ষণ কাজ করা হয় তাকে সাধারণ কর্ষণ/পূর্ব কর্ষণ বা প্রাথমিক কর্ষণ বলে। এ কর্ষণ কাজে মাটি বেশ ভালোভাবে তুলনামূলকভাবে বেশি গভীরতায় আলোড়িত হয়। এতে ব্যবহৃত লালসমূহ ভারি ও বড় আকারের হতে হয়। জমির আকার ছোট হওয়ার জন্য লাঙল ঘুরাতে অসুবিধা হলে বড় আকারের কোদাল দ্বারাও প্রাথমিক কর্ষণ কাজ করা যায়।

আন্ত:কর্ষণ/মাধ্যমিক কর্ষণ (Inter tillage)

এ কর্ষণ কাজ করা হয় বীজ বপন বা চারা রোপণের পর থেকে আরম্ভ করে ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত। জমির ঢেলা গুঁড়ো করা, আগাছা পরিষ্কার করা, আঁচড়া দেয়া, গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেয়া ইত্যাদি কাজকে আন্ত: কর্ষণ বলা হয়। ভূমি কর্ষণের পুরাতন ও নতুন ধারণার আলোকে দুটো কর্ষণ পদ্ধতির অবতারণা হয়েছে:

 প্রচলিত ভূমি কর্ষণ পদ্ধতি (Conventional tillage)

এ পদ্ধতিতে জমিকে বিভিন্ন রকম ভূমি কর্ষণ যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষ করা হয়। আমাদের দেশে এ পদ্ধতিই প্রচলিত।

রণশীল ভূমি কর্ষণ পদ্ধতি (Conservation tillage)

এ পদ্ধতিতে কর্ষণ সম্পন্ন করতে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ন্যূনতম লাঙল চাষ ও মই দেয়া হয়। এখানে রাসায়নিক উপায়ে বালাই দমনের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। আমাদের দেশে এ পদ্ধতির ব্যবহার একেবারেই কম। বিদেশে এ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতির সাহায্যে মাটিকে যথাসম্ভব কম আলোড়িত করে মাটির গঠনকে অণ্ণ রেখে চাষ করা হয়।

রণশীল ভূমি কর্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা

সুবিধা ( Advantages)

১. মাটির গঠন (Structure) উন্নত করে এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ।

২. জ্বালানি, শ্রমিক ও যন্ত্রপাতির খরচ বাঁচে।

৩. মাটির য়রোধ করে এবং প্রবহমান পানির (Run off water) গুণাগুণ বৃদ্ধি করে।

৪. মাটির কর্ষাবস্থা এবং মাটি হতে গাছের পানি উত্তোলন মতা সঠিক রাখে বা উন্নত করে।

৫. ফসলের ফলন প্রচলিত ভূমি কর্ষণের মতই হয়।

৬. মাটিতে অনুজীবের বৃদ্ধি ঘটিয়ে মাটির জৈবিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।

অসুবিধা (Disadvantage)

১. বিভিন্ন প্রকার অথবা বিশেষ ধরণের ভূমি কর্ষণ যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।

২. সাধারণত রাসায়নিকভাবে ফসলের বালাই দমনের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। রাসায়নিক আগাছা দমন পদ্ধতি অকার্যকর হলে আগাছার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে।

৩. প্রচলিত ভূমি কর্ষণের তুলনায় এ পদ্ধতিতে চুন, সার ও আগাছানাশক (Weedicide) মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায় না।

৪. নাইট্রোজেন ও সালফার জাতীয় সারের সহজলভ্যতা কমে যাওয়ায় বেশি সার প্রয়োগ করতে হয়।

৫. মাটির pH কমে যায়। ফলে বেশি জৈব পদার্থ ও চুন প্রয়োগ করতে হয় ।

৬. অনেক সময় ফসলের বপন ও রোপণ সময় পিছিয়ে যায়।

 

মাটির আর্দ্রতা ও ভূমি কর্ষণের সময়

জমি চাষবিহীন অবস্থায় থাকলে এর উপরিভাগ শক্ত থাকে। ফলে বৃষ্টির পানি সহজে মাটির ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না এবং বৃষ্টির পানি প্রবাহমান হয়ে গড়িয়ে যায়। ভূমি কর্ষণের মাধ্যমে জমির উপরিভাগের মাটি আলগা করা হয়। ফলে বৃষ্টির পানি মাটিতে প্রবেশ করে এবং আস্তে আস্তে মাটি এই পানি শোষণ করে নেয়। যথাযথভাবে ভূমি কর্ষণের ফলে মাটির দানাগুলো সুসংগঠিত হয়ে মাটির গঠন তৈরি করে এবং মাটির পানি ধারণমতা বৃদ্ধি পায়।

এই সুসংগঠিত মাটি যেমন পানি শোষন করে ধরে রাখতে পারে তেমনি দানার ফাঁকে ফাঁকে বায়ুও অবস্থান করতে পারে। ফসলের বৃদ্ধির জন্য মাটির এই আর্দ্রতা ও বায়ু উভয়েরই প্রয়োজন। মাটির আর্দ্রতা ও ভূমি কর্ষণের সময়- এ দুটি বিষয় সম্পর্কে কৃষকের সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন । জমির আর্দ্রতা অনুসারে ভূমি কর্ষণ করতে হয়। জমির সঠিক আর্দ্রতায় ভূমি কর্ষণ না করলে ভাল কর্ষাবস্থার সৃষ্ট হয় না।

জমি চাষ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটির আর্দ্রতাকে ‘জো’ অবস্থা বলা হয়। মাটির ‘জো’ অবস্থা বুঝে প্রথম চাষ দিতে হয়। একেই কৃষিবিদগণ ‘মাঠ মতা’ (Field capacity) বলেন। এটি এমন একটি অবস্থা যখন মাটির সুJ ফাঁকগুলো (Micropores) পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে এবং একটু বড় ফাঁকগুলো (Macropores) বাতাস দ্বারা পূর্ণ থাকে ।

সঠিকভাবে এক খন্ড জমির মাঠ মতা নির্ণয় করতে হলে মাঠটিকে পূর্ণ সেচ দিয়ে একটি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। মাটির বাষ্পীভবন রোধ করার জন্য মাঠটিকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তাতে মাটির সঠিক আর্দ্রতার পরিমাণ জানা সম্ভব। মুক্ত নিষ্কাশনের মাধ্যমে এ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশিত হয়ে যাবে। এই মুক্ত নিষ্কাশিত মাটিতে পানি ও বায়ু একটা সমতায় আসবে।

এ ছাড়াও কয়েক কেজি মাটিকে ভালভাবে ভিজিয়ে এক খন্ড কাপড় কিংবা বস্তায় ঝুলিয়ে রেখেও মাঠ মতা নির্ণয় করা সম্ভব। ভিজা মাটি এ রকম ঝুলিয়ে রাখলে অতিরিক্ত পানি ঝরে পরে যাবে এবং মাটির সুন ও বড় ফাঁকগুলো পানি ও বাতাস দ্বারা পূর্ণ হয়ে একটা সমতায় আসবে, যখন পানি আর ঝরে পরবে না। মাঠ পর্যায়ে চাষীরা হাতের অনুভূতির মাধ্যমে মাটির এই ‘মাঠ মতা’ বা ‘জো’ অবস্থা নির্ণয় করে থাকে।

এ পদ্ধতিতে এক মুঠি মাটি হাতে নিয়ে চাপ দেয়ার পর ছেড়ে দিলে যদি দেখা যায় তা চাপ খাওয়া আকৃতিতেই রয়েছে তাহলে এ মাটিকে ‘জো’ পরী ার পরবর্তী পদ েপে যেতে হবে। হাতের চাপে ঐ মাটি দিয়ে মাটির বল তৈরি করে ১ মিটার উঁচু থেকে সাধারণ শক্ত মাটির উপর আস্তে ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়ে দেবার সময় বল প্রয়োগ কিংবা ১ মিটারের কম বা বেশি হওয়া উচিত নয়।

তৈরি বলটি মাটিতে পতনের পর যদি দেখা যায় যে তা চাপ খাওয়া অবস্থায় রয়েছে তাহলে বুঝতে হবে মাটিতে কর্ষণ উপযোগী ‘জো’ আসে নাই। এ অবস্থায় জমি চাষ করলে লাঙলে মাটি আটকে যাবে, ফালির মাটি উল্টাবে না এবং কর্ষণের কাজে সময় বেশি নেবে। এ রকম অবস্থায় ভূমি কর্ষণে মাটির গঠন নষ্ট হয়ে যায়। আর যদি পতিত বলটি ভেঙ্গে ছড়িয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে মাটিতে ‘জো’ এসেছে।

 

ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি, মাটির আর্দ্রতা ও ভূমিকর্ষণের সময়

 

অভিজ্ঞ চাষীরা জমির মাটিকে এ রকম মুঠির মাধ্যমে বল তৈরির পরী । না করেও জমির উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েই বুঝতে পারে জমিতে ‘জো’ এসেছে কিনা ? ভিজা জমিতে কাদা চাষের (Puddling) জন্য মাটিতে ‘জো’ আসার প্রয়োজন নেই। যে কোন সময় কাদা করার জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। তাই আউশ ধান ও পাট ফসল কর্তনের পর ভিজা জমি প্রথম বার কর্ষণ করলে ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশে যায় এবং জৈব সারে পরিণত হয়।

Leave a Comment