আজকের পাঠের বিষয় — ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্য। ভেড়া বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গৃহপালিত প্রাণী, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভেড়া শুধু মাংস ও পশমের উৎসই নয়, বরং দরিদ্র কৃষকদের জীবিকায়নেও এটি একটি সহায়ক উপাদান। দেশের অনেক অঞ্চলে ভেড়া পালনকে এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আয়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
Table of Contents
এই পাঠ শেষে আপনি শিখতে পারবেন—
- উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে ছক আকারে ভেড়ার নামের তালিকা তৈরি করতে।
- ভারত ও পাকিস্তানের কয়েকটি ভেড়ার জাতের নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে।
- বাংলাদেশের দেশী ভেড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে।
- ছক আকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক গঠন ও গুণগত বৈশিষ্ট্য তুলনামূলকভাবে উপস্থাপন করতে।
ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্য
ভেড়ার জাত ও বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত আলোচনা
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের কারণে অসংখ্য ভেড়ার জাত গড়ে উঠেছে। প্রতিটি জাতের বৈশিষ্ট্য আলাদা — কেউ উল উৎপাদনে বিখ্যাত, কেউ মাংস উৎপাদনে, আবার কেউ বা উভয় ক্ষেত্রেই উপযোগী।
ভেড়ার শ্রেণিবিন্যাস
ভেড়ার জাতগুলোকে নিম্নলিখিত প্রধান ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করা যায় —
- উৎপাদনের ভিত্তিতে:
- মাংস উৎপাদনকারী জাত
- উল উৎপাদনকারী জাত
- দুধ উৎপাদনকারী জাত
- মিশ্র উৎপাদনকারী জাত (মাংস ও উল উভয়ই)
- মুখমণ্ডলের রঙ অনুযায়ী:
- সাদা মুখমণ্ডলযুক্ত জাত
- কালো মুখমণ্ডলযুক্ত জাত
- শিংয়ের উপস্থিতি অনুযায়ী:
- শিংযুক্ত জাত
- শিংবিহীন জাত
- লেজের গঠনের ভিত্তিতে:
- লম্বা লেজযুক্ত
- মোটা লেজযুক্ত
- খাটো লেজযুক্ত
- উলের গুণগত মানের ভিত্তিতে:
- সূক্ষ্ণ উল (Fine Wool)
- মাঝারি উল (Medium Wool)
- লম্বা উল (Long Wool)
- কার্পেট উল (Carpet Wool)
- ফার-টাইপ উল (Fur Type Wool)
- ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী:
- পাহাড়ি জাত
- সমতলভূমির জাত
- নিম্নভূমির জাত
বিশ্বব্যাপী উল উৎপাদনে ভেড়ার ভূমিকা
গৃহপালিত পশুর মধ্যে উল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভেড়াই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে উল উৎপাদনের জন্য প্রধান দেশগুলো হলো — অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এসব দেশের ভেড়া থেকে উচ্চমানের পশম সংগ্রহ করে শীতবস্ত্র, কার্পেট, কোট, সোয়েটার প্রভৃতি তৈরি করা হয়, যার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভেড়ার জাতসমূহ
ভারতীয় ভেড়ার জাত
ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে এখানকার ভেড়ার জাতও অঞ্চলের ভিত্তিতে বিভক্ত। সাধারণত চারটি অঞ্চলের ভেড়ার জাত উল্লেখযোগ্য —
হিমালয় অঞ্চলের জাত:
ওরেজ, কার্নাল, বাখরওয়াল, গাদি ইত্যাদি।
এরা ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম এবং সূক্ষ্ণ উল উৎপাদনে উপযোগী।
শুষ্ক পশ্চিমাঞ্চলীয় জাত:
লোহি, কাচ্চি, মারওয়ারি, চোকলা, নালি, কাথিওয়ারি ইত্যাদি।
এরা শুষ্ক ও মরু পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এবং মাংস ও উল উভয়ই উৎপাদন করে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় জাত:
সেলারি, মান্দা, দামাস্কাস, বেলোরি, সোনাদি ইত্যাদি।
এদের দেহ তুলনামূলক ছোট হলেও মাংস উৎপাদনে ভালো ফলন দেয়।
পূর্বাঞ্চলীয় জাত:
শাহবাদি।
এদের পশম মোটা ধরনের, যা মূলত কার্পেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তানি ভেড়ার জাত
পাকিস্তানে প্রায় ১৫টিরও বেশি ভেড়ার জাত রয়েছে। এরা প্রধানত কার্পেট উল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। গুরুত্বপূর্ণ জাতসমূহ হলো – ভাওয়ালপুরি, বিত্রিক, বলছি, দামানি, হর্নাই, হস্তানগরি, কাগনি, কাজলি, কোকা, লোহি, খাল, আফ্রিদি, ওয়াজিরি ইত্যাদি। এদের বেশিরভাগই শুষ্ক ও অর্ধ-মরু অঞ্চলের উপযোগী।
বাংলাদেশী ভেড়ার বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে পাওয়া ভেড়াগুলো মূলত দেশী বা অনুন্নত জাত।
এদের বিশেষ কোনো জাতভেদ নেই, তবে পরিবেশ অনুযায়ী কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় —
বিস্তার এলাকা
নোয়াখালীর চরাঞ্চল, সন্দীপ, ভোলার উপকূল, ঢাকা, টাঙ্গাইল, নওগাঁ, ও চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে এদের বেশি দেখা যায়।
দৈহিক বৈশিষ্ট্য
- গায়ের রঙ: সাদা, কালো, বাদামী বা মিশ্র।
- দেহের আকার: ছোট; চুট পর্যন্ত উচ্চতা প্রায় ৪৪ সেন্টিমিটার।
- বুকের বেড়: প্রায় ৬৫ সেন্টিমিটার।
- মাথা, ঠোঁট ও নাক: সোজা; কান খাটো; গলা চিকন; পিঠ সোজা।
- পশ্চাদভাগ: গড়নের দিক থেকে মোটামুটি উন্নত।
ওজন: পূর্ণবয়স্ক ভেড়া ২০–২৫ কেজি, ভেড়ী ১৫–১৮ কেজি।
গুণগত বৈশিষ্ট্য
- প্রধানত মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়।
- বছরে প্রায় ৫০০ গ্রাম মোটা উল পাওয়া যায়।
- দুধের উৎপাদন সীমিত, তবে এরা অত্যন্ত উর্বর।
- একেকটি ভেড়ী প্রায় ১৫ মাসে দু’বার বাচ্চা দেয়,
এবং প্রতিবারে সাধারণত ২টি করে বাচ্চা জন্ম দেয়।
পশমের ব্যবহার
এদের পশম মোটা হওয়ায় তা থেকে কম্বল, কার্পেট, মাফলার ইত্যাদি তৈরি করা যায়।
তবে সূক্ষ্ণ বস্ত্র তৈরির জন্য এটি উপযোগী নয়।
সারণি ১২ : উলের গুণাবলীর ওপর ভিত্তি করে ক্রেয়ার শ্রেণিবিন্যাস

ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভেড়ার জাতসমূহ
অঞ্চলভিত্তিতে ভারতীয় ভেড়াকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। য হিমালয় অঞ্চলের ভেড়া, যেমন- ওরেজ, কার্নাল, বাখরওয়াল, গাদি ইত্যাদি শুষ্ক পশ্চিমাঞ্চলীয় ভেড়া, যেমন- লোহি, কাচ্চি, মারওয়ারি, চোকলা, নালি, কাথিওয়ারি ইত্যাদি। দক্ষিণাঞ্চলীয় ভেড়া, যেমন- সেলারি, মান্দা, দামাস্কাস, বেলোরি, সোনাদি ইত্যাদি৷ পূর্বাঞ্চলীর ভেড়া, যেমন- শাহবাদি।
পাকিস্তানি জাতসমূহ
পাকিস্তানে ভেড়ার প্রায় ১৫টি জাত রয়েছে। এরা প্রধানত কার্পেট উল উৎপাদন করে। যেমন- ভাওয়ালপুরি, বিত্রিক, বলছি, দামানি, হর্নাই, হস্তানগরি, কাগনি, কাজলি, কোকা, লোহি, খাল, আফ্রিদি, ওয়াজিরি ইত্যাদি।
বাংলাদেশী ভেড়া
বাংলাদেশী ভেড়া অনুন্নত এবং দেশী ভেড়া হিসেবে পরিচিত। এদের নির্দিষ্ট বা স্থায়ী কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এদেরকে অধিক সংখ্যায় নোয়াখালীর চরাঞ্চলের ভূমি, সন্দীপ, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চাপাইনবাবগঞ্জ নওগা প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা যায়।
দৈহিক বৈশিষ্ট্য
এদের গায়ের রঙ সাদা, কালো, বাদামি বা মিশ্র হয়ে থাকে। এরা আকারে ছোট, চুট পর্যন্ত উচ্চতা ৪৪ সে.মি। বুকের বেড় প্রায় ৬৫ সে.মি। মাথা, ঠোঁট, নাক সোজা; কান খাটো, গলা চিকন, পিঠ সোজা, পশ্চাদভাগ মোটামুটি গড়নের ও উন্নত। ভেড়া ও ভেড়ার ওজন যথাক্রমে ২০-২৫ ও ১৫- ১৮ কেজি।
গুণগত বৈশিষ্ট্য
এদেরকে প্রধানত মাংসের জন্য পালন করা হয়। বছরে গড়ে প্রায় ৫০০ গ্রাম মোটা পশম (উল) পাওয়া যায়। সামান্য পরিমাণ দুধও দেয়। কিন্তু এরা খুবই উর্বর ও ঘন ঘন বাচ্চা দেয়। ভেড়ী প্রতি ১৫ মাসে অন্তত দু’বার বাচ্চা দিয়ে থাকে। প্রতিবারে ২টি করে বাচ্চা দেয়।
এদের পশম দিয়ে মোটা কম্বল, কার্পেট, মাফলার ইত্যাদি তৈরি করা যায়। কার্পেট তৈরির জন্য এই পশম খুবই ভালো। তবে, পরিধেয় বস্ত্র তৈরির জন্য এটা খুবই নিম্নমানের। এখানে সারণি ১৩-এর মাধ্যমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করা হয়েছে।
সারণি ১৩ : কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য



সারণি : কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতের ভেড়ার উৎপত্তি, দৈহিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য
| ক্র. | ভেড়ার নাম | উৎপত্তি | বৈশিষ্ট্য |
|---|---|---|---|
| ১ | মেরিনো | স্পেন | সূক্ষ্ম উল, পোশাক তৈরির জন্য উপযোগী |
| ২ | লোহি | পাকিস্তান | মাংস ও উল উৎপাদনে উপযোগী |
| ৩ | বাখরওয়াল | হিমালয় অঞ্চল | ঠান্ডা সহনশীল, মোটা উল |
| ৪ | ডরসেট | ইংল্যান্ড | সাদা মুখমণ্ডল, মাংস উৎপাদন |
| ৫ | দেশী ভেড়া | বাংলাদেশ | ছোট আকার, রোগপ্রতিরোধী, মাংস ও পশম উৎপাদন |
ভেড়া বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিসম্পদ। দেশীয় ভেড়াগুলো আকারে ছোট হলেও, তাদের অভিযোজন ক্ষমতা ও প্রজনন হার অত্যন্ত ভালো। আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত খাদ্য ও সঠিক প্রজনন ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে এই জাতগুলোকে আরও উন্নত করা সম্ভব। ফলে বাংলাদেশের ভেড়া উৎপাদন শুধু স্থানীয় চাহিদা মেটানোই নয়, ভবিষ্যতে বৈদেশিক বাজারেও সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
