মহিষের রোগব্যাধি দমন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- মহিষের রোগব্যাধি দমন। মহিষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গরুর তুলনায় বেশি। তবে, একবার রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে মৃত্যুর সম্ভাবনা গরুর তুলনায় বেশি থাকে। মহিষের রোগব্যাধি দমনের জন্য সব সময় একই ব্যবস্থাদি প্রযোজ্য হয় না। বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দমনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো কোনো রোগের জন্য টিকার ব্যবস্থা আছে। এসব টিকা রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো রুটিনমাফিক প্রয়োগ করতে হবে।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • মহিষের রোগব্যাধি দমনের বিভিন্ন কার্যক্রমগুলো সঠিকভাবে বলতে পারবেন।
  • মহিষের গুরুত্বপূর্ণ রোগগুলোর নাম লিখতে ও বলতে পারবেন।
  • গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রোগের প্রতিকার বর্ণনা করতে পারবেন।

 

মহিষের বিভিন্ন রোগব্যাধি দমনের জন্য জাতীয়ভিত্তিক কার্যক্রমই বেশি ফলপ্রসু হয়ে থাকে। তবে, প্রত্যেক খামারী বা মহিষ পালকদের নিজেদের খামারে রোগব্যাধি দমনের কার্যাবলীগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন করতে হবে। সঠিক সময়ে টিকা প্রদান, কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করানো, জীবাণুমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি এসব কার্যক্রমের অন্যতম।

 

মেশানা জাতের মহিষ
মেশানা জাতের মহিষ

 

মহিষের রোগব্যাধি দমন

 

মহিষের রোগব্যাধি দমনের জন্য সাধারণভাবে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। যেমন:-

  • পশুস্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপযুক্ত আইনকানুন প্রণয়ন ও বাস্তবক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ ।
  • পশুস্বাস্থ্য ও পশুরোগের সুষ্ঠু ও বাস্তবধর্মী গবেষণার ব্যবস্থা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল বাস্তবে প্রয়োগ ।
  • উপযুক্ত রোগনির্ণয় প্রক্রিয়া গ্রহণ করা ও সমগ্র দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যায় বিভিন্ন মানের রোগনির্ণয় পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা।
  • রোগ চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ।
  • রোগব্যাধি সংক্রান্ত সংবাদ দ্রুত আদানপ্রদান ও যোগাযোগ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
  • নিয়মিত টিকা ও সিরাম সরবরাহকরণ ।
  • জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা করণার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রচেষ্টা।
  • শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে রোগব্যাধি সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা।
  • আমদানিকৃত পশু ও নতুন পশুদের পরীক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত সঙ্গনিরোধ (quarantine) পদ্ধতি গ্রহণ করা।
  • পশুপালন এলাকাতে এককভাবে অথবা পার্শ্ববর্তী এলাকার খামারির সঙ্গে যৌথভাবে রোগ নিবারণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রতিষেধক টিকা ব্যবহার করা। রোগাক্রান্ত এলাকার থেকে কোনো পশু বা পশুপাখিজাত দ্রব্য ভালো এলাকায় অনুপ্রবেশ না ঘটানো। রোগজীবাণু বহনকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা।

 

জাফরাবাদি মহিষ
জাফরাবাদি মহিষ

 

 

মহিষের গুরুত্বপূর্ণ রোগ ও প্রতিকার

মহিষ গরু, ছাগল বা ভেড়ার ন্যায় জীবাণুঘটিত, পরজীবীঘটিত, অপুষ্টিজনিত, বিপাকীয় ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত গরু যেসব রোগে আক্রান্ত হয় মহিষও সেসব রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে গোবসন্ত, খুরা রোগ, গলাফোলা, বাদলা, তড়কা, ব্রুসেলোসিস, অ্যাকেরিয়াসিস, কিটোসিস, দুধত্বর, ম্যাস্টাইটিস, ফ্যাসিওলিয়াসিস, অন্যান্য কৃমিঘটিত রোগ প্রভৃতিই প্রধান। এখানে দুএকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

 

মহিষের গলাফোলা রোগ (Haemorrhagic Septicemia)

এটি এক ধরনের সংক্রামক রোগ। পাচুরেলা মালটুসিডা (Pasteurella multocida) নামক এক ধরনের ব্যকটেরিয়া এই রোগের জন্য দায়ী। কম বয়সের মহিষ এতে বেশি আক্রান্ত হয়। গ্রীষ্মের শেষ থেকে সমগ্র বর্ষাকালব্যাপী এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। নিম্ন জলাভূমি, নদী বা খালবেষ্টিত ও উপকূলীয় অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।

মহিষের গলাফোলা রোগের লক্ষণ:

অতি তীব্র প্রকৃতির রোগের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই মহিষ মারা যায়। গদ্য আক্রান্ত মহিষে সাধারণত ক্ষুধামান্দ্য, নাসারন্ধ্র থেকে শ্লেষ্মা বের হওয়া, গলা ফুলে যাওয়া, উচ্চ দৈহিক তাপমাত্রা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা যায়।

মহিষের গলাফোলা রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ :

আক্রান্ত মহিষকে সালফাজাতীয় ওষুধ, যেমন- সালফাপাইরাজল অথবা অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন- অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। রোগপ্রতিরোধের জন্য ৬ মাস অন্তর টিকা প্রয়োগ করতে হবে।

 

মহিষের বাদলা রোগ (Black quarter)

এই সংক্রামক রোগটি সাধারণত বর্ষার শেষে দেখা দেয়। ক্লস্ট্রিডিয়াম চৌভিয়াই (Clostridium chanrvaei) নামক ব্যাকটেরিয়া এ রোগের কারণ। অল্পবয়স্ক মহিষ এতে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু হার ৯০-৯৫% পর্যন্ত হতে পারে।

মহিষের বাদলা রোগের লক্ষণ :

পা ফুলে যায় ও হাটতে বেশ কষ্ট হয়। দেহের তাপমাত্রা ১০৩°-১০৬° সে. পর্যন্ত ওঠে। ফোলা স্থানে চাপ দিলে পচ্‌ পচ্‌ বা বজ্‌ বজ্ৰ শব্দ হয়। আক্রান্ত মহিষ দিন দুএকের মধ্যেই মারা যেতে পারে। অতি তীব্র প্রকৃতির ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই মারা যেতে পারে।

মহিষের বাদলা রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:

ও চিকিৎসার জন্য পেনিসিলিন বা অক্সিটেট্রাসাইক্লিনজাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়। প্রতিরোধের জন্য বাছুরের ৬ মাস বয়স থেকে প্রতি ৬ মাস অন্তর টিকা প্রয়োগ করতে হবে।

 

মহিষের সংক্রামক গর্ভপাত বা ব্রুসেলোসিস রোগ (Brucellosis)

মহিষের প্রজনন ব্যহতকারী সংক্রামক রোগের মধ্যে ব্রুসেলোসিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সব দেশেই এটি দেখা যায় । ব্রুসেলা অ্যাবোরটাস (Brucella abortus) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।

মহিষের সংক্রামক গর্ভপাত বা ব্রুসেলোসিস রোগের লক্ষণ :

গর্ভপাত এবং ভ্রণাবরণ নির্গমনে ব্যাঘাত ও অনুর্বরতা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। সাধারণত গর্ভকালের ৫-৭ মাসের মাথায় গর্ভপাত হয়। জীবাণু আক্রমণের ফলে জরায়ুর অন্তরাবরণিকার প্রদাহ সৃষ্টি হয়, ফলে গর্ভপাতের পর জরায়ু সংকোচনে বিলম্ব ঘটে এবং কয়েক মাস পর্যন্ত পুঁজযুক্ত স্রাব নিঃসৃত হয়। গর্ভপাতের পর অধিকাংশ মহিষ গাভী বহুদিন পর্যন্ত অনুর্বর থাকে।

মহিষের সংক্রামক গর্ভপাত বা ব্রুসেলোসিস রোগের চিকিৎসা:

ব্রুসেলোসিস রোগের চিকিৎসা বর্তমানে সাধারণত করা হয় না। কিন্তু সালফাডায়াজিন ও অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক উক্ত জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম। মহিষের বিভিন্ন রোগব্যাধি দমনের জন্য স্থানীয় ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো সময়ে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের টিকা প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া বছরে অন্তত দুবার এদেরকে কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করাতে হবে। সর্বোপরি এদের বাসস্থান ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে।

 

Leave a Comment