আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাছের পুকুর – যা মাছের আবাসস্থল এর অন্তর্ভুক্ত ।
Table of Contents
মাছের পুকুর
মাছ চাষের ক্ষেত্র হিসেবে পুকুরের গুরুত্ব অপরিসীম। পুকুর হচ্ছে চাষ যোগ্য মাছের আবাসস্থান যা সাধারণভাবে ছোট, অগভীর ও বন্ধ একটি জলাশয়। পুকুরের আয়তন কয়েক শতাংশ থেকে কয়েক একর পর্যন্ত হতে পারে। তবে মাছের চাষ উপযোগী মাটি ও পানির ভৌত গুণাগুণ সম্পন্ন ছোট ও মাঝারি আকারের
পুকুর মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত।
১ا আদর্শ পুকুর হবে আয়তাকার। আয়তন ২০-২৫ শতাংশ হলে তা পুকুর ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত ।
২। পুকুর বন্যামুক্ত হতে হবে।
৩। পুকুরের স্থান এমন হতে হবে যা সহজে পানি নিষ্কাশন যোগ্য।
৪। পুকুরের মাটি হবে দোআঁশ, পলি দোআঁশ বা এটেল দোআঁশ।
৫। পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫-২.০ মিটার হলে ভালো।
৬। সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর মাছ চাষের জন্য অধিকতর সুবিধাজনক।
৭। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের জন্য পুকুরটি খোলা মেলা স্থানে হলে ভালো।
৮। আদর্শ পুকুর উত্তর-দক্ষিন মূখী হতে হবে যাতে সূর্যালোক বেশি পড়ে ।
৯। পুকুরের তলায় কাদার পুরুত্ব ২০-২৫ সে.মি এর বেশি হওয়া ঠিক নয়। অন্যথায় এতে পচন ক্রিয়ার পানিতে প্রচুর দূষিত গ্যাস উৎপাদিত হয়।
১০। পুকুরের পাড়গুলো ১:২ হারে ঢালু হলে সবচেয়ে ভালো।
১১। আদর্শ পুকুরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ পরিমিত হতে হবে।
মাছ চাষের পুকুরের পানির গুণাগুণ:
পুকুরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ মাছের জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করে। মাছের খাদ্য গ্রহণ, দৈহিক বৃদ্ধি, প্রজনন, বেঁচে থাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিপাকীয় কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা প্রয়োজন। পুকুরের পানির গুণাগুণকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক। ভৌত গুণাগুণ এবং খ। রাসায়নিক গুণাগুণ
ক. ভৌত গুণাগুণ
১। পুকুরের গভীরতা :
খুব বেশি অগভীর পুকুরে উদ্ভিদ জন্মায়। অন্য দিকে পুকুরের পানি গ্রীষ্মকালে খুব তাড়াতাড়ি গরম হয়ে যায় ফলে মাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার পুকুরের গভীরতা খুব বেশি হলে গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাঙ্কটন তৈরি হয় না এবং সেখানে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়।
২। তাপমাত্রা
পুকুরের তাপমাত্রা কমে গেলে মাছ খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয় ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং মাছের উৎপাদন হ্রাস পায়। আবার তাপমাত্রা অধিক হলেও মাছের ক্ষতি হয়।
৩। ঘোলাত্ব
একটি ভালো পুকুরের পানি প্লাঙ্কটনের উপস্থিতি বা প্রাচুর্যতার জন্য অস্বচ্ছ হবে কিন্তু কাঁদার জন্য অস্বচ্ছ বা ঘোলা হবে না । কাদা কনার কারণে পুকুরের পানি ঘোলা হলে পানিতে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা পায়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক
খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৪। আলো
যে পুকুরের পানিতে সূর্যালোক বেশি পড়ে সেখানে সালোক সংশ্লেষণ ভালো হয় এবং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সে জন্য পুকুর এমন জায়গায় হওয়া উচিত যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকে। অনেক সময় কচুরি পানা দ্বারা পুকুরের পানির উপরিভাগ আবৃত থেকে আলো প্রবেশ বন্ধ করে নেয়। এরূপ পুকুরে মাছের উৎপাদন অনেক কমে যায়।
খ. রাসায়নিক গুণাগুণ
১। দ্রবীভূত অক্সিজেন
পুকুরের পানিতে দুইভাবে অক্সিজেন দ্রবীভূত হতে পারে পানির উপরিভাগে সরাসরি বায়ুমণ্ডল থেকে এবং পুকুরের জলজ উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে। ফাইটো প্লাঙ্কটনের সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমেই সিংহভাগ অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত হয় ।
দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান কমে গেলে মাছ শ্বাস কষ্টে মারা যায়। অতিরিক্তি ফাইটোপ্লাঙ্কটন আছে একপ পুকুরে মেঘলা দিনে এবং রাত্রে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। ফাইটোপ্লাঙ্কটন বা প্রাথমিক উৎপাদকের শ্বসন কার্য সম্পন্ন করার জন্য ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন রয়েছে। পুকুরে পানির অক্সিজেনের ঘনত্ব ৫ পি.পি.এম বা এর বেশি থাকা ভালো।
২। দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড:
পুকুরের পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত থাকে। সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য ফাইটোপ্লাঙ্কটন উৎপাদন হিসেবে কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। সেজন্যই ফাইটোপ্লাঙ্কটনের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমান দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড পুকুরের পানিতে থাকা আবশ্যক। তবে অত্যধিক মাত্রায় দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড ও ফাইটোপ্লাঙ্কটন মাছের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ৬ পি.পি.এম এর বেশি হলে পানির অম্লতা বৃদ্ধি পায়।
৩। অ্যালক্যালিনিটি:
পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত ক্ষারীয় খনিজ সমূহের মোট ঘনত্বই হচ্ছে অ্যালক্যালিনিটি। সাধারণভাবে অ্যালকালাইন পানি প্রশম বা অম্লীয় পানির চেয়ে অধিক উৎপাদনশীল। মোট উৎপাদনের একটি বড় অংশ ফসফরাসের উপস্থিতির জন্য হয় । ফসফরাস ফাইটোপ্লাঙ্কটন বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৪। পানির pH
পানির pH মাত্রা জানার মাধ্যমে একটি পুকুরের মাছ চাষোপযোগী কি-না তা নিরূপন করা যায়। মাছ চাষে পুকুরের পানির pH ৬.৫-৮.৫ এর মধ্যে হলে ভালো।
পুকুরের প্রকারভেদ
মাছ চাষের পুকুরকে পুকুরের আয়তন, পানি ধারণ ক্ষমতা পানির স্থায়িত্ব এবং বিভিন্ন আকারের মাছ প্রতিপালনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। নিম্নে পুকুরের উল্লেখযোগ্য শ্রেণি বিভাগ আলোচনা করা হলো:
১। পানির স্থায়িত্বের উপর ভিত্তি করে পুকুরের শ্রেণি বিন্যাস :
ক. স্থায়ী পুকুর এবং খ. অস্থায়ী পুকুর
ক. স্থায়ী পুকুর
এ ধরনের পুকুর অধিকতর গভীর হয় এবং এতে সারা বছর পানি থাকে। এদের মাটি সবসময় পানি ধরে রাখতে পারে।
খ. অস্থায়ী বা মৌসুমী পুকুর
এ ধরনের পুকুর অগভীর এবং বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় (৩-৮ মাস) পানি থাকে । বেলে মাটির পুকুর সাধারণত অস্থায়ী হয় ফলে পানি বেশি দিন ধরে রাখতে পারে না।
২। আকারের উপর ভিত্তি করে শ্রেণি বিন্যাস:
বিভিন্ন আকারের মাছ প্রতি পালনের জন্য ৩ ধরনের পুকুরের প্রয়োজন হয় । ক. আঁতুড় পুকুর: যে পুকুরে রেণু পোনা ছেড়ে ধানী পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাদেরকে আঁতুড় পুকুর বলে । সাধারণভাবে এ ধরনের পুকুরের আয়তন ১০-১৭ শতাংশ পর্যন্ত হয় ।
খ. লালন পুকুর
যে পুকুরে ধানী পোনা ছেড়ে চারা পোনা বা আঙ্গুলে পোনা তৈরি করা হয় তাকে লালন পুকুর বলে। লালন পুকুরের আয়তন ২০-১০০ শতাংশ এবং গভীরতা ১.৫-২.০ মিটার হয়ে থাকে ।
গ. মজুদ পুকুর :
যে পুকুরে ধানী বা আঙ্গুলে পোনা ছেড়ে বড় মাছে পরিণত করা হয় তাকে মজুদ পুকুর বলে। এ ধরনের পুকুরের আয়তন ৩০ শতাংশের উপরে এবং গভীরতা ২-৩ মিটার হয়। মাছ চাষের জন্য এ ধরনের পুকুরই প্রধান পুকুর হিসেবে পরিচিত।
পুকুরের বিভিন্ন স্তর
পুকুরের পানির গভীরতার স্তর পুকুরের ভৌত গুণাবলীকে প্রভাবিত করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পানির বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে এবং সেখান থেকে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। পুকুরের পানির স্তরকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-ক. উপরের স্তর, খ. মাঝের স্তর এবং গ. নিচের স্তর।
ক) উপরের স্তর:
পুকুরের উপরের স্তরে অক্সিজেন বেশি পরিমান থাকায় মাছের খাদ্য ফাইটোপ্লাঙ্কটন এই স্তরে বেশি থাকে। কাতলা, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প এবং সরপুটি উপরের স্তরের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।
খ) মাঝের স্তর
এই স্তরে দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং তাপমাত্রার পরিমান উপরের স্তরের চেয়ে কম থাকে। এই স্তরে জুপ্লাঙ্কটন থাকে তবে ফাইটোপ্লাঙ্কটনও থাকতে পারে । রুই মাছ মাঝের স্তরে থাকে এবং খাদ্য গ্রহণ করে।
গ) নিচের স্তর
এই স্তরে তাপমাত্রা এবং দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান সবচেয়ে কম থাকে। এই স্তরে জু-প্লাঙ্কটন কীটপতঙ্গের লার্ভা, জৈব আবর্জনা, কেঁচো, শামুক ঝিনুক থাকে এবং খাদ্য গ্রহণ করে। এছাড়া কিছু মাছ আছে যারা পুকুরের সকল স্তরেই বিচরণ করে। যেমন- তেলাপিয়া ।
সারসংক্ষেপ
পুকুর হচ্ছে চাষযোগ্য মাছের আবাস স্থান যা সাধারণভাবে ছোট, অগভীর ও বন্ধ একটি জলাশয়। লাভজনকভাবে মাছ চাষের জন্য আদর্শ পুকুরের কোনো বিকল্প নেই। পুকুরের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ মাছের জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করে।
পুকুরের ভৌত গুণাগুণগুলো হলো- পুকুরের পানির গভীরতা, তাপমাত্রা, ঘোলাত্বও আলো, আকারের ওপর ভিত্তি করে পুকুর তিন ধরনের যেমন- আতুড় পুকুর, লালন পুকুর, মজুদ পুকুর। পুকুরের পানির স্তর তিন ধরনের যথা- উপরের মাঝের ও নিচের স্তর।