মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ

মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের, ৫ নং ইউনিটের ৫.১ নং পাঠ।

 

Table of Contents

মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ

মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৫ , পাঠ -৫,১

 

মাছ পঁচন:

মাছ পচণের কারণ বিভিন্ন কারণে মাছের পচনক্রিয়া শুরু হয়। তবে মাছের পচনক্রিয়া প্রধানত তিনটি উৎস হতে শুরু হয়। নিচে মাছ পচনের প্রধান তিনটি কারণ আলোচনা করা হলো—

১. মাছের দেহের অভ্যন্তরের এনজাইমের ক্রিয়া :

মাছের দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম বিদ্যমান। এসব এনজাইম জীবিত অবস্থায় মাছের উপকারে আসে, পক্ষান্তরে মাছ মরে গেলে এগুলো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবিত অবস্থায় মাছ তাদের খাদ্য হজম ও দেহ কোষ গঠনের জন্য এসব এনজাইমকে ব্যবহার করে। মাছ মারা যাওয়ার পর এসব এনজাইম তাদের দেহে বিদ্যমান থাকায় তাদের ক্রিয়ার ফলে মৃত মাছের কোষ—কলা ভেঙ্গে যায় ও মাছ পচতে শুরু করে। মাছের দেহভাঙ্গনের এনজাইমের এই ক্রিয়াকে অটোলাইসিস বলে। অটোলাইসিস ক্রিয়ার কারণেই মাছের স্বাদ নষ্ট হয়, পেশী নরম হয়, চোখ গর্তের মধ্যে চলে যায় এবং দেহ বিবর্ণ হয়।

 

২. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীবের ক্রিয়া – বিক্রিয়া :

মাছের দেহের বিভিন্ন অংশ যথা— আইশ, চামড়া, ফুলকা নাড়ীভুড়ি ইত্যাদিতে অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া থাকে। জীবিত অবস্থায় এসব জীবাণু মাছের কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু মাছ মরার পর আমাদের চারপাশের পরিবেশে বিদ্যমান জীবাণু এবং মাছের পরিচর্যার সময়, মানুষের হাত, পরিবহণে ব্যবহৃত পাত্র থেকে জীবাণু মাছকে সংক্রমিত করতে পারে। মাছ মরার পর মাছের বিভিন্ন অংশের জীবাণু এবং পরিবেশ ও ব্যবহৃত পাত্রের জীবাণু মাছের দেহে এনজাইম নিঃসরণ করে মাছের মাংসপেশী নরম করে ফলে দ্রুত মাছের পঁচন ক্রিয়া শুরু হয়।

 

৩. বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয় :

মাছের দেহ নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা গঠিত। তন্মেধ্যে আমিষ, স্নেহ বা চর্বি প্রধান। মাছের দেহে শতকরা ৭০—৮০ ভাগ পানি থাকে। তাছাড়া মাছের চর্বিতে থাকে প্রচুর পরিমাণ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডসমূহ। মাছ মরে যাওয়ার পর এসব অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড অক্সিজেন সাথে বিক্রিয়া করে। মাছের দেহের রাসায়নিক পদার্থসমূহে এ ধরনের ক্রিয়া, বিক্রিয়ার ফলে মাছের জীবকোষ ভেঙে যায় এবং মাছ পচতে শুরু করে।

মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৫ , পাঠ -৫,১

মাছ সংরক্ষণ মাছ পচনশীল দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম। মাছের পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্যে এবং পচন রোধ করার লক্ষ্যে মাছ আহরণের পর থেকেই সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয়। মাছ ধরার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পরে মাছ মরে যাওয়ার পর পঁচতে শুরু করে। মাছ মরে যাওয়ার পর থেকেই পচনক্রিয়া শুরু হয় বিধায় ক্রেতাদের নিকট পেঁাছানোর পূর্ব পর্যন্ত এদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সংরক্ষণের কোন ত্রুটি বা অবহেলা হলে মাছ পঁচতে শুরু করে। মাছ একবার পঁচে গেলে কোনভাবেই আর তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না।

সাধারণত অণুজীবের ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন এনজাইমের ক্রিয়া ও বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে মাছের পচন হয়। মাছ সংরক্ষণ বলতে এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝায় যে পদ্ধতিতে মাছের গুণগত মান ঠিকা রাখা যায়। মাছ সংরক্ষণের জন্যে কতগুলো মূলনীতি অনুসরণ করা হয় সেগুলো হলো অণুজীব থেকে মাছকে দূরে রাখা, অণুজীবের বৃদ্ধি ও কার্যকলাপকে বিঘ্নিত করা, মাছ থেকে পানি অপসারণ করা এবং অণজীবকে ধ্বংস করা।

চিংড়ি সংরক্ষণ মৎস্য জাতীয় প্রাণি দ্রুত পচনশীল। সে হিসেবে চিংড়িও পঁচনশীল। এ পঁচনক্রিয়া চিংড়ি আহরণ করার পর থেকেই শুরু হয়। তাই চিংড়ি আহরণের পর যত দ্রুত সম্ভব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। সঠিক নিয়মে সঠিকসময়ে চিংড়ি সংরক্ষণ না করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিংড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলের আধা লবণাক্ত জলাশয়ের ঘেরসমূহে প্রচুর হরিণা, চালি, সাদা চিংড়ি ও গুড়া চিংড়ি ধরা পড়ে। রপ্তানিযোগ্য বড় আকারের চিংড়িগুলো বেশি দামে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিক্রি হয়ে যায়।

কিন্তু ছোট আকারের চিংড়িগুলোর হিমায়িত প্রক্রিয়াজাতকরণ লাভজনক হয় না বিধায় এদের দামও কম হয়ে থাকে। যেহেতু নির্দিষ্ট মৌসুমেই চিংড়ি ধরা হয় তাই এদের পচন রোধ করে দেশে বা বিদেশের বাজারে ক্রেতাদের নিকট পৌছানোর জন্য চিংড়ি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। চিংড়ি সংরক্ষণ হলো এমন একটি বিশেষ কৌশল যার মাধ্যমে চিংড়ির গুণগত মান ঠিক রেখে ক্রেতা বা ভোক্তার নিকট পৌছানো হয়।

চিংড়ি যথাযথ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে এদেশের হাজার হাজার টন চিংড়িকে পচন থেকে রক্ষা করা সম্ভব। বাংলাদেশে চিংড়ি আহরণের পর কাঠের বা বাঁশের তৈরি ঝুঁড়িতে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। আবার কখনো কখনো বরফ সহকারে চাটাই বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

 

 

মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি :

মাছ বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায়। সকল পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হল মাছের গুণগত মান ঠিক রাখা। বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণের কারণে সংরক্ষিত মাছে গন্ধ, বর্ণ, স্বাদ, ও বাহ্যিক গঠনে কিছুটা পরিবর্তন হয়।

মাছ সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর নাম নিম্নে দেওয়া হলো :

ক. বরফজাতকরণ বা আইসিং ।

খ. লবণজাতকরণ বা সল্টিং ।

গ. শুটকিকরণ বা ড্রাইং ।

ঘ. হিমায়িতকরণ বা ফ্রিজিং।

ঙ. টিনজাতকরণ বা ক্যানিং।

চ. ধূমায়িতকরণ বা স্মোকিং ।

 

ক. বরফজাতকরণ বা আইসিং :

বরফের সাহায্যে মাছ সংরক্ষণকে বরফজাতকরণ বলে। এটি মাছ সংরক্ষণের একটি স্বল্পকালীন পদ্ধতি। বরফ দিয়ে মাছের দেহের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস (০ঈ) বা এর কাছাকাছি এনে অণুজীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ব্যহত করা ও বংশ বিস্তারে বাধাগ্রস্ত করে মাছ সংরক্ষণকে বরফজাতকরণ বলা হয়। বাংলাদেশে মাছ সংরক্ষণের জন্য ব্লক আইস বেশি ব্যবহৃত হয়।

বরফজাতকরণের সুবিধা : বরফের সাহায্যে মাছ সংরক্ষণের অনেক সুবিধা রয়েছে। যথা :

১. যেকোন মৌসুমে মাছ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব।

২. মাছ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় সহজ।

৩. আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে বরফ সহজলভ্য।

৪. যেকোন আকারের মাছ এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায়।

৫. বরফ ক্ষতিকর নয় এবং মাছের সংস্পর্শে এসে খুব দ্রুত মাছকে ঠাণ্ডা করে মাছে পঁচন রোধ করে। ৬. বরফ দ্বারা সংরক্ষিত মাছ সহজেই পরিবহণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণের প্রচলিত পদ্ধতি : এদেশে বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণের প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রথমে মাছকে সাধারণ পানি দ্বারা ধুয়ে নেয়া হয়। অতঃপর বাঁশের চাটাই বা মাদুরের তৈরি টুকরীতে বরফ ও মাছ স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা হয়। সাধারণত ৪ ভাগ মাছের সাথে এক ভাগ বরফ দেয়া হয়। সাধারণত পরিবহন দূরত্ব ও সময়ে ওপর ভিত্তি করেবরফের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।

বড় আকারের বরফের ব্লককে গুঁড়া করে ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ মাছ ও বরফ পাত্রে রাখার পর মাদুর বা চটের টুকরা দিয়ে ঢেকে সেলাই করা হয়। পরে কাঠের বাক্সে করে দূবরর্তী স্থানে পরিবহন করা হয়। বরফ ও মাছের যথাযথ অনুপাত এবং সঠিক পাত্র ব্যবহার করে মাছকে বরফজাত করে ৭—১০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

 

বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণের অসুবিধা :

১. বরফ তৈরিতে অধিকাংশ সময়ই অপরিষ্কার পানি ব্যবহার করে বিধায় ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব দ্বারা মাছ সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

২. তাপ কুপরিবাহী পাত্রে ব্যবহার না করলে বরফের কার্যকারিতা দীর্ঘ¯ায়ী সম্ভব নয়।’

৩. ব্যবহৃত বরফের টুকরা বড় হলে মাছের শরীরে ক্ষতি হতে পারে।

৪. বরফ ও মাছের অনুপাত সঠিক মাত্রায় ব্যবহৃত হয় না বলে মাছের পুষ্টিমান ঠিক থাকে না।

৫. সংরক্ষণের সময় ব্যবহৃত পাত্র ভালভাবে পরিষ্কার না করার কারণে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু দ্বারা মাছ সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণের অসুবিধা দূর করার উপায় :

প্রচলিত পদ্ধতিতে বরফ দিয়ে মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিরাজমান অসুবিধা বা ত্রুটিসমূহ দূরীকরণ এবং মাছের গুণজাতমান বাড়ানোর জন্য নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।

১. সংরক্ষণের জন্যে ব্যবহৃত মাছগুলো সবসময় সতেজ বা টাটকা হওয়া উচিত।

২. একই প্রজাতির একই আকারের মাছ একপাত্রে সংরক্ষণ করা উচিত।

৩. বরফ তৈরিতে ব্যবহৃত পানি পরিষ্কার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

৪. বড় আকারের মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাছের দেহ হতে নাড়ী ভুড়ি সরিয়ে ফেলতে হবে।

৫. বরফ ও মাছের অনুপাত সঠিক রাখা উচিত। বাংলাদেশে শীতকালে বরফ ও মাছের অনুপাত ১ ঃ ২ এবং ১ ঃ ১ হওয়া উচিত।

৬. মাছ সংরক্ষণ কাজে ব্যবহৃত পাত্র ও সরঞ্জামাদি সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।

৭. পাত্রে বরফ ও মাছ এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন পাত্রের বরফ গলিত পানি, মাছের ময়লা ও রক্ত সহজেই পাত্রের নিচে চুইয়ে যায়।

৮. মাছ সংরক্ষণের সময় ঝুড়ি বা পাত্রে প্রথমেই একস্তর বরফ দিতে হবে। তারপর মাছ এবং সবশেষে পাত্রের উপরের মুখ বন্ধ করার পূর্বে উপরে আরেক স্তর বরফ দেয়া উচিত।

 

খ. লবণজাতকরণ বা সল্টিং :

লবণজাতকরণ মাছ সংরক্ষণের একটি সহজ ও দীর্ঘ মেয়াদী পদ্ধতি। লবণজাতকরণ হল এমন একটি মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি যেখানে অভিশ্রবণ প্রক্রিয়ায় মাছের দেহে সাধারণ লবণ প্রবেশ করানো হয়, ফলে মাছের দেহ থেকে পানি বের হয়ে আসে। এতে মাছের দেহে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে এবং মাছের দেহে লবণের ঘনত্ব বেড়ে যায় যা অণুজীবের জন্ম ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে, ফলশ্রম্নতিতে মাছ সংরক্ষিত হয়। শুধুমাত্র চর্বিযুক্ত মাছকে লবণজাতকরণ করা হয়, লবণায়নের ফলে মাছের দেহের গঠনের, বর্ণের ও গন্ধের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সম্ভব হয়।

ইলিশ মাছ Tenualosa ilisha 2 মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ

 

লবণায়নের প্রকারভেদ :

লবণজাতকরণ পদ্ধতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—

 

১. শুষ্ক লবণজাতকরণ :

এ পদ্ধতিতে মাছকে কেটে ধোয়ার পর দানাদার লবণ মিশায়ে সংরক্ষণ করা হয়।

 

২. আর্দ্র লবণজাতকরণ :

এ পদ্ধতিতে মাছকে লবণ দ্রবণে ডুবানো হয় ফলে লবণ মাছের দেহে প্রবেশ করেও দেহ হতে পানি বেরিয়ে আসে। দেহ হতে পানি বের হওয়ার কারণে লবণ দ্রবণে ঘনত্ব কমে যায়।

 

৩. মিশ্র লবণজাতকরণ:

এ পদ্ধতিতে মাছকে প্রথমে শুষ্ক লবণ দিয়ে লবণায়িত করা হয়। পরবর্তীতে লবণ দ্রবণে রেখে দেয়া হয়। এটি আর্দ্র লবণকাতকরণের তুলনায় ভাল ফলদায়ক।

 

বাংলাদেশে মাছ লবণায়নে বিভিন্ন পদ্ধতি সমূহ :

প্রচলিতশুষ্ক দানাদার লবণ ব্যবহার করে বাংলাদেশে মাছকে লবণজাত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মাছের লবণজাতকরণের দুইটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। যেমন—

১. শুষ্ক লবণায়ন পদ্ধতি এবং

২. ভিজা লবণায়ন পদ্ধতি।

 

১. শুষ্ক লবণায়ন পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে মাছকে যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের নিচ দিকে ছিদ্র থাকে যেন লবণের দ্রবণ তলা দিয়ে বের হতে পারে। সাধারণত বাঁশে তৈরি ঝুড়ি এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে মাছের লবণায়নে নিম্নের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হয় :

 

ক. ড্রেসিং :

প্রথমে মাছের অঁাইশ, পাখনা, নাড়ী—ভুড়ি দেহ থেকে ফেলে দেয়া হয়। অতঃপর আড়াআড়িভাবে মাছটির বুকের দিক হতে পৃষ্ঠদেশ পর্যন্ত কয়েকটি টুকরায় ভাগ করা হয়। এমনভাবে টকুরা করা হয় যেন টকুরাগুলো পিছনের দিকে সংযুক্ত থাকে।

 

খ. লবণের অনুপ্রবেশ :

শুষ্ক মাছের দেহের ভিতর ও বাইরে ভালভাবে লবণ মেখে দেয়া হয়। চোখ এবং ফুলকার ভিতরেও লবণ ঢুকানো হয়। এ ক্ষেত্রে লবণ ও মাছের অনুপাত ১ ঃ ৪ হয়। অভিশ্রবণ প্রক্রিয়ায় মাছে পেশীর ভিতর লবণের অনুপ্রবেশ ঘটে।

 

গ. রাইপেনিং :

লবণায়িত মাছকে ঝুড়িতে রাখা হয়। পূর্বেই ঝুড়ির তলায় লবণের একটি আস্তরণ দেয়া থাকে। এরপর পর্যায়ক্রমে একবার মাছ পরবর্তীতে লবণ এভাবে সমস্ত ঝুড়ি মাছ দ্বারা সাজানো হয়। পরে খড়ের তৈরি মাদুর দিয়ে
ঝুড়িকে ঢেকে রাখা হয়। অতঃপর ঝুড়িকে সাধারণ তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে ৭১০ দিনে মাছ রাইপেনিং সমাপ্ত হয়।

 

ঘ. গুদামজাতকরণ :

রাইপেনিং করার পর মাছগুলোকে টিনের পাত্রে গুদামজাত করা হয় ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাজারজাত করা হয়।

 

২. ভিজা লবণায়ন পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে প্রথমে মাছকে ড্রেসিং করা হয়। এক্ষেত্রে ড্রেসিং—এর সময় মাছের মাথা সম্পূর্ণরূপে কেটে আলাদা করা হয়। এ পদ্ধতিতে মাছকে এমনভবে তীর্যক করে কাটা হয় যেন কাটা অংশের অধিকাংশ জায়গা বাইরে খোলা থাকে। এর ফলে মাছের লবণায়ন দ্রুত সম্পন্ন হয়। তারপর মাছকে শুষ্ক লবণ দিয়ে মাখানো হয়। অতঃপর লবণ মাখানো মাছকে টিনের পাত্রে এক স্থানে সাজানো হয়। এরূপে পর্যায়ক্রমে টিনের কিছু অংশ ফাঁকা রেখে লবণ মাখানো মাছকে টিনের পাত্রে পূর্ণ করা হয়।

ফাঁকা অংশ মাছের দেহ হতে অভি¯্রবণ প্রক্রিয়ায় বের হয়ে আসা পানি দ্বারা পূর্ণ হয়। তুলনামূলকভাবে ভিজা বা আর্দ্র লবণজাতকত মাৃ ছের গুণগত মান ভাল হয়ে থাকে এবং মাছকে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রখা যায়।
ইলিশ মাছ লবণজাতকরণ পদ্ধতি : ইলিশ মাছ অধিক চর্বিযুক্ত বিধায় শুটককিকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায় না। অপরপক্ষে বরফায়ন স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণ পদ্ধতি আর হিমায়ন ব্যয়বহুল পদ্ধতি।

তাই বাংলাদেশে জেলেরা লবণজাতকরণের মাধ্যমে ইলিশ মাছকে সংরক্ষণ করে থাকে। লবণায়নের পূর্বে মাছকে ড্রেসিং করে অঁাইশ, নাড়িভঁুড়ি কেটে ফেলা হয়। ধারালো ছুরি বা দা দিয়ে মাছের পিঠ থেকে পেটের দিকে আড়াআড়িভাবে ১/২ ইঞ্চি পুরু করে টুকরা করা হয়। কখনো কখনো পেটের দিকে সংযুক্ত রেখে কাটা হয়। অতঃপর মাছে ওজনের ১৫—২৫% সাধারণ লবণ হাত দ্বারা ভালভাবে ঘষে কাটা টুকরায় মিশানো হয়।

পরে লবণ মিশ্রিত টুকরাগুলোকে ঝুড়িতে বা কাঠের পাটাতনের উপর স্তূপাকারে রাখা হয়। ঝুড়ি বা পাটাতনে পূর্বেই লবণের হালকা স্তর দেয়া থাকে। সবশেষে স্তূপীকৃত টুকরাগুলোকে মাদুর বা চট দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে ৫—৭ দিনে মাছের রাইপেনিং হয়। ফলে মাছের গঠন, গন্ধ, স্বাদ ও বর্ণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়।

 

বাংলাদেশে ইলিশ মাছ লবণজাতকরণের সুবিধা :

১. ইলিশ মাছ চর্বিযুক্ত হওয়ায় শুটকিকরণ সম্ভব নয়। কিন্তু লবণায়নের মাধ্যমে সহজেই এ মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব।

২. এ পদ্ধতি সহজ ও জেলেদের নিকট অতি পরিচিত।

৩. এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত মাছের পুষ্টিমান অপরিবর্তিত থাকে।

৪. বাংলাদেশে লবণ অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজলভ্য। বাংলাদেশে ইলিশ মাছ লবণজাতকরণের অসুবিধা :

১. ভালভাবে ড্রেসিং করা হয় না এবং ড্রেসিং—এর পর মাছ ভাল করে ধোয়া হয় না। তাই গুণগত মান কিছুটা নষ্ট হয়।

২. লবণায়নের সময় কোন প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না।

৩. অনেক সময় অপরিষ্কার লবণ ব্যবহার করার ফলে মাছের গুণগত মান খারাপ হয়।

৪. লবণ ও মাছের কোন আদর্শ অনুপাত নেই।

৫. লবণজাতকরণে বাজারের অবিক্রিত পচা কিংবা বাসি মাছ ব্যবহার করা হয় ফলে লবণায়িত মাছে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়।

৬. অনেক সময় অতিরিক্ত লবণ ব্যবহৃত হয় ফলে প্রোটিন ডিন্যাচারেশন হয়।

৭. লবণায়নের পর মাছ খোলা অবস্থায় রাখা হলে মাছের চর্বি বাতাসের সংস্পর্শে এসে জারণের ফলে দুর্গন্ধ সৃির্ষ্ট হয় ও উপদানের গুণগত মান খারাপ হয় এবং চাহিদা কমে যায়।

 

লবণজাতকরণের সুবিধাসমূহ :

১. লবণজাতকরণের মাধ্যমে মাছ সংরক্ষণে খরচ কম হয়।

২. লবণজাতকৃত মাছকে দীর্ঘদিন সংরক্ষিত রাখা যায়।

৩. এ পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ সহজ।

৪. আমাদের দেশে লবণ সস্তা ও সহজলভ্য

৫. লবণজাতকৃত মাছ অন্যান্য সংরক্ষণ পদ্ধতির তুলনায় সহজে পরিবহণ করা যায়।

 

গ. শুটকিকরণ বা ড্রাইং :

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সূর্যালোক ও বাতাসের মাধ্যমে মাছ থেকে পানি বা জলীয় অংশ হ্রাস করানোকে শুঁটকিকরণ বলা হয়। মাছের শরীরে শতকরা প্রায় ৭০—৮০ ভাগ পানি থাকে। মছ ধরার পর দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে মাছ পচতে শুরু করে। সূর্যালোকে মাছকে শুকানো হয় বলে মাছের পচন রোধ হয়। সূর্যালোকে শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ বাংলাদেশে একটি অতি প্রাচীন পদ্ধতি।

 

শুঁটকিকরণের উদ্দেশ্য :

শুঁটকিকরণের প্রধান উদ্দেশ্য হল মাছকে সংরক্ষণ করা। তাছাড়া নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যে মাছ শুঁটকিকরণ করা হয়।

১. মাছের পুষ্টিগত মান ঠিক রাখা।

২. মাছ সংরক্ষণের খরচ কমিয়ে সহজে গুদামজাত করা।

৩. উৎপাদনকে বাণিজ্যিকভাবে ও পুষ্টিমানের বিচারে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।

৪. স্বল্প পরিশ্রমে এ পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। শুঁটকিকরণ পদ্ধতি :

বাংলাদেশে সাধারণত শীত মৌসুমে সূর্যালোকের সাহায্যে শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। এ সময়ে আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত কম থাকে। এছাড়া সূর্যালোকের স্থায়িত্বের কারণে শুঁটকিকরণের জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, ময়মসিংহ প্রভৃতি জেলায় অধিক হারে মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। কারণ এসব জেলায় হাওড় বাঁওড়, বিল ও উপকূলীয় এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়ে। ছোট ও বড় উভয় ধরনের মাছকে শুঁটকিকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়।

এ পদ্ধতিতে ছোট মাছের ক্ষেত্রে বড় মাছের তুলনা কম সময় ব্যয় হয়। বাংলাদেশের সূর্যালোকে যেসব মাছ শুঁটকিকরণ করা হয়, সেগুলো হল— চান্দা, পুঁটি, মলা, ডেলা ইত্যাদি। আর যেসব বড় মাছ শুঁটকি করা হয় সেগুলো হল— শোল, গজার, বোয়াল, টাকি, লইট্টা, ছুটি, কোরাল, ফলিচান্দা, রূপচান্দা ইত্যাদি।

ছোট মাছ শুঁটকিকরণ পদ্ধতি : চান্দা, মলা, ঢেলা, পুঁটি টেংরা ইত্যাদি ছোট মাছকে সূর্যালোকে শুকানো হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত মাছের অঁাইশ নাড়ী—ভঁুড়ি পাখনা ইত্যাদি ফেলে দেওয়া হয় না। শুকানোর পূর্বে কখনো কখানো মাছকে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পরে মাছগুলোকে চাটাইয়ের উপর বিছিয়ে রোদে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত ৩—৫ দিনের মধ্যে শুঁটকিকরণ সম্পন্ন হয়।

মাছ শুকানোর সময় বিভিন্ন ধরনের অণুজীব, পোকা—মাকড়, পাখি, কীটপতঙ্গ আক্রমণ করতে পারে। তাই পলিথিন সীট/জাল ব্যবহার করে প্রতিরোধ করা যায়। দ্রুত শুকানোর জন্য মাছগুলোকে উল্টিয়ে দেয়া হয়।

 

বড় মাছ শুঁটকিকরণ পদ্ধতি :

যেসব বড় মাছ শুঁটকিকরণ করা হয়, সেগুলো হল— শোল, গজার, বোয়াল, লইট্টা, ছুরি ইত্যাদি। বড় মাছের শুঁটকিকরণ পদ্ধতিকে ধারাবাহিকভাবে নিচে উল্লেখ করা হলো—

ক. টাটকা ও তাজা মাছ শুঁটকিকরণের জন্যে বাছাই করতে হবে, এতে উন্নত মানের শুঁটকি তৈরি সম্ভব হয়।

খ. প্রথমেই মাছের আঁইশ, পাখনা, নাড়ী—ভুঁড়ি ইত্যাদি ফেলে দিয়ে পানিতে ধুয়ে নিতে হবে।

গ. ধোয়ার পর মাছকে মাথা হতে লেজের দিকে মেরুদণ্ড বরাবর এমনভাবে কাটা হয় যেন লেজের দিকে সামান্য অংশ সংযুক্ত থাকে, যা মাছকে রেদে শুকানোর সময় ঝুলিয়ে রাখতে সহায়তা করে। প্রতিটি কাটা ফালিকে ফিলেট বলা হয়।

ঘ. কাটা প্রতিটি ফালিকে ছুরি দিয়ে মাঝ বরাবর ২/৩ বার কাটা হয় যা মাছকে দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে।

ঙ. পাখিরা অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ হতে রক্ষা করার লক্ষ্যে মাছগুলোকে শুকাতে ৭—৮ দিন সময় লাগে।

ঝ. শুঁটকি মাছে সাধারণত ১০—২০% জলীয় অংশ থাকে।
উপরিউক্ত উপায়ে শুঁটকি করার পর মাদুর বা কুঁড়েঘরে রাখা হয়। পরবর্তীতে মাটির পাত্র বা মটকায় রেখে দেয়া হয়। মাটির পাত্রের অভ্যন্তরভাগে ভালভাবে মাছের তেল মাখানোর পর শুঁটকিগুলো পাত্রে রাখা হয়। ফলে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশে শুঁটকিকরণের গুরুত্ব:বাংলাদেশে শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়ে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে সব মাছ বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। ফলশ্রম্নতিতে আহরিত এলাকায় কম দামে মাছ বিক্রি করতে হয় অথবা মাছ পঁচে যায়। তাই সূর্যালোকের সাহায্যে মাছ শুঁটকিকরণ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে বাংলাদেশের শুঁটকিকরণের গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো—

১. এদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশের মৎস্যজীবীদের দারিদ্র্যতার কারণে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করতে অক্ষম। তাই প্রাকৃতিকভাবে স্বল্প খরচে মাছ সংরক্ষণ তথা শুঁটকিকরণ বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

২. এ পদ্ধতি জেলেদের নিকট খুবই গ্রহণযোগ্য এবং অতি পরিচিত।

৩. এটি একটি তুলনামূলকভাবে সহজ পদ্ধতি।

৪. শুঁটকিকরণের পর শুঁটকির তৈরিকৃত খাদ্যের গুণগতমান তাজামাছের সাথে তুলনীয়।

৫. এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ পদ্ধতি বিধায় মাছ অনেকদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। ফলে যখন বাজারে মাছের পরিমাণ কমে যায় তখন শুঁটকি মাছ বাজারে সরবরাহ করে মাছের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়।

৬. বাংলাদেশে শীত মৌসুমে অর্থাৎ মাছ ধরার ঋতুতে আবহাওয়া ও সূর্যালোক শুঁটকিকরণের অনুকূলে থাকে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে শুঁটকিকরণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

 

বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতি শুঁটকিকরণের অসুবিধা :

বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ শুকানোর কতকগুলো অসুবিধা রয়েছে। যেমন—

১. শুঁটকিকরণ সম্পূর্ণরূপে আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার আর্দ্রতা বেশি থাকলে মাছ শুকাতে অধিক সময়ে প্রয়োজন হয়।

২. শুঁটকিকরণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় শুটকি রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৩. শুঁটকির গঠন কখনো শক্ত হলে রান্না করায় বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

৪. উন্মুক্ত স্থানে শুঁটকিকরণ করা হয় বিধায় সতর্কতার অভাবে বিভিন্ন ধরনের পোকার লার্ভা দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।

৫. শুঁটকি অনেক ক্ষেত্রে কালো বর্ণের হয়, ফলে চাহিদা কিছুটা কমে যায়।

৬. অনেক সময় শুঁটকিকে উজ্জ্বল বর্ণের করার জন্য তেল দ্বারা ব্রাশ করা হয়, ফলশ্রম্নতিতে বিভিন্নভাবে সংক্রমিত হতে পারে।

৭. অনেক সময় পচা মাছ দ্বারা শুঁটকিকরণ করা হয় বিধায় গুণগত মান ঠিক থাকে না।

৮. ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে শুঁটকি গুদামজাত করার ফলে গুণগত মান নষ্ট হতে পারে।

 

শুঁটকিকরণের অসুবিধা দূরীকরণের উপায় :

বাংলাদেশে শুঁটকির গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে নিম্নের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে—

১. শুঁটকিকরণের জন্যে অবশ্যই টাটকা মাছ ব্যবহার করা উচিত। অধিক চর্বিযুক্ত মাছ শুঁটকিকরণে ব্যবহার করা উচিত নয়।

২. শুঁটকিকরণের জন্যে সর্বদা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত। ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহারের আগে ও পরে ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখা উচিত। একাজে ক্লোরিন পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।

৩. মাছের নাড়ি—ভুড়ি, পাখনা, আঁইশ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ছড়াতে হবে যেন মাংসের কোন অংশে ক্ষতি না হয়।

৪. ড্রেসিং করার পর মাছকে উত্তমরূপে ধৌত করা উচিত যেন প্রাথমিক সংক্রমণ না হয়। মাছকে লঘু লবণ পানি (২ — ৫%) অল্প সময়ের জন্য (সর্বোচ্চ ৫ মিনিট) ডুবিয়ে রাখা যেতে পারে।

৫. শুঁটকিকরণের সময় মাছকে মাটিতে বা বালতিতে রাখা উচিত নয়। মাচায় বা চাটাই—এর উপর শুকানো উচিত। ফলে শুকানোর প্রক্রিয়াও দ্রুত হয়। আর পোকা—মাকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে শুকানোর সময় জাল টাঙিয়ে রাখা উচিত।

৬. খোলা জায়গায় শুঁটকি মজুদ না করে বায়ু নিরোধক পাত্রে মজুদ করা উচিত। ক্ষেত্রবিশেষে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অধিক পরিমাণ শুঁটকি মজুদের জন্যে টিনের পাত্র ব্যবহার করা উচিত। এক্ষেত্রে ইঐঞ,
ইঐঅ, ঠরঃ—ঈ, এক্সটোকোফেরল ইত্যাদি এন্টি অক্সিডেন্ট ব্যবহার করে পাত্রের অভ্যন্তরে জীবাণু রোধ করা উচিত।

 

ঘ. হিমায়িতকরণ বা ফ্রিজিং:

হিমায়িতকরণ মাছ সংরক্ষণের একটি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে এক বছর পর্যন্ত গুণগত মান অক্ষণ্ণ থাকে। যে পদ্ধতিতে মাছের দেহে তাপ অপসারণের মাধ্যমে দেহি¯ত ’ পানিকে সম্পূর্ণরূপে বরফে পরিণত করা হয় তাকে হিমায়িতকরণ বলা হয়। বাংলাদেশে চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সামগ্রী এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। হিমায়ন দুই ধরনের হতে পারে। যথা : দ্রুত ও ধীর হিমায়ন। ধীর হিমায়ন সবচেয়ে ভাল হিমায়িতকরণ পদ্ধতি।

 

হিমায়িতকরণ পদ্ধতি :

বরফজাতকৃত বড় আকারের মাছ নাড়ি—ভুঁড়ি, মাথা ও পাখনা ফেলে দিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হয়। চিংড়ির ক্ষেত্রে মাথা ফেলে দিয়ে সাইজ অনুসারে আলাদা করা হয়। পরবর্তীতে ২০ হতে ৮০ ভাগ ক্লোরিন পানিতে মাছগুলো ডুবিয়ে রাখা হয়। মাছ ও চিংড়ি প্রয়োজন অনুযায়ী ধারালো ছুরি দিয়ে টুকরা করা হয়। টুকরাগুলো ১০— ১২ ভাগ সোডিয়াম ট্রাইফসফেট দ্রবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে হিমায়িত করা হয়।

 

ঙ. টিনজাতকরণ বা ক্যানিং :

টিনজাতকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদী মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি। টিনজাতকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে মাছকে সম্পূর্ণরূপে বায়ুশূন্য পাত্রে আবদ্ধ করে অতিউচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে জীবাণুমুক্ত বলতে বোঝায় যতটুকু জীবাণুমুক্ত করার ফলে সকল ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মারা যায় বা ধ্বংস হয়। এ পদ্ধতিতে ৩ বছর পর্যন্ত মাছ সংরক্ষণ করা যায়।

Biofloc Technology Fish Farming বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ 16 মাছ পঁচনের কারণ ও সংরক্ষণ

টিনজাতকরণ পদ্ধতি :

এটি বেশ কতকগুলো ধাপে সম্পন্ন হয়। টিনজাতকরণ পদ্ধতিটির বিভিন্ন ধাপসমূহ ধারাবাহিকভাবে নিম্নে উল্লেখ করা হলো—

১. কাঁচামাল নির্বাচন : মাংসল ও চর্বিযুক্ত টাটকা মাছ টিনজাতকরণের জন্য উপযোগী।

২. টিন বা কৌটা ভর্তিকরণ : কৌটা হিসেবে টিনের পাত্র বেশি ব্যবহৃত হয়, তবে ক্ষেত্রবিশেষে অ্যালুমিনিয়াম বা কাঁচের পাত্রও ব্যবহৃত হয়। কৌটাকে হাত বা মেশিনের সাহায্যে পূর্ণ করা হয়। সাধারণত কৌটার উপরিভাগ সামান্য পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রাখা হয় এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাস দ্বারা এ ফাঁকা স্থান পূরণ করা হয়।

৩. বিভিন্ন উপদান সংযোজন : খাদ্যের বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ বৃদ্ধির জন্যে গ্লুটামেট, তেল, টমোটো সস, বিভিন্ন ধরনের মসলা ইত্যাদি উপাদান সংযোজন করা হয়।

৪. বায়ুশূন্যকরণ ও কৌটাবদ্ধকরণ : কৌটার স্ফীতি, জারণ ও টিনের ক্ষয়রোধ করার লক্ষ্যে কৌটাকে বায়শূন্য করা হয় এবং পরে কৌটা বন্ধ করা হয়।

৫. ধৌতকরণ : বদ্ধকৃত কৌটার গায়ে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য কৌটা ধৌতকরণ করা হয়।

৬. প্রক্রিয়াকরণ ও উত্তপ্তকরণ : উচ্চতাপে কৌটাস্থিত খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে ১৫ পাউন্ড/ইঞ্চি চাপে ১২১০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কৌটাকে উত্তপ্ত করা হয়। সাধারণ ৩০ মিনিট তাপ দিতে হয়।

৭. ঠাণ্ডাকরণ : তাপ প্রয়োগের ফলে সষ্ট কিছু দুর্গন্ধ দূর করার জৃ ন্যে ঠাণ্ডা বায়ু বা ঠাণ্ডা পানি দ্বারা ঠাণ্ডাকরণ করা হয়।

৮. লেবেলিং : ঠাণ্ডাকরণ করার পর কৌটার দ্রব্যের নাম, কোম্পানির নাম, পুষ্টিমান, মেয়াদ উত্তীর্ণের সময় ইত্যাদি উল্লেখ করে কৌটার গায়ে লেবেলিং করা হয়।

৯. গুদামজাতকরণ : কৌটাজাতকরণের পরপরই উৎপাদিত দ্রব্য বাজারজাত না করে বেশ কিছুদিন গুদামজাত করা হয়। কাক্সিক্ষত স্বাদ ও গন্ধ পাওয়ার জন্যই গুদামজাত করা হয়।

 

চ. ধূমায়িতকরণ বা স্মোকিং :

এটি একটি স্বল্পমেয়াদী মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতি। ধূমায়িতকরণ হল মাছ সংরক্ষণের এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কাঠ পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ধোয়ার তাপমাত্রা এবং ধুয়াকণার যৌথক্রিয়ায় মাছের দেহ থেকে পানি অপসারিত হয়। মাছের কাক্সিক্ষত স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধের জন্য বর্তমানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় সংরক্ষণ কাজে এর ব্যবহার সীমিত হয়ে আছে।

 

ধূমায়িতকরণ পদ্ধতি :

সাধারণত পরিপক্ব ও চর্বিযুক্ত মাছ ধূমায়িতকরণের জন্যে কাঁচামাল হিসেবে বেশি উপযোগী। ধূমায়নের জন্যে বড় মাছকে কেটে ফিলেট করতে হয় কিন্তু ছোট মাছকে কাটতে হয় না। ব্যাকটেরিয়া ও মোল্ড—এর বৃদ্ধি রোধ করার জন্য মাছকে ৬০—৭০% লবণে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। এতে পেশীতে ২—৩% লবণ প্রবেশ করে। ধূমায়িত মাছ সাধারণত কাঠের বাক্সে প্যাকিং করা হয়। এ পদ্ধতিতে ২—৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment