আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় – মাটির উর্বরতা। মাটি হচ্ছে কৃষির অন্যতম ভিত্তি। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাক্সিক্ষত ফসল পাওয়া যায় না।
Table of Contents
মাটির উর্বরতা
মাটির উর্বরতা
উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ সঠিক পরিমাণে ও সমানুপাতে সরবরাহ করার ক্ষমতাকে মাটির উর্বরতা বলে। আমরা তখনই কোন মাটিকে উর্বর বলি যখন উদ্ভিদ তার প্রয়োজনীয় সব উপাদানই অনুকূল পরিবেশে ঐ মাটি থেকে গ্রহণ করতে পারে। যে সব কারণ মাটির উর্বরতা নিয়ন্ত্রণ করে তাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
(ক) প্রাকৃতিক কারণ ও
(খ) কৃত্রিম কারণ
প্রাকৃতিক কারণগুলো হলো- মাটির উৎসবস্তু, মাটি গঠনের প্রক্রিয়া, জৈব পদার্থ, মাটির বন্ধুরতা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, বায়ু প্রবাহ, মাটির বয়স ইত্যাদি। কৃত্রিম কারণগুলো হলো : জমি চাষাবাদ পদ্ধতি, ফসলের প্রকৃতি, সারের প্রকৃতি ও পরিমাণ,
মাটির আর্দ্রতা, মাটির অম্লমান, মাটি সংরক্ষণ পদ্ধতি ইত্যাদি।
মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির উপায়
আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে অধিক হারে ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন হচ্ছে। আর ফসল উৎপাদন বাড়াবার জন্য একই জমিতে কয়েকবার ফসল ফলানোর প্রয়োজন পড়ছে। ফলে মাটির উর্বরতার উপর ক্রমাগত চাপ বাড়ছে।
এমতাবস্থায় মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বাড়তি খাদ্য চাহিদা মেটাতে উর্বরতা বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে আস্তে আস্তে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাবে এবং এক সময় মাটি উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। নিচে কী কী উপায়ে
মাটির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধি করা যায় তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
ভূমিক্ষয় রোধ করা
ভূমিক্ষয়ের ফলে উপরের মাটি স্থানচ্যুত হলে ভূমি উর্বরতা হারায়। মাটির- উর্বরতা রক্ষা করতে হলে ভূমিক্ষয় রোধ করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা ভূমির উপরিভাগ জৈব পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ ।
মাটিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগ
উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবগুলো পুষ্টি উপাদান জৈব পদার্থ হতে পাওয়া যায়। এ জন্য জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। মাটিতে জৈব পদার্থের আশঙ্কাজনক পরিমাণ শতকরা ২ ভাগ।
সুষম সার ব্যবহার
উদ্ভিদের জীবন ধারণ, বর্ধন ও পুষ্টির জন্য মাটি থেকে সবসময়ই কিছু খাদ্যোপাদান পরিশোষণ করে। ফলে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণের জন্য মাটিতে সুষম আকারে বিভিন্ন জৈব, অজৈব ও অণুজীব সার প্রয়োগ করতে হবে। ফসলের প্রয়োজনের ভিত্তিতে রকম ও পরিমাণ ঠিক করে যে সার সরবরাহ করা হয় তাকে সুষম সার বলে। সুষম সার প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা রক্ষা পায়।
শিম জাতীয় উদ্ভিদ চাষ
শিম জাতীয় উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য হলো এর শিকড়ে এক ধরনের অণুজীব বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে মূলের গুটির মধ্যে ধরে রাখে। উদ্ভিদ বৃদ্ধির জন্য বেশি পরিমাণ নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয়। এ জন্য নাইট্রোজেনের অভাব পূরণ করতে জমিতে শিম জাতীয় উদ্ভিদ চাষ করা প্রয়োজন।
জমির মাটির অম্লমান নিয়ন্ত্রণ
মাটির অম্লমান বেড়ে গেলে অর্থাৎ পি এইচ (pH) মান অনেক কমে গেলে জমিতে অনেক ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। pH মান দিয়ে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নির্ণয় করা হয়। মাটির অম্লমান বেড়ে গেলে জমিতে চুন প্রয়োগ করে অম্লত্ব দূর করা হয়।
মাটির নিরপেক্ষ পি এইচ এর মান ৭ গ্রাম মোলস/লিটার । pH মান ১-৬৯ পর্যন্ত অম্লমান এবং সাধারণত pH মান ৭.১-১৪ কে ক্ষারমান ধরা হয়। শস্য পর্যায় অবলম্বন একই জমিতে প্রতিবছর একই ফসল বার বার চাষ করলে মাটির একটি নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান কমে যায়।
তাই পর্যায়ক্রমিকভাবে অর্থাৎ প্রথমে এক জাতীয় ফসলের পর অন্য ধরনের ফসল চাষ করলে মাটির -উর্বরতার সমতা রক্ষা পায়। যেমন- কোন জমিতে ধান (অগভীর শিকড়যুক্ত ফসল চাষের পর যেখানে পাট (গভীর শিকড়যুক্ত ফসল চাষ করা যেতে পারে।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
আগাছা ফসলের শত্রু। আগাছা উদ্ভিদের পুষ্টি, পানি, আলো, জায়গা প্রভৃতি ব্যবহারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, ফলে প্রকৃত ফসলের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। তাই সময়মতো আগাছা দমন করলে মৃত্তিকার রস, পুষ্টির অপচয় রোধ পাবে যা মাটির- উর্বরতা রক্ষার সহায়ক হবে।
পানি ব্যবস্থাপনা
উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে দ্রবীভূত অবস্থায় শোষণ করে। সে জন্য মাটিতে পরিমিত পানি থাকা আবশ্যক। জমির উর্বরতা বৃদ্ধিকারী অণুজীবের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত রসের উপস্থিতি প্রয়োজন।
অন্যদিকে অতিরিক্ত পানি ফসলের বৃদ্ধিকে বাধা দেয় এমনকি ফসলকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে ফেলতে পারে। ফলে জমিতে পরিমিত সেচ প্রদান ও অতিরিক্ত পানি নিকাশের সুব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
উত্তমরূপে জমি তৈরি
জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিলে উপরিভাগে ঝুরঝুরে ও নরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় উদ্ভিদ সহজেই তার শিকড় বিস্তার করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে। এছাড়া উত্তমরূপে জমি চাষ করলে মাটিতে জৈব ও অজৈব পদার্থ ভালভাবে মিশতে পারে, ফলে মাটির -উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
জমিকে বিশ্রাম দেওয়া
দীর্ঘদিন যাবত বারবার চাষাবাদের ফলে মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈব ধর্মের অবনতি ঘটে। তাই কয়েক বছর পর পর জমিকে এক বা একাধিক মৌসুমের জন্য বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন।
সারমর্ম
উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ সঠিক পরিমাণে ও সমান অনুপাতে সরবরাহ করার ক্ষমতাকে উর্বরতা বলে।
এ যে সব কারণ মাটির- উর্বরতা নিয়ন্ত্রণ করে তা হলো : প্রাকৃতিক কারণ ও কৃত্রিম কারণ।