মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি বিএই ১২০৪ – মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ের ইউনিট -২ এর পাঠ – ২.৫। আকারে যোগান দেয়ার সামর্থকে মাটির উর্বরতা বলে। যে মাটি খুব বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান যোগান দিতে পারে সে মাটি তত বেশি পরিমাণ উর্বর। পুষ্টি উপাদানের পরিমাণের উপর মাটির উর্বরতা কম বা বেশি হতে পারে।
Table of Contents
মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা
উর্বরতা অনুযায়ী মাটি ২ প্রকারের হয়ে থাকে—
উর্বর মাটি:
শস্য উৎপদানের জন্য উর্বর মাটি উত্তম। যে মাটি উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে ও উৎপাদনের সুষম আকারে যোগান দিতে সক্ষম তাকে উর্বর মাটি বলে।
অনুর্বর মাটি :
যে মাটি উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে ও সুষম আকারে যোগান দিতে অক্ষম তাকে অনুর্বর মাটি বলে। এ মাটি শস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের কারণ নিম্নে মাটির উর্বরতা হ্রাসের কারণসমূহ তুলে ধরা হল:
১. জৈব সারের ব্যবহার কম করা
২. রাসায়নিক সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা।
৩. শস্য পর্যায় নীতি মেনে না চলা।
৪. উচ্চফলনশীল জাতের ফসল চাষ করা।
৫. ভূমিক্ষয় ও মাটি দূষণ।
৬. জ্বালানী হিসাবে গোবর সার ব্যবহার করে ফেলা।
৭. নিবিড়ভাবে ফসল চাষ করা।
৮. গৃহপালিত পশুর সংখ্যা ও গোবর কমে যাওয়া।
৯. ফসলের বাকী অংশ জ্বালানী কাজে ব্যবহার করা।
১০. অধিক ভূমি কর্ষণ করা।
উর্বর মাটির বৈশিষ্ট্য :
- মাটির পিএইচ মান ৬.০—৭.৫।
- মাটি গাঢ় বর্ণের।
- মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ওজন ভিত্তিতে ২—৩%।
- আবহাওয়া ও জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়া ফসল ও ফসলবিন্যাস।
- দোঅঁাশ থেকে পলিদোঅঁাশ সম্পন্ন মৃত্তিকা বুনট।
মাটির উৎপাদন ক্ষমতা:
নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট শস্য বা শস্য বিন্যাসের ফলন দেয়ার ক্ষমতাকে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বলা হয়।
মাটি ও ফসলের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী মাটি দু’প্রকারের হয়ে থাকে যথা:
১. উৎপাদক মাটি : যে মাটি ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত তাকে উৎপাদক মাটি বলে।
২. অনুৎপাদক মাটি : যে মাটি ফসল ফলানোর জন্য অপেক্ষাকৃত অনুপযুক্ত তাকে অনুৎপাদক মাটি বলে।
উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মাটির বৈশিষ্ট্য :
১. মাটি উর্বর হয়ে থাকে।
২. মাটি উত্তম নিস্কাশন সম্পন্ন হয়ে থাকে।
৩. আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকুলে থাকে।
৪. ফসলের শত্রু কম থাকে।
উর্বর মাটির উপাদান প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপাদান দ্বারা মাটির উর্বরতা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিম্নে উপাদানমূহ উল্লেখ করা হল:
প্রাকৃতিক উপাদান
১. গাছপালা ও জলবায়ু: গাছপালা ও জলবায়ু মাটির উর্বরতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অধিক গাছপালা সম্পন্ন এলাকার মাটিতে অধিক জৈব পদার্থ যোগ হয় যার ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অধিক বৃষ্টিপাত সম্পন্ন এলাকার মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়ায় উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কমে যায়। আবার যে সব এলাকায় তাপমাত্রা বেশি ও আর্দ্র আবহাওয়া সেসব এলাকার মাটি তাড়াতাড়ি ক্ষয়িত হয়, ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়।
২. উৎস শিলা : উদ্ভিদ যে খনিজ উপাদানসমূহ গ্রহণ করে তা উৎস শিলা হতে পেয়ে থাকে। যে শিলায় পুষ্টি উপাদান অধিক সে শিলা সম্পন্ন মাটি অধিক উর্বর হয়ে থাকে।
কৃত্রিম উপাদান , কৃত্রিম উপাদানসমূহ নিম্নরূপ:
১. প্রয়োগকৃত জৈব পদার্থ : জৈব পদার্থ মাটির ভৌত অবস্থার উন্নতি করে এবং মাটিতে বিদ্যমান অনুজীব কার্যক্ষমতা ত্বরান্বিত করে ফলে মাটির উর্বরতা বেড়ে যায়।
২. ভূমি কর্ষণ : পরিমিত ভূমি কর্ষণের ফলে ভূমির উপরের স্তর দূর্বল হয় যার ফলে উদ্ভিদের শেকড় সহজেই বিস্তার লাভ করে পুষ্টি উপাদান নিতে পারে।
৩. মাটির পিএইচ : মাটিতে এর মান খুব বেশি বা কম হলে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। পিএইচ (ঢ়ঐ) মান ৬—৮ হলে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
মাটির উৎপাদনক্ষমতার উপাদান:
আমরা সহজে বলতে পারি যে, যে মাটি যত বেশি উর্বর তার তত বেশি উৎপাদনক্ষমতা থাকে। মাটির উৎপাদনক্ষমতা কিছু উপাদানের উপর নির্ভর করে থাকে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:
১. মাটির উর্বরতা: মাটির উর্বরতা হচ্ছে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণ ও সুষম হারে যোগান দেওয়া। মাটি উর্বর হলে তা অবশ্যই উৎপাদনশীল হবে।
২. শস্য পর্যায় : শস্য পর্যায় যথাযথভবে অনুসরণ করে মটির উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়।
৩. জলবায়ু : ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত জলবায়ুর প্রয়োজন। উপযুক্ত জলবায়ু মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৪. জমি কর্ষণ : জমি কর্ষণের উপর মাটির উৎপাদান ক্ষমতা নির্ভর করে। জমি ভালোভাবে কর্ষণ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৫. ফসল ব্যবস্থাপনা : ফসল ব্যবস্থাপনার উপর মাটির উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভরশীল্ ফসল ব্যবস্থাপনা যেমন সার প্রয়োগ, আন্ত:কালীন পরিচর্যা, রোগ ও পোকামাকড় দমন, গাছের গোড়া আলগা করে দেয়া প্রভৃতির মাধ্যমে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মাটির উর্বরতা সংরক্ষণের উপায় :
১। সঠিক পদ্ধতিতে জমির ব্যবহার : ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে জমিতে যে ফসল উপযোগী সে জমিতে সে ফসল চাষ করতে হবে। যেমন সমতল ভূমিতে সে সকল ফসল চাষ করা হয় পাহাড়ি অঞ্চলে সেসকল ফসল চাষ করা যায় না। সমতল ও পাহাড়ি জমির চাষ পদ্ধতিও ভিন্ন হবে।
২। ভূমি কর্ষণ : পরিকল্পিতভাবে ভূমি কর্ষণ মাটির উর্বরতা সংরক্ষণে সহায়ক। অনিয়মিত ও যথেচ্ছ ভূমি কর্ষণ মাটির ভৌত ধর্ম নষ্ট করে এবং উর্বরতা কমায়। সে ফসলের জন্য যতটুকু কর্ষণ করা দরকার ততটুকুই কর্ষণ করতে হবে।
৩। জৈব পদার্থ প্রয়োগ : জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। জৈব পদার্থ মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মের উন্নয়ন সাধন করে এবং গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। বিভিন্ন জৈব সার যেমন খামার জাত সার, কম্পোস্ট, সবুজ সার, গোবর, পঁচা আবর্জনা ইত্যাদি মাটিতে প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ানো যায়।
৪। পরিমিত রাসায়নিক সার ব্যবহার : জমিতে বিভিন্ন সারের প্রয়োজনীয়তা জেনে পরিমিত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
৫। পানি সেচ ও নিকাশ : জমিতে পানি সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা ভাল হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে হবে আবার অতিরিক্ত পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।
৬। সবুজ সার ও আচ্ছাদন ফসলের চাষ : বিভিন্ন সবুজসার ফসল যেমন ধৈঞ্চা ফুল আসার পূর্বে নরম অবস্থায় চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও মাটির উপর আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী ফসল যেমন ডাল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি চাষ করে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ করা যায়।
৭। ফসল পর্যায় ও ফসল বিন্যাস অবলম্বন : একই জমিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল চাষ করতে হবে যাতে মাটির বিভিন্ন অঞ্চলের পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদ দ্বারা সমভাবে পরিশোধিত হয়।
৮। আগাছা দমন ও মালচিং : আগাছা জমির পুষ্টি উপাদান শোষন করে জমির উর্বরতা কমায়। এজন্য আগাছা দমন করে এবং উদ্ভিদ অবশিষ্টাংশ ও অন্যান্য খড়কুটা দিয়ে মালচিং করে জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করা যায়।
সারাংশ
ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা বজায় রাখা অতীব প্রয়োজন। শুধু মাটির উর্বরতা বজায় রাখলে চলবে না, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কারণ রাসায়নিক বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে ও হাজার বছরের চাষাবাদের ফল মাটি হারাচ্ছে তার অকৃত্রিম উর্বরতা। তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমাদের দেশের জমির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে হবে।