মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন – যা ফসল সম্পর্কিত কৃষি প্রযুক্তি এর অন্তর্ভুক্ত ।

মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

 

মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

 

মাটি ফসল উৎপাদনের একটি মাধ্যম। ফসল উৎপাদন মাটির বৈশিষ্ট্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। মাটিই হচ্ছে পানি ও পুষ্টির প্রাকৃতিক উৎস। সব মাটিতে সব ফসল জন্মায় না । যেমন, ধান গাছ কাদা মাটি বা এঁটেল দোআঁশ মাটি পছন্দ করে। অপর দিকে বাদাম বেলে বা বেলে-দোআঁশ পছন্দ করে । তবে বাংলাদেশের মাটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলি দ্বারা সৃষ্টি হওয়ার কারণে সব ধরণের ফসলই কমবেশি জন্মায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মাটিই নরম, হালকা, ধুলিময় ও কর্ষণযোগ্য। মাটি বলতে তাকেই বোঝায় যেখানে ফসল জন্মায়, বন সৃষ্টি হয় আর গবাদিপশু বিচরণ করে । একজন কৃষককে যখন মাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি ঝটপট বলে থাকেন যে ভূ-ত্বকের গভীরে যতটুকু লাঙলের ফলা পৌছে, তাই মাটি এবং ফসল উৎপাদনের উপযোগী। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠের ১৫-১৮ সেমি. গভীর স্তরকে মাটি বলে ।

অতএব, ফসল উপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য এ স্তরেই নিহিত। বাংলাদেশের মাটি যে কোন ফসল উৎপাদনের জন্যই কমবেশি উপযোগী । যদিও মাটির বৈশিষ্ট্য অঞ্চল ভেদে ভিন্ন হবেই এবং সে কারণে দেশের কোথাও ধান উৎপাদন অধিক ফলপ্রসু বিবেচিত হতে পারে আবার অন্য স্থানে ধান ভিন্ন অন্য ফসলের জন্য অধিক উৎপাদনশীল হতে পারে । নিম্নে প্রধান কয়েকটি ফসলের উপযোগী মৃত্তিকা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো ।

ধানচাষোপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য

১) ধান উৎপাদনের জন্য এঁটেল ও এঁটেল দোঁআশ মাটি খুবই কার্যকর। যদিও বেলেমাটি বা কংকর মাটি ছাড়া সব মাটিই ধান চাষের জন্য বিবেচিত হতে পারে ।

২) অধিক জৈব পদার্থ সম্পন্ন অম্লত্বক হতে নিরপেক্ষ মাটির অবস্থা ধান চাষের জন্য অধিক ফলপ্রসু। ৩) ধানের জাতের বৈচিত্র্য অনুসারে উঁচু মাঝারী বা নীচু যে কোন জমিতে ধান চাষ করা যায় ।

গম চাষোপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য

১) দোআঁশ অথবা মাঝারি দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য ব্যাপক উপযোগী। অধিকন্তু এটেল দোআঁশ মাটিও গমের চাষের জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে ।

২) উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি গম চাষের জন্য উপযুক্ত। হাওড় বা বিল অঞ্চল গম চাষের জন্য অনুপযোগী ।

৩) সহজে পানি নিষ্কাশিত হয় এমন ভারী মাটিতে (যেমন, এঁটেল ও এঁটেল দোআঁশ) গমের চাষ করা যেতে পারে ।

৪) লবণাক্ত মাটি গম চাষের অনুকুল নয়।

পাট চাষোপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য

১) পলিবাহিত উর্বর সমতল ভূমি পাটের জন্য সর্বোত্তম ।

২) দোআঁশ ও বেলেদোআঁশ মাটিও পাট ভালো জন্মে ।

৩) সাদা পাট অধিকতর পানি সহিষ্ণু বিধায় সাধারণত নিচুজমি, এমনকি জলাবদ্ধ জমিতেও চাষ করা যায় ।

৪) মাঝারি বা নিম্নমাঝারী জমি তোষাপাটের জন্য অধিকতর উপযোগী, সেজন্য জলাবদ্ধতা এ পাটের জন্য ক্ষতিকর ।

৫) ৫.০-৮.৬ অম্লমানের মাটি পাট ফলানোর জন্য উপযোগী ।

গোল আলু চাষযোগ্য মাটির বৈশিষ্ট্য

১) আলু উৎপাদনের জন্য দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি সবচাইতে উপযোগী।

২) জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ, নরম, ঝুরঝুরে এবং বায়ু চলাচল উপযোগী মাটিতে আলুর চাষ ভালো হয় ।

৩) সুনিষ্কাশিত গভীর এবং কিছুটা অম্লত্ব মাটির ক্ষেত্র বিশেষ উপযোগী। যেহেতু এই অবস্থায় স্কেভিস রোগের প্রাদুর্ভাব কমে যায় ।

টমেটো চাষোপযোগী মাটির বৈশিষ্ট্য

১) বেলে ও কংকরময় মাটি ছাড়া যে কোন মাটি টমেটো চাষ উপযোগী।

২) ক্ষেত্র বিশেষে জৈব সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেলে মাটিতেও টমেটো চাষ করা সম্ভব ।

৩) দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি টমেটো চাষের জন্য উৎকৃষ্ট ।

৪) নিরপেক্ষমাত্রার অম্লমান সমৃদ্ধ মাটিতে টমেটোর উৎপাদন ভালো হয় ।

মৃত্তিকাভিত্তিক পরিবেশ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

মাটির বৈশিষ্ট্য বলতে মাটির শ্রেণি, জৈব পদার্থের মাত্রা, পটাশজনিত খনিজের মাত্রা ও অম্লমান মাত্রা এবং মাটির বন্ধুরতাকে বোঝায় । মাটির প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাংলাদেশকে ত্রিশটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। কোনো একটি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে সে অঞ্চলের মাটির প্রতিনিধিত্ব করে। কৃষি কর্মকান্ডের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হলো মাটির বৈশিষ্ট্য ও বন্ধুরতা অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করা।

মাটির বৈশিষ্ট্যভিত্তিক ফসল কৃষি কাজের একটি অত্যাবশ্যক প্রযুক্তি । এই প্রযুক্তি যত নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা যাবে কৃষি কাজের ফলাফলও তত বেশি লাভজনক হবে । মাটির গঠন ও প্রকৃতি অনুযায়ী ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলকে নিম্নোক্ত ৫টি ভাগে ভাগ করা যায় । এই অঞ্চলগুলোর মাটির বৈশিষ্ট্যভিত্তিক ফসল নির্বাচন দেখানো হলো।

১। দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি অঞ্চল

২। কাদা মাটি অঞ্চল

৩। বরেন্দ্র অঞ্চল ও মধুপুর অঞ্চল

৪ । পাহাড়ি ও পাদভূমি অঞ্চল

৫ । উপকূলীয় অঞ্চল

দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি অঞ্চল

১) মাটি দোআঁশ থেকে পলি দোআঁশ প্রকৃতির ।

২) মাটিতে জৈব পদার্থের মাত্রা অল্প থেকে মাঝারি ।

৩) দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটির অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা যথাক্রমে ৫.২-৬.২ এবং ৪.১-৬.১ পর্যন্ত ।

নির্বাচিত ফসল

এই শ্রেণির মাটি প্রায় সকল ধরণের ফসলের জন্য উপযোগী । চাষপদ্ধতি বৃষ্টি নির্ভর কিংবা সেচ নির্ভর উভয়ই হতে পারে । রবি মৌসুমের জন্য গম, মূলা, টমেটো, ফুলকপি, বাধাকপি, মরিচ, আখ, আলু, মুগ, সরিষা ইত্যাদি অগ্রগন্য । খরিপ মৌসুমের জন্য রোপা আমন, রোপা আউস, পাট, তিল, বেগুন ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে ।

নির্বাচিত ফসল

এ অঞ্চলের মাটি ধান চাষের জন্য খুবই উপযোগী । সেচ ব্যবস্থাপনায় রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসলও জন্মানো সম্ভব ।

বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চল

১) উঁচু ও মাঝারি উঁচু ভূমি বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ।

২) মাটির বৈশিষ্ট্য দোআঁশ প্রকৃতির যা নিম্নমাত্রার জৈব পদার্থ ধারন করে ।

৩) মাটির অম্লমান সাধারনত ৫.৫-৬.৫ ।

 

মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

 

উপযোগী ফসল

সেচ সুবিধা থাকলে রবি মৌসুমে বোরো, আখ, আলু, গম, সরিষা, মসুর, টমেটো, ছোলা, বাঁধাকপিসহ শীতকালীন সবজি এবং খরিপ মৌসুমে রোপা আউশ, রোপা আমন, পাট, ঢেঁড়শ, মুগ প্রভৃতি ভালো জন্মে । বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসেবে আলু, সরিষা, মসুর, ছোলা, কাউন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

পাহাড় ও পাদভূমি অঞ্চল

১) খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, আখাউড়াসহ কিছু জেলার পাহাড়ী অঞ্চল এ মৃত্তিকা শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত ।

২) মাটির প্রকৃতি দোআঁশ সদৃশ্য যাতে সামান্য মাত্রার জৈব পদার্থ বিদ্যমান ।

৩) মাটির অম্লমান-৫-৫.৭

নির্বাচিত ফসল

বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসেবে রবি মৌসুমে গম, আখ, সরিষা, মসুর, ছোলা এবং খরিপ মৌসুমে রোপা আমন, পাট চাষ করা যেতে পারে। সেচ সুবিধা থাকলে রবি মৌসুমে আখ, মসুর ডাল এবং খরিপ মৌসুমে ধৈঞ্চা লাভজনক বিবেচিত হতে পারে ।

উপকূলীয় অঞ্চল

১) বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি এ শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত যেমন-ভোলা, সেন্টমার্টিন, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও বরিশালসহ সকল সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ।

২) মাটি দোআঁশ এবং বেলে ও পলিদোআঁশ প্রকৃতির

৩) নিম্নমাত্রার জৈব পদার্থের উপস্থিতি বিদ্যমান ।

৪) মাটির অম্লমান মাত্রা ৭.০-৮.৫ ।

নির্বাচিত ফসল

বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে রবি মৌসুমে গম, সরিষা, মুগ, মরিচ, সীম, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন এবং খরিপ মৌসুমে রোপা আউশ, পাট, কাকরোল উল্লেখযোগ্য । অপরদিকে সেচ সুবিধা থাকলে রবি মৌসুমে বোরো, টমেটো, আলু, তরমুজ, মুগ, মরিচ এবং খরিপ মৌসুমে রোপা আমন এবং রোপা আউশ চাষ করা যেতে পারে ।

শিক্ষার্থীর কাজ

শিক্ষার্থীরা মাটির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করে এর উপর প্রতিবেদন তৈরি করবেন।

 

মাটি ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ফসল নির্বাচন

 

সারসংক্ষেপ

মাটি ফসল উৎপাদনের প্রধান মাধ্যম। বৈশিষ্ট্য ভেদে মৃত্তিকাকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় যেমন: বেলে দোআঁশ, | পলি দোআঁশ, এঁটেল ইত্যাদি। আবার অঞ্চলভেদেও মাটির বৈশিষ্ট্য ভিন্নরূপ হয় এবং বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় যেমন, পলি দোআঁশ মাটি অঞ্চল, বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চল, পাহাড় ও পাদভূমি অঞ্চল।

যেহেতু এসকল শ্রেণির মাটি | বৈশিষ্ট্য ভিন্ন প্রকৃতির, তাই এ সকল জমিতে কৃষি উৎপাদনের জন্য ফসল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে । মাটি ভেদে ফসলের উৎপাদন যেহেতু ভিন্ন হয়, তাই অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য মাটির বৈশিষ্ট্য এবং সেই সাথে মাটির উপযোগী ফসল নির্বাচনের দিক সম্পর্কেও জানতে হবে ।

 

Leave a Comment