মৃত্তিকার ঘনত্ব

মৃত্তিকার ঘনত্ব – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের, ২ নং ইউনিটের ২.৪ নং পাঠ। ঘনত্ব যে কোন পদার্থের একটি ভৌত ধর্ম। সংজ্ঞা হিসেবে আমরা জানি, কোন পদার্থের একক আয়তনের ভরকে এর ঘনত্ব বলা হয়।

 

মৃত্তিকার ঘনত্ব

 

মাটি

 

ভরের একক গ্রাম এবং আয়তনের একক ঘন সে.মি ( cm বা c.c) হওয়ায় ঘনত্বের একক হলো গ্রাম / ঘন সে.মি. (g/cm’)। যেমন : পানির ঘনত্ব ১ গ্রাম / ঘন সে.মি., পারদের ঘনত্ব ১৩.৫ গ্রাম/ ঘন সে.মি। যেহেতু মৃত্তিকা একটি পদার্থ সেহেতু এর অবশ্যই ঘনত্ব রয়েছে। ঘনত্ব মৃত্তিকার একটি অন্যতম ভৌত গুণ। মৃত্তিকার ঘনত্ব প্রধানত দুই প্রকার। যথা—

১।  আয়তনী ঘনত্ব (Bulk density)
২। কণা ঘনত্ব (Particle denisty )

 

মাটি

 

আয়তনী ঘনত্ব (Bulk density) :

একক আয়তনের শুকনো মৃত্তিকার ভরকে মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব বলে। মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব বের করার সময় মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসরের (Pore space) আয়তনকে হিসেব করা হয়। রন্ধ্র পরিসর হলো মৃত্তিকা কণার মধ্যকার বায়ু দ্বারা দখলকৃত স্থানের আয়তন। আয়তনী ঘনত্ব বের করার পূর্বে মৃত্তিকাকে ১০৫° সে. তাপমাত্রায় চুল্লীতে শুকানো হয়। ফলে মৃত্তিকা থেকে আর্দ্রতা অর্থাৎ জলীয় অংশ দূরীভূত হয়। মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়—

 

মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্বের সূত্র

 

আয়তনী ঘনত্ব মৃত্তিকার চাপবদ্ধতা (Compactness) প্রকাশ করে। আয়তনী ঘনত্ব যত বেশি হবে মৃত্তিকা তত বেশি চাপবদ্ধ (Compact) বুঝাবে। বিপরীতক্রমে, আয়তনী ঘনত্ব যত কম হবে মৃত্তিকা তত ঝুর ঝুরে হবে। সেজন্য আয়তনী ঘনত্ব দ্বারা জমিতে উদ্ভিদের শিকড়ের বৃদ্ধি, পানি চলাচল, বায়ুর পরিমাণ এবং দৃঢ় স্তরের (Hardpan) উপস্থিতি জানা যায়। এসব জেনে সহজেই মৃত্তিকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়। এছাড়া মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্বের দ্বারা এর পানি পরিশোষণ ক্ষমতা ও বায়ু চলাচল নির্ণীত হয়।

সাধারণত কৃষি মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব ১.১১.৪ গ্রাম/ সি.সি.। খনিজ ও জৈব মাটির আয়তনী ঘনত্ব যথাক্রমে ১.১-১.৮ গ্রাম / সি.সি. ও ০-০.৫ গ্রাম/সি.সি । মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসর বাড়ার সাথে সাথে আয়তনী ঘনত্ব হ্রাস পায়। মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলী জানার জন্য কণা ঘনত্বের চাইতে আয়তনী ঘনত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব যত কম সে মাটির ভৌত ধর্মাবলী চাষের জন্য তত বেশি উপযোগী। ভূ-পৃষ্ঠের যত গভীরে যাওয়া যায় আয়তনী ঘনত্ব তত বেড়ে যায়। জমিতে জৈব পদার্থ/জৈব সার যোগ করলে জমির মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব কমে যায়।

 

মাটি

 

কণা ঘনত্ব (Particle density):

মৃত্তিকার কঠিন অংশের ঘনত্বকে কণা ঘনত্ব নামে অভিহিত করা হয়। কণা ঘনত্বে মৃত্তিকার তরল (পানি) ও গ্যাসীয় (বাতাস) অংশকে বিবেচনা করা হয় না। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, মৃত্তিকা কণার (Soil particles) একক আয়তনের ভরকে কণা ঘনত্ব (Particle density) বলা হয় ( The particle density of soil solids is defined as the mass per unit volume of soil particles) | | গ্রাম / সি.সি. এককে প্রকাশ করা হয়। কণা ঘনত্বকে নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় ঃ

 

মৃত্তিকার কণা ঘনত্বের সূত্র

 

কণা ঘনত্বে রন্ধ্র পরিসর (Pore space) কে বিবেচনা করা হয় না। এ ঘনত্ব মৃত্তিকায় জৈব ও অজৈব পদার্থের উপস্থিতি নির্দেশ করে। খনিজ প্রধান মাটির কণা ঘনত্ব ২.৬০ -২.৭০ গ্রাম / সি.সি. হয়ে থাকে। নিরক্ষীয় অঞ্চলের মৃত্তিকা যেখানে লৌহ অক্সাইড বেশি থাকে সেখানে কণা ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। অপরপক্ষে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মৃত্তিকায় নিম্ন কণা ঘনত্ব হয়ে থাকে। উচ্চ জৈব পদার্থ সম্পন্ন মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব ১.২-১.৭ গ্রাম / সি.সি.। মৃত্তিকার উপরের স্তরে তুলনামূলকভাবে জৈব পদার্থ বেশি থাকে বিধায় মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রের (Profile) উপরের স্তরে নিম্ন কণা ঘনত্ব এবং নিচের স্তরে উচ্চ কণা ঘনত্ব হয়ে থাকে। সাধারণভাবে খনিজ মাটির কণা ঘনত্ব ২.৬৫ গ্রাম/ সি.সি. ধরা হয়। মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব সর্বদাই আয়তনী’ ঘনত্বের চাইতে বেশি হয়ে থাকে।

 

মাটি

 

অনুশীলন ( Activity) :

মৃত্তিকা কণা ঘনত্ব ও আয়তনী’ ঘনত্বের পার্থক্য নির্দেশ পূর্বক একটি তালিকা তৈরি করুন।

কৃষিতে মৃত্তিকা ঘনত্বের গুরুত্ব (Importance of soil density in agriculture):

মৃত্তিকা ঘনত্বের ওপর কৃষি কাজে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ভরশীল। নিচে সংক্ষেপে কৃষিতে মৃত্তিকা ঘনত্বের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো :

(১) মৃত্তিকায় বায়ু চলাচল, পানির অনুপ্রবণ (water infiltration), অণুজৈবিক কার্যাবলী ইত্যাদি ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। আয়তনী’ ঘনত্ব বেশি হলে মৃত্তিকায় বায়ু চলাচল, অণুজৈবিক কার্যাবলী ও পানির অনুসরন কমে যায়। ফলে উদ্ভিদের শিকড়ের বৃদ্ধি ও বিস্তার কম হয়। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ যোগ করে অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে।

(২) আয়তনী’ ঘনত্ব বেশি হলে মৃত্তিকা শুকানোর সময় ফেটে যেতে পারে। (৩) মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব বেশি হলে বায়ু চলাচল কমে যায়। উচ্চতর কণা ঘনত্ব ভারী খনিজের আধিক্য বুঝায়। ভারী খনিজের আধিক্যে অনেক ফসলেরই উৎপাদন ব্যাহত হয়।

মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসর ( Soil pore space) :

কোন মৃত্তিকার জৈব ও অজৈব অংশ ব্যতিত অবশিষ্ট অংশকে রন্ধ্র পরিসর (pore space) বলে। মৃত্তিকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ইহা বায়ু ও পানি দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। আকার অনুসারে মৃত্তিকায় দু’ধরণের রন্ধ্র দেখা যায় :

(১) বড় রন্ধ্র (Macro pore)

(২) অণু রন্ধ্র (Micro pore)

সাধারণত বড় রন্ধ্রে বাতাস এবং অণু রন্ধ্রে পানি থাকে। কোন স্থানের মৃত্তিকায় শতকরা ৫০ ভাগ রন্ধ্র পরিসর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন মৃত্তিকার আয়তনী’ ঘনত্বকে কণা ঘনত্ব দ্বারা ভাগ করে ১০০ দ্বারা গুণ করলে এর রক্তৃতা (porosity ) পাওয়া যায়।

 

মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসর এর সূত্র

 

 

মৃত্তিকা রন্ধতার গুরুত্ব ( Importance of soil porosity ) :

উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মৃত্তিকা হতে আয়নরূপে অপরিহার্য খনিজ উপাদান ( N, P, K, Zn, s ইত্যাদি) শোষণ করে থাকে। মৃত্তিকা হতে খনিজ উপাদান পরিশোষণে তাই মৃত্তিকার ভিতর উদ্ভিদের শিকড়ের বিস্তার ও পানির উপস্থিতি আবশ্যক। মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসরের উপস্থিতি উল্লিখিত দুটি শর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসরের গুরুত্বকে নিচে তুলে ধরা হলো :

(১) কৃষি জমির জন্য মৃত্তিকা রন্ধতা (soil porosity) একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৃত্তিকা বায়ু ও পানির চলাচল এর রন্ধ্রতার ওপর নির্ভরশীল। রন্ধ্রতার পরিমাণ কম হলে মৃত্তিকায় বায়ু ও পানি চলাচল বিঘ্নিত হয়। ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়নও বাধার সম্মুখীন হয়।

(২) মৃত্তিকা রক্ত পরিসরের আকার ও পরিমাণ মৃত্তিকায় পানি পরিশোষণ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া রন্ধ্র পরিসরের আকার ও সংখ্যার ওপর উদ্ভিদের পানির প্রাপ্যতাও নির্ভর করে।

(৩) মৃত্তিকা রক্ত পরিসরের আকার ও পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ফসলে সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাপনা নির্ণীত হয়।

Leave a Comment