মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান

আজকের আলোচনার বিষয় হলো মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান। এই পাঠটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের “স্কুল অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট” এর বিএজেড স্তরের “বাউবি বিএই ১২০৪ – মৃত্তিকা বিজ্ঞান” কোর্সের ইউনিট ৩, “বাংলাদেশের কৃষি” এর পাঠ ৩.১ অন্তর্ভুক্ত।

মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান

মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান

 

মৃত্তিকায় উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থগুলিকে মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদান বলা হয়। বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকায় রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ ও গঠন ভিন্ন হয়, যা নির্ভর করে মাটির ধরন, ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু ও পরিবেশগত অন্যান্য কারণের উপর। মৃত্তিকার রাসায়নিক গঠন মাটির উর্বরতা, গঠন ও কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মৃত্তিকার প্রধান রাসায়নিক উপাদান

মৃত্তিকার প্রধান উপাদান হিসেবে সাধারণত সিলিকন অক্সাইড (SiO₂) ও এলুমিনিয়াম অক্সাইড (Al₂O₃) পাওয়া যায়, যা মোট মাটির ওজনের প্রায় ৮০-৮৫% অংশ দখল করে। এছাড়াও জৈব পদার্থ ও অন্যান্য মৌলিক পুষ্টি উপাদান মিলে মোট মৃত্তিকার প্রায় ৯৮% গঠন করে। বাকি অংশে থাকে বিভিন্ন খনিজ ও অণুজীব।

মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদানের তালিকা

উপাদানরাসায়নিক সংকেতভূমিকা বৈশিষ্ট্য
সিলিকন অক্সাইডSiO₂মৃত্তিকার প্রধান খনিজ, মাটির গঠন ও কঠোরতা বৃদ্ধি করে।
এলুমিনিয়াম অক্সাইডAl₂O₃মাটির বেসিক কাঠামো গঠন করে।
আয়রন অক্সাইডFe₂O₃মাটির রঙ (লাল, হলুদ) নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
ক্যালসিয়াম কার্বনেটCaCO₃মাটির pH নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পটাশিয়ামKউদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান।
ফসফরাসPউদ্ভিদের শক্তি ও বৃদ্ধি বাড়ায়।
নাইট্রোজেনNউদ্ভিদের পাতা ও শাখা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
জৈব পদার্থজীবজন্তুর অবশেষ, মাটির উর্বরতা ও পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
জলH₂Oরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও পুষ্টি দ্রবণীয় করে।

 

মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদানের ভিন্ন ধরণের মাটিতে উপস্থিতির তুলনামূলক পরিমাণ (শতকরা)

উপাদানবেলা (Sand) মাটি (%)এঁটেল (Clay) মাটি (%)দোআঁশ (Loam) মাটি (%)
সিলিকা (SiO₂)৮৪-৯২৬৪-৬৫মধ্যম
এলুমিনা (Al₂O₃)৩-৪৯-১৪৩-৪
আয়রন অক্সাইড (Fe₂O₃)মধ্যম
ক্যালসিয়াম অক্সাইড০.০৬-০.৪১-২০.০৬-০.৪
ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড০.২৯-০.৫২১-৩০.২৯-০.৫২
পটাশিয়াম অক্সাইড০.১৪-০.৭০.১৪-০.৭০.১৪-০.৭
সোডিয়াম অক্সাইড০.০১-০.০৮অপ্রচলিত১ (দোআঁশে)
ফসফরাস পেন্টা অক্সাইড০.০১-০.৩০.০১-০.৩০.০১-০.৩

(সূত্র: মজুমদার, ১৯৮৫)

 

মৃত্তিকার রাসায়নিক উপাদানের বিভিন্ন অবস্থা

মৃত্তিকার উপাদানগুলো তিনটি অবস্থায় থাকে:

১. উদ্ভিদের গ্রহণ অযোগ্য: যেমন প্রোটিন, যা সরাসরি উদ্ভিদের জন্য প্রাপ্য নয়।

২. বিনিময়যোগ্য বা কোলয়েডের সাথে যুক্ত: যেমন ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদি, যা মাটির কণার সাথে আটকে থাকে এবং সময়ে সময়ে উদ্ভিদের জন্য সরবরাহ হয়।

৩. দ্রবণে বিদ্যমান আয়ন: উদ্ভিদ যখন মাটির দ্রবণে থাকে, তখন তা গ্রহণ করে।

শুষ্ক অঞ্চলের মৃত্তিকার বিশেষতা

শুষ্ক এলাকায় ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকে। এছাড়া বিভিন্ন মৃত্তিকায় এলুমিনিয়াম, লৌহ, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, টাইটানিয়াম অক্সাইড, ভ্যানাডিয়াম, সেলোনিয়াম, আয়োডিন ও ফ্লোরিনের পরিমাণ বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান থাকে।

জৈব পদার্থের গুরুত্ব

অধিকাংশ কৃষি জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ সাধারণত ২% এর নিচে থাকে, যা মাটির উর্বরতার জন্য অপর্যাপ্ত। তবে বনভূমি, আবর্জনা পচানো স্থল এবং পিট মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি। জৈব পদার্থ মৃত্তিকায় পানি ধারণ ক্ষমতা, পুষ্টি চক্র এবং মাটির গঠন উন্নত করে।

 

মৃত্তিকায় ভারী খনিজ উপাদান:

মৃত্তিকায় খনিজ ও জৈব উপাদান ছাড়াও কিছু ভারী ধাতব উপাদান (Heavy Metals) অল্প পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। এদের সাধারণত “ট্রেস এলিমেন্টস” বা “অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে বিদ্যমান উপাদান” বলা হয়। এসব উপাদান একদিকে যেমন প্রাকৃতিকভাবে মৃত্তিকায় থাকে, অন্যদিকে শিল্প ও কৃষিজ দূষণের মাধ্যমে অতিরিক্তভাবে মৃত্তিকায় জমা হতে পারে।

 

ভারী খনিজ উপাদান কী?

ভারী খনিজ উপাদান বলতে বোঝায় এমন ধাতব বা অর্ধধাতব মৌল, যাদের ঘনত্ব সাধারণত ৫ গ্রাম/সেমি³-এর বেশি এবং যারা কম ঘনত্বে হলেও বিষাক্ত প্রভাব ফেলে। এদের অধিকাংশই বিষাক্ত এবং মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে থাকলে মৃত্তিকার উর্বরতা, ফসলের গুণমান এবং মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

মৃত্তিকায় সাধারণত পাওয়া যায় এমন ভারী খনিজ উপাদানসমূহ:

ক্রমভারী খনিজ উপাদানরাসায়নিক প্রতীকউৎস/প্রবেশপথস্বাস্থ্যে কৃষিতে প্রভাব
সীসা (Lead)Pbব্যাটারি, রঙ, বর্জ্যস্নায়ু ক্ষতি, শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত
ক্যাডমিয়ামCdসার, শিল্পবর্জ্য, প্লাস্টিককিডনি বিকল, ক্যান্সার, হাড় দুর্বলতা
পারদ (Mercury)Hgথার্মোমিটার, ব্যাটারি, শিল্প দূষণস্নায়ুতন্ত্র বিকল, মানসিক ভারসাম্যহীনতা
আর্সেনিকAsভূগর্ভস্থ পানি, কীটনাশকক্যান্সার, চর্মরোগ, হৃদরোগ
ক্রোমিয়ামCrচামড়া শিল্প, রঙ, রাবারত্বক ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা
নিকেলNiইস্পাত, সার, ব্যাটারিঅ্যালার্জি, ক্যান্সার
তামা (Copper)Cuবৈদ্যুতিক তার, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণঅধিকমাত্রায় ক্ষতিকর, কমমাত্রায় প্রয়োজনীয়
জিংকZnসার, দস্তার পাত্র, শিল্পবর্জ্যঅধিকমাত্রায় গ্যাস্ট্রো সমস্যার সৃষ্টি
লোহা (Iron)Feপ্রাকৃতিকভাবে মৃত্তিকায় বিদ্যমানসাধারণত ক্ষতিকর নয়; তবে অতিরিক্ত মাত্রায় সমস্যা

 

ভারী খনিজ উপাদানের উৎস:

  1. শিল্পবর্জ্য কারখানা নিঃসরণ: চামড়া শিল্প, ধাতু প্রক্রিয়াজাত শিল্প, কাগজ কল ইত্যাদি থেকে ভারী ধাতব উপাদান নির্গত হয়।
  2. রাসায়নিক সার কীটনাশক: বিশেষত ফসফেট সার এবং আর্সেনিকযুক্ত কীটনাশক ভারী ধাতুর অন্যতম উৎস।
  3. শহরাঞ্চল যানবাহনের ধোঁয়া: সীসাযুক্ত জ্বালানি, পুরনো রঙ ও ব্যাটারির মাধ্যমে সীসা ও ক্যাডমিয়াম ছড়ায়।
  4. ভূ-গর্ভস্থ প্রাকৃতিক উৎস: মাটির ভৌম-গঠন অনুসারে কিছু ভারী ধাতু প্রাকৃতিকভাবেই বেশি মাত্রায় থাকতে পারে।

 

প্রভাব ও ঝুঁকি

  • কৃষিতে প্রভাব: ভারী ধাতব উপাদান উদ্ভিদের কোষ বিভাজন, প্রোটিন সংশ্লেষণ এবং ক্লোরোফিল গঠনে বাধা দেয়, ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন কমে।
  • মানব স্বাস্থ্যে প্রভাব: ভারী ধাতব উপাদান খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে মানুষের শরীরে জমা হয়ে ক্যান্সার, কিডনি রোগ, স্নায়ুবিক সমস্যা ইত্যাদি ঘটায়।

 

বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিকতা

বিশেষ করে আরসেনিক ক্যাডমিয়াম সমস্যা বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে গুরুতর। শিল্প এলাকা ও সেচে ব্যবহৃত দূষিত পানির কারণে মৃত্তিকায় ভারী ধাতব উপাদানের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

Leave a Comment