মৃত্তিকার সংযুক্তি

মৃত্তিকার সংযুক্তি – বিষয়টি আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের ইউনিট ২ এর পাঠ ২.৩ নং পাঠ। মৃত্তিকা বুনট সম্পর্কে আমরা পূর্ববর্তী পাঠে আলোচনা করেছি। বর্তমান পাঠে মৃত্তিকা সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা করবো। মৃত্তিকা সংযুক্তি মৃত্তিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম। ফসল উৎপাদনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া নির্মাণ কাজ অর্থাৎ দালান কোঠা, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ কাজে মৃত্তিকা সংযুক্তি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

মৃত্তিকার সংযুক্তি

মৃত্তিকার সংযুক্তি

 

মৃত্তিকা সংযুক্তি কী (What is soil structure)?

মাটি কণা যেমন— বালি, পলি ও কর্দমকণা পরস্পর যুক্তভাবে সজ্জিত হওয়ার ফলে মাটির দলা যে বিন্যাস বা আকার প্রাপ্ত হয় তাকে মাটির সংযুক্তি বলা হয়।
মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ, আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Fe203 ও Al2O3) এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট (CaCO3 MgCO3) এ সকল সিমেন্টিং পদার্থ মাটির দলা গঠনে সহায়তা করে। মৃত্তিকার সংযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে নিম্নবর্ণিত শব্দসমূহ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

মাটির দলা বা পেড (Ped) এবং ঢেলা (Clod) মাটির সংযুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

পেড (Ped) : প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মাটির সংযুক্তির একক।

ঢেলা (Clod) : কর্মনজনিত কারণে ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট মাটির সংযুক্তির একক। দলা খন্ড (Fragments) : প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট দলার (peds) ভগ্নাংশ।

কংকর বা নুড়ি (Concretion) : মাটিতে দ্রবীভূত লবণ অধঃক্ষেপিত হয়ে কংকর সৃষ্টি হয়।

 

মাটি

 

মাটির সংযুক্তি শ্রেণিবিন্যাস (Classification of soil structure):

মাটির সংযুক্তিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

A. প্রকার অনুসারে (Classification according to Type)।

B. শ্রেণি অনুসারে (Classification according to Class)।

C. ক্রম অনুসারে (Classification according to Grade)।

 

A. সংযুক্তির প্রকার :

দলার আকৃতির ও জ্যামিতিক আকার এর ওপর ভিত্তি করে মাটির সংযুক্তিকে ৪ (চার) ভাগে ভাগ করা যায়

i. থালাকৃতি (Plate like)

ii. প্রিজমাকৃতি (Prism like )

iii. চৌকাকৃতি (Block like )

iv. উপগোলাকৃতি (Sphere like)

 

B. সংযুক্তির শ্রেণি বা দল :

মাটির দলার আকার (Size) অনুসারে প্রধানত ৫টি শ্রেণির সংযুক্তি উল্লেখ করা যায়। এগুলো নিম্নরূপ :

i. অতি সূক্ষ্ণ বা অতি পাতলা (Very fine or very thin)। যেমন এঁটেল, বেলে, এঁটেল দোআঁশ।

ii. সূক্ষ্ণ বা পাতলা (Fine or thin

iii. মধ্যম (Medium)

iv. মোটা বা পুরু (Coarse or thick

V. খুব মোটা বা খুব পুরু (Very coarse or vrey thick )

 

সংযুক্তি ক্রম ঃ

মাটির দলার এককগুলো স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা অনুসারে সংযুক্তিকে ৪ (চার) ভাগে ভাগ করা যায় :

i. সংযুক্তিহীন (Structureless)

ii. দুর্বল (Weak)

iii. মধ্যম (Moderate )

iv. কঠিন (Strong )

 

মাটি

 

সংযুক্তি প্রকারের বিভিন্ন শ্রেণির বর্ণনা:

i. থালাকৃতি (Plate Like):

এই সংযুক্তির অন্তর্ভূক্ত পেডগুলো অনুভূমিক দিক (Horizontal) বরাবর উন্নতি লাভ করে প্লেটাকার, পাতাকৃতি বা লেন্স আকৃতি সৃষ্টি করে। এ আকৃতি আবার দু’প্রকার যথা :

(ক) প্লেটি (Platy) :

দলাগুলো ( aggregates ) প্লেটের মত। প্লেটগুলো একটি অন্যটিকে অতিক্রম করে, অপ্রবেশ্য ও পুরু (thick) | (খ) ল্যামিনার (Laminar) : সব বৈশিষ্ট্যই প্রেটির মত তবে পাতলা (thin)

ii. প্রিজমাকৃতি (Prism Like) :

এ সংযুক্তির অন্তর্ভুক্ত পেডগুলো উর্ধ্বভূমিকভাবে উন্নতি লাভ করে পিলারের মত হয়। এ সংযুক্তি আবার ২ ( দুই ) প্রকার

(ক) প্রিজমেটিক (Prismatic) :

প্রিজমাকার দলার উপরের তল যখন সমান ও মসৃন হয়। তখন তাকে প্রিজমেটিক বলা হয়।

(খ) স্তম্ভাকার (Columnar) :

প্রিজমাকার দলার উপরের তল গোলাকার হলে তাকে কলামনার বলা হয়।

iii . চৌকাকৃতি (Block like) :

এক্ষেত্রে পেডগুলো সজ্জিত হয়ে কিউবস আকার এবং মাটিকণাগুলো একত্রিত হয়ে ছয়তল বিশিষ্ট আকার ধারণ করে যাহার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা প্রায় সমান। চৌকাকার সংযুক্তি ২ প্রকার হতে পারে।

(ক) কৌণিক চৌকাকৃতি (Angular Blocky) :

যখন দলাগুলো ঘনকের মত এবং চতুস্পার্শ্বের ধারগুলো স্পষ্ট, প্রশস্থ ও তীক্ষ্ম কোণাকার হয় তখন তাকে কৌণিক চৌকাকৃতি বলে।

(খ) উপকৌণিক চৌকাকৃতি (Sub-angular Blocky) :

যখন দলার ধারগুলো অস্পষ্ট এবং কিনারা প্রায় গোলাকার হয় তখন তাকে উপকৌণিক চৌকাকৃতি বলে।

iv. উপ-গোলাকৃতি (Sphere like or spheroidal) :

দলা বা পেডের আকার মোটামুটি গোলাকার এবং সাধারণত আকারে ছোট। এই দলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

v. গ্র্যানুলার বা দানাদার ( Granular) :

যখন দলাগুলো তুলনামূলকভাবে কম রন্ধ্রযুক্ত থাকে এবং একে ভাঙ্গা যায় না তখন তাহাকে গ্র্যানুলার বলে। (খ) চূর্ণাকার গঠন বা ক্রাম্ব (Crumb) : যখন পেডগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি রন্ধযুক্ত থাকে এবং একে ভাঙ্গা যায় তখন তাহাকে ক্রাম্ব বলে।

 

মাটি

 

কৃষিতে মৃত্তিকা সংযুক্তির গুরুত্ব (Importance of soil structure in agriculture):

কৃষিতে মাটির সংযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :

(১) সংযুক্তি মাটির একটি উল্লেখযোগ্য ভৌত ধর্ম যা অন্যান্য ভৌত ধর্ম যেমন ঃ সচ্ছিদ্রতা, পানি, বায়ু চলাচল, আর্দ্রতা এবং আয়তনী ঘনত্ব ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে সংযুক্তি খুবই সম্পর্কযুক্ত।

(২) তাপমাত্রা স্থানান্তরে সাহায্য করে।

(৩) উদ্ভিদের শিকড় বিস্তারে সাহায্য করে।

(৪) জৈব পদার্থের বিয়োজন ও অণুজৈবিক কার্যাবলী বৃদ্ধি মাটির সংযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(৫) মাটির ধর্ম জানতে সাহায্য করে।

(৬) কোন মাটিতে কোন ফসল জন্মানো যাবে তাহা মাটির সংযুক্তির সাহায্যে জানা যায়।

(৭) মাটির ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়।

(৮) থালাকৃতি সংযুক্তি পানির অবাধ নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করে।

(৯) দানাকৃতি ও ক্রাম্ব সংযুক্তি মাটির সবচেয়ে ভাল অবস্থা আনায়ন করে। কৃষি কাজের জন্য এ ধরণের সংযুক্তি উত্তম।

(১০) চাষ দেওয়া, সার দেওয়া, লাইমিং করা প্রভৃতি দ্বারা সংযুক্তি প্রভাবিত হয় এবং মাটির সংযুক্তির ওপর নির্ভর করিয়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাটির কর্ষন সমাধা করা হয়।

 

 

 

মাটির সংযুক্তির উৎপত্তি (Genesis of soil structure):

আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, মাটির উৎস বস্তু (Parent material) এক দানা বিশিষ্ট যেমন: বালি প্রধান মাটি, অথবা সংহত যেমন : কর্দম প্রধান মাটি এবং এই অবস্থা হতে মাটির সংযুক্তি সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। মাটির একক দানাগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে দলা বা সংযুক্তি সৃষ্টি করে। যেমন : ডাইপোলার পানি-মৌলের আঠালো প্রভাব বারবার ভিজে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে যথাক্রমে সম্প্রসারন ও সংকুলান ঘটায় যাতে মাটিকণা সামনে পিছনে আন্দোলিত হয় এবং এভাবে মাটির দলায় ফাটল বা চিড় দেখা যায়।

পানি শুকিয়ে গেলে মাটি কণাগুলো পুণরায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দলা দৃঢ় হয়ে যায়। এ হচ্ছে মাটিতে দলা সৃষ্টিতে পানির অন্যতম কাজ। মাটিতে সংযুক্তি সৃষ্টির তত্ত্ব যা হোক না কেন এ কথা স্বীকৃত যে, একক মাটি কণাগুলোর পারস্পারিক বন্ধনের জন্য কোন প্রকার আঠালো বা বন্ধন দ্রব্য প্রয়োজন। এ সমস্ত বন্ধন দ্রব্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে মাটির কোলয়েড, রাসায়নিক লবণ ও ধনাত্মক আয়ন (Cation), উদ্ভিদ, শিকড়, অণুজীবের কার্যাবলী, চাষাবাদ ইত্যাদি।

 

মাটির বুনট ও সংযুক্তির মধ্যে পার্থক্য

 

Leave a Comment