মৃত্তিকা জীব

মৃত্তিকা জীব নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান – ১২০৪ কোর্সের ইউনিট ৪ এর,  ৪.৩ নম্বর পাঠ।

মৃত্তিকা জীব

বাংলাদেশের মৃত্তিকার শ্রেণিগত পরিচিতি , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৫ , পাঠ ৫.২

মৃত্তিকা জীব ও এদের শ্রেণিবিভাগ মমৃত্তিকায় অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জৈব পদার্থ বিয়োজন বা বিশ্লেষণ করে মাটিকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার জন্য বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। এদের অধিকাংশই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে হয়। তবে মুষ্টিমেয় কতকগুলো খালি চোখেও দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা এ জীব জগতের শ্রেণিবিভাগ করছেন।

মৃত্তিকা বড় জীব সম হকে প্রধানত দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা : মৃত্তিকা প্রাণী ও মৃত্তিকা উদ্ভিদ। এখানে মৃত্তিকা জীবের বিস্তারিত শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো। এ পাঠে মৃত্তিকাস্থিত জীব কেঁচো (বড় প্রাণী) এবং প্রোটোজোয়া, নেমাটোড ও রোটিফারস (ছোট প্রাণী) এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

Capture 45 মৃত্তিকা জীব

মৃত্তিকা জীবসম হের (মৃত্তিকাস্থ বড় প্রাণী) কার্যাবলী:

মৃত্তিকায় বড় রন্ধ্রতে বা গর্তকরে নানা প্রকার বড় প্রাণী বসবাস করে। অবশ্য এদের আকৃতি ও প্রকৃতিতে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। ইঁদুর, পোকামাকড়, মাইট, শামুক, গুগলি, কেঁচো, মিলিপেড ও সেন্টিপেড এদের মধ্যে অন্যতম। এ সকল জীবের সাধারণ কার্যাবলী এখানে দেয়া হলো :

১। মৃত্তিকা জীবসম হ মাটি ওলট পালট করে দানা বাধায় সাহায্য করে, বিশেষ করে এক স্থানের মাটি অন্যস্থানে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

২। মাটির সংযুক্তি ও বুনটের উন্নতি হয় এবং রন্ধ্র সমূহ বায়ু চলাচল সুনিশ্চিত করে।

৩। পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় ।

8। ইঁদুর, কেঁচো ও অন্যান্য পোকা মাকড়ের বাসা ও তৈরি নালা দিয়ে বায়ু ও পানি একস্থান হতে অন্যান্য স্থানে সহজে যেতে পারে।

৫। এদের মৃতদেহ পচনের ফলে মৃত্তিকার জৈব পদার্থ বাড়ে। ৫ ।

৬ । জৈব পদার্থ স্থানান্তরে সহায়তা করে।

৭। মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ায় বিশেষ করে ইঁদুর ধান, গম ইত্যাদি খড় কুটা সংগ্রহ করে যা গর্তে পচে ।

৮। মিলিপেড, সেন্টিপেড, মাইট, শামুক, গুগলি প্রভৃতি প্রাণী জৈব পদার্থ খেয়ে ফেলে এবং বিয়োজিত জৈব পদার্থ মল হিসাবে ত্যাগ করে। যা উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে।

মৃত্তিকা জীব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.৩

কেঁচো:

কেঁচো মৃত্তিকাস্থিত বড় ধরনের প্রাণী। কৃষিতে এর গুরুত্ব ব্যাপক, বিশেষ করে মাটির গঠন ও উর্বরতা ,বৃদ্ধিতে কেঁচোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এরা মাটিতে বসবাস করে এবং মাটি খেয়েই বেঁচে থাকে। কেঁচো সাধারণত ভিজে অথচ বায়ু চলাচল করে এমন মাটিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। বস্তুতঃ স্যাঁতসেঁতে মাটির এক মিটার পর্যন্ত উপরিভাগে বাস করে। রাতে খাদ্যের সন্ধানে গর্ত থেকে বের হয় কিন্তু দিনের আলোতে গর্তে থাকে। বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে গর্ত ডুবে গেলে এরা নিকটবর্তী উপযুক্ত স্থানে চলে যায় তবে শুকনো মাটি এদের বসবাসযোগ্য নয়। উর্বর মাঝারি উঁচু জমিতে অধিক হারে থাকে কিন্তু শুষ্ক বেলে মাটি, জলাবদ্ধস্থান ও নিচু জমিতে এদের সংখ্যা কম। অম্ল মাটিতে সকল প্রজাতির কেঁচো বসবাস করতে পারে না।

গোটাবিশ্বে প্রায় সাত হাজার কেঁচো প্রজাতি রয়েছে। তন্মধ্যে দুশ’ প্রজাতির কেঁচো মাটিতে দেখা যায় । ভারত বর্ষে পেরিটিমা পাসথুমা প্রজাতিই প্রধান। তবে শীত প্রধান দেশের মাটিতে লামব্রিকাস টেরিট্রিস বা নৈশ কেঁচো ও এ্যলোবোফোরা ক্যালিজিনোসা বা গোলাপী কেঁচো অধিক পাওয়া যায়। মূলতঃ কৃষি জমিতে নৈশ, গোলাপী, বাগান ও রুবেলাস এ চার প্রকার কেঁচোই সচরাচর দেখা যায়।

মৃত্তিকা জীব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.৩

মৃত্তিকা উর্বরতা বৃদ্ধিতে কেঁচোর প্রভাব:

১। এক হেক্টর জমিতে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কেঁচো বসবাস করে। এরা গর্ত করার সময় সন্মুখের প্রায় ৪৫ হাজার টন মাটি পর্যায়ক্রমে ভক্ষণ ও মল ত্যাগ করে। সাধারণত কেঁচোর মলে ব্যাকটেরিয়া ও জৈব পদার্থ থাকে।

২। মাটিতে নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশ ও ফসফরাস ইত্যাদি অনেকটা বেশি পরিমাণে গ্রহণযোগ্য অবস্থায় চলে আসে।

৩। কেঁচো মাটিতে গর্তের মাধ্যমে বায়ু পানি চলাচল বাড়ায়। আসলে কেঁচো না থাকলে উদ্ভিদের শিকড় বায়ুর অভাবে মরে যেত।

8। মাটিতে গর্ত করে মাটির ওলট পালটের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থার উন্নয়ন করে। মাটি নরম রাখে ও উর্বরতা সুনিশ্চিত করে। তাই কেঁচোকে কৃষকের বন্ধু বা প্রাকৃতিক লাঙ্গল বলে।
৫ । কতক কেঁচো পচনশীল জৈব পদার্থ ভক্ষণ করে। কেঁচোর মাটি দেখে মৃত্তিকার জৈব পদার্থের পরিমাণ অনুমান করা যায়।

৬। এরা জৈব ও খনিজ পদার্থের উত্তম মিশ্রণ ঘটিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

৭।  আয়ন বিনিময় প্রক্রিয়ায় দ্রুত সহায়তা করে।

৮। মাটির ক্ষারীয় দ্রব্য সরবরাহ সংরক্ষণ করে প্রশমতা সুনিশ্চিত করে।

৯। কেঁচোর মলে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ পাশাপাশি মাটি থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকে।

মৃত্তিকায় কেঁচোর অনুকূল অবস্থা:

১। মৃত্তিকা পানির পরিমাণ মৃত্তিকা নির্দিষ্ট মাত্রায় আর্দ্র থাকতে হবে।
২। মাটির কণা ও বুনট-এটেল মাটিতে বেশি কিন্তু বেলে মাটিতে কম কেঁচো উপস্থিত থাকে ।
৩। জৈব পদার্থ-গোবর কম্পোস্ট প্রয়োগে কেঁচো বাড়ে। জৈব পদার্থ যত বেশি হবে কেচোর পরিমাণ তত বেশি হয়ে থাকে।
8। পিএইচ-উত্তম পিএইচ মান ৬-৭ ।
৫ । মাটির উত্তাপ- অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অতি শীত ও তুষারপাতে কেঁচো কমে যায়।
৬। চাষাবাদ- অনাবাদী জমির চেয়ে আবাদী জমিতে কেঁচোর সংখ্যা বাড়ে।

 

প্রোটোজোয়া:

এরা এককোষী প্রাণী। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। আকারে এরা ব্যাকটেরিয়া থেকে বড়। এরা তিন প্রকার যথা- (১) সিলিয়েটস, ইনফিউসোরিয়া বা পক্ষল, (২) বেত্রাকার বা ফ্লাজেটেটিস্, (৩) অ্যামিবা। পক্ষলের সুতোর মত চুল থাকে, এবং বেত্রাকারের থাকে বেতের মতো বেড়ে থাকা প্রোটোপ্লাজমের অঙ্গ। তবে অ্যামিবা একটু ভিন্ন। মাটিতে ২৫০ প্রজাতির প্রোটোজোয়া দেখা যায় এবং এমনকী ভারতের মাটিতে ৪০-৫০ প্রজাতির প্রোটোজোয়া দেখা যায়। এক গ্রাম মাটিতে এদের সংখ্যা দশ লক্ষ হতে পারে।

এক গ্রাম মাটিতে পক্ষল ৮০-১০০০, বেত্রাকার ৫-১০ লক্ষ এবং অ্যামিবা ১-৫ লক্ষ থাকতে পারে। খাদ্য ও বায়ু চলাচলের সুবিধার ওপর এদের সংখ্যা নির্ভর করে। এদের খাদ্য জৈব পদার্থ ও ব্যাকটেরিয়া। জলাবদ্ধ স্থানে কিংবা অধিক জৈব পদার্থ থাকলে এরা ব্যাকটেরিয়া খায়। এরা রোগজীবাণুও খায়। এরা মৃত্তিকায় যা কিছু করুক উর্বরতা তারমত্য ঘটে না বরং গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। এদের খাদ্য গ্রহণ ৩ রকম যথা- (১) কারো শরীরে ক্লোরোফিল থাকে ফলে স্বভোজী হয়, (২) কেহ মৃতজীবির মত খায় (৩) কেহ ব্যাকটেরিয়ার মত শক্ত খাদ্য নেয় ও হজম করে।

মৃত্তিকা জীব , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ৪ , পাঠ ৪.৩

 

নেমাটোড:

সকল প্রকার মৃত্তিকায় নেমাটোড রয়েছে। এরা দেখতে গোলাকার মাঝ খানটা একটু উঁচু, পিছন দিকটা সরু ও সুচাল; লম্বায় ০.৫-১.৫ মি.মি.। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। এক গ্রাম মাটিতে ৫০টি নেমাটোড দেখা যায় এবং এ হিসাবে একর প্রতি এদের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে চার কোটি। মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকলে এদের সংখ্যা বাড়ে। খাদ্যের ভিত্তিতে এদেরকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়ঃ ১। জৈব পদার্থ ভোজী যাদের খাদ্য বিয়োজিত জৈব পদার্থ, ২। প্রাণীভোজী- যাদের খাদ্য নেমাটোড, ব্যাকটেরিয়া, শেওলা, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া, ছোট কেঁচো প্রভৃতি।

(৩) পর ভোজী – যারা গাছের শিকড়ে প্রবেশ করে এবং কোষের ভিতর আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে পরভোজী বেশি ক্ষতিকর। এরা গাছপালার শিকড়ে প্রবেশ করে রস শোষণ করে। মটর, বরবটি, গাজর, তামাক, আলু, কুমড়া প্রভৃতি ফসলের পক্ষে এরা ক্ষতিকর। পরভোজী নেমাটোড ফসলের বিভিন্ন মারাত্বক রোগ সৃষ্টি করে।

সূত্র:

  • মৃত্তিকা জীব , পাঠ ৪.৩, ইউনিট ৪ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

Leave a Comment