মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহারিক

মৃত্তিকা বিজ্ঞান (Unit-2, Lesson 2.7) বিষয়ক আজকের আলোচনার বিষয় “মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি”। মাটির বৈশিষ্ট্য, উর্বরতা এবং উৎপাদনশীলতা নির্ধারণের জন্য সঠিকভাবে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র গবেষণা এবং বিশ্লেষণের নির্ভুলতা নিশ্চিত করতেই নয়, বরং ফসল উৎপাদন, মাটির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও সহায়ক। এ পাঠে আমরা মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের মৌলিক নীতিমালা, সঠিক পদ্ধতি, এবং নমুনা সংরক্ষণের সেরা প্র্যাকটিসগুলো নিয়ে আলোচনা করবো, যা মাটির গুণগত মান নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি , ব্যবহারিক , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ২ , পাঠ ২.৭

🔶 পাঠ শেষে আপনি —

♦ পরীক্ষার জন্য মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও পাত্রের তালিকা তৈরি করতে পারবেন।
♦ জমি থেকে মৃত্তিকার ক্ষেত্রনির্ধারিত নমুনা সংগ্রহ করতে পারবেন।
♦ সংরক্ষিত মৃত্তিকার নমুনা পরীক্ষার বিভিন্ন নির্দেশনা পালন করতে পারবেন।
♦ মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের ট্যাগ লাগানোর সঠিক নিয়ম মেনে চলতে পারবেন।

ক) মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি:

ফসলের আকাঙ্ক্ষিত ফলন না পাওয়া বা উৎপন্ন ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া অনেকাংশে মাটির গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। আকাঙ্ক্ষিত ফলন পেতে হলে মাটির বর্তমান অবস্থা ও উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন।

মৃত্তিকা উপাদান

যে পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান জৈবপদার্থ এবং খনিজ মাটিতে উপস্থিত থাকে তার উপরে মাটির মান নির্ভর করে। এই কারণে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের আগে মাটির উপাদানের ধরন জানা গুরুত্বপূর্ণ।

 

মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের উপকরণ:

উপকরণব্যবহার
(ক) কোদাল/ খোন্তা/ নিড়ানী/ বেলচা/ অগারমাটির পৃষ্ঠ থেকে নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়। অগার মূলত গভীর এবং নির্দিষ্ট আকারের মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয়।
(খ) প্লাস্টিক বালতি / পলিথিন শীটমাটির নমুনা সংগ্রহের পরে তা ভালভাবে মিশ্রণের জন্য এবং প্রাথমিক স্তরে বড় পাথর বা শিকড় আলাদা করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
(গ) পলিব্যাগ ও সুতলিনমুনা সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি নমুনাকে আর্দ্রতা, ধুলা এবং দূষণ থেকে রক্ষা করে।
(ঘ) লেবেলের কাগজ ও পেন্সিলনমুনার পরিচয় নিশ্চিত করতে এবং স্থান, তারিখ, নমুনা সংখ্যা ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন হয়। পেন্সিল ব্যবহার করা হয় কারণ এটি আর্দ্র অবস্থায়ও দীর্ঘস্থায়ী থাকে।
(ঙ) হ্যান্ড গ্লাভস এবং মাস্কনমুনা সংগ্রহের সময় হাত ও মুখকে মাটির জীবাণু ও রাসায়নিক থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়।
(চ) পিএইচ স্ট্রিপ বা ডিজিটাল পিএইচ মিটার (ঐচ্ছিক)নমুনা সংগ্রহের সময় প্রাথমিক মাটির অম্লতা নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
(ছ) পকেট নাইফ বা ছুরিশিকড়, পাথর, বা অপ্রয়োজনীয় উপাদান সরানোর জন্য ব্যবহার হয়।
(জ) নমুনা সংগ্রহের নোটবুক/ফিল্ড ডায়েরিনমুনা সংগ্রহের স্থান, সময়, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন হয়।
(ঝ) জিপিএস ডিভাইস বা মোবাইল জিপিএস অ্যাপনমুনা সংগ্রহস্থলের সঠিক স্থানাঙ্ক নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা ভবিষ্যতে মাটির মানচিত্র তৈরি করতে সহায়ক।

 

জমি থেকে কীভাবে কম্পোজিট মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করবেন:

কাজের ধাপ:

জমির ৪ সীমানা থেকে ২-৩ মিটার বা ৪-৬ হাত ভিতরে চিত্র অনুযায়ী সমান্তরালভাবে সমদূরত্ব বজায় রেখে ৯টি স্থান থেকে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করুন। রাস্তা বা বাঁধের নিকটবর্তী স্থান/পরিত্যক্ত ইটের ভাটা/সদ্য সার প্রয়োগকৃত জমি/ গোবর বা কম্পোস্ট কিংবা যে কোন আবর্জনা স্তূপীকৃত এরকম একটি মিশ্র নমুনা কেবল একটি খন্ড/প্লট হতেই নিতে হবে। একাধিক প্লটের মাটির নমুনা পরীক্ষা করতে হলে প্রতি খন্ড থেকে আলাদা মিশ্র নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।

জায়গা/ফসলের নাড়া পোড়ানো জায়গা থেকে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ করবেন না। উল্লেখ্য যে, মাটির মৃত্তিকা সংগ্রহের আগে জমির এক স্থানে গর্ত করে কর্ষণ স্তরের গভীরতা দেখে নিন। সাধারণতঃ রোপা ধানের জমিতে কর্ষণ স্তরের নিচে শক্ত “কর্ষণ তল’ থাকে, নমুনা সংগ্রহ কালে কর্ষণ তল বাদ যাবে। কর্ষণ স্তরে গভীরতা জানার পর জমির আয়তনের মতো চিত্র অনুযায়ী জমির ৯টি স্থান চিহ্নিত করুন।

পরিষ্কার কোদাল বা খন্তা বা যে কোন খনন যন্ত্রের সাহায্যে কর্ষণ স্তরের গভীরতা পর্যন্ত ‘V’ আকৃতির গর্ত করুন এবং এক পাশ থেকে ৪ আঙ্গুল পরিমাণ (৭-৮ সে.মি.) পুরু মাটির ঢাকা তুলে চাকাটির দুই পাশ এবং কর্ষণ তলের অংশে (যদি থাকে) কেটে বাদ দিয়ে চাকাটি প্লাষ্টিক বালতিতে বা পলিথিন শীটের উপর রাখুন। একইভাবে ৯টি স্থান থেকে সংগৃহিত একই পরিমাণ মাটি বালতি/পলিথিন শীটে রাখুন। উল্লেখ্য যে, হাল দেওয়া জমি থেকে মাটি এমনভাবে নিতে হবে যাতে ঢেলাযুক্ত কিংবা গুঁড়োকর্ষণ স্তরের সম্পূর্ণ অংশই সমপরিমাণে সংগ্রহ করা হয়।

ক কর্ষণ স্তর, খ- মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের উপকরণ;

গ- মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ’ পদ্ধতি, ঘ- মৃত্তিকা নমুনা সংরক্ষণে সহায়ক উপকরণ।

সংগ্রহীত মৃত্তিকার নমুনা ভালভাবে মিশ্রিত করুন:

পরিষ্কার বালতি কিংবা পলিথিন শিটে রাখা সংগৃহীত মৃত্তিকার নমুনার চাকাগুলো পরিষ্কার হতে গুড়ো করে ভালভাবে মেশান। মিশ্রিত মাটি ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে তা থেকে আধা কেজি পরিমাণ শুকনো গুড়ো মাটি পলিথিন ব্যাগে রাখুন।

 

খ)মৃত্তিকা নমুনা সংরক্ষণ পদ্ধতি:

মৃত্তিকা নমুনা সংরক্ষণের উপকরণ তালিকা:

 

ক্র.নংউপকরণসংক্ষিপ্ত বিবরণ
কাঠের শক্ত হাতুড়িমাটি বা মৃত্তিকা খণ্ড ভাঙা এবং নমুনা সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত শক্ত কাঠের হাতুড়ি।
পুরু পলিথিন শীটমাটির নমুনা শুকানো এবং ছাঁকানোর সময় মাটি ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ব্যবহৃত হয়।
প্লাস্টিক বা কাঁচের বোতলমাটির নমুনা দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়।
ফরমালিনমাটির নমুনার জীবাণুনাশক সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ।
১০ মেশ চালনিমাটি ছাঁকতে এবং কণা আকার নির্ধারণে ব্যবহৃত ছিদ্রযুক্ত চালনি।
তথ্য কার্ডনমুনা সংগ্রহের তারিখ, স্থান, গভীরতা, মাটির ধরন, সংগ্রাহকের নাম ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
স্প্যাচুলা বা খুরপিমাটি খনন, সংগ্রহ ও ছোট খণ্ডগুলো আলাদা করতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম।
মাপার স্কেল বা টেপমাটির স্তরের গভীরতা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।
নমুনা ব্যাগ বা পাত্রসংগ্রহ করা মাটির নমুনা সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ব্যাগ বা পাত্র।
১০ফলকের খুর বা কোদালমাটি খনন এবং কাটা সহজ করতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম।
১১নিরাপত্তা গ্লাভসফরমালিন বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের সংস্পর্শ থেকে হাত রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
১২লেবেল বা স্টিকারপ্রতিটি নমুনার পাত্র বা ব্যাগে নমুনার পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য লাগানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৩নোটবুক ও পেন্সিল/কলমনমুনা সংগ্রহের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ করতে ব্যবহৃত হয়।
১৪পানি স্প্রে বোতলশুকনো মাটির নমুনা ভিজিয়ে বিশ্লেষণের আগে সঠিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়।
১৫ছোট ব্রাশনমুনার মাটির ছোট কণা পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত হয়।

 

মৃত্তিকা নমুনা সংরক্ষণের ধাপসমূহ:

ধাপ নংকাজের বিবরণ
শুকানো: সংগ্রহিত মৃত্তিকা ছায়াযুক্ত স্থানে পলিথিন শীটে ছড়িয়ে দিন এবং সম্পূর্ণ শুকিয়ে নিন। সরাসরি সূর্যালোক বা অতিরিক্ত তাপে শুকানো এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তিত হতে পারে।
গুঁড়ো করা ও মিশ্রণ: শুকানো মৃত্তিকা কাঠের হাতুড়ি বা স্প্যাচুলা দিয়ে গুঁড়ো করুন এবং ভালভাবে মিশ্রণ করুন যাতে নমুনা সমজাতীয় হয়।
ছাঁকনি ব্যবহার: গুঁড়ো করা মৃত্তিকা ১০ মেশ চালনি দিয়ে ছেঁকে নিন, যাতে বড় কণা ও অমেধ্য দূর হয়।
সংরক্ষণ: ছাঁকানো মৃত্তিকা পরিষ্কার ও শুকনো পলিব্যাগ, কাঁচ বা প্লাস্টিকের বোতলে ভরে রাখুন। পাত্রটি অবশ্যই বায়ুরোধী হতে হবে।
লেবেলিং: প্রতিটি পাত্রে স্পষ্টভাবে লেবেল লাগান, যাতে নিম্নলিখিত তথ্য থাকে: নমুনা সংগ্রহের তারিখ, স্থান, গভীরতা, জমির নাম, পূর্ববর্তী ফসল, সার প্রয়োগের ইতিহাস ইত্যাদি।
সংরক্ষণের স্থান: প্রস্তুতকৃত নমুনা ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে, যেমন আলমারি, শেল্ফ বা ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন। সরাসরি সূর্যালোক ও তাপ থেকে দূরে রাখুন।
বিশ্লেষণের জন্য প্রেরণ: নমুনা সংগ্রহের পর যত দ্রুত সম্ভব বিশ্লেষণাগারে প্রেরণ করুন, যাতে নমুনার গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।

 

লেবেল বা ট্যাগের নমুনা
লেবেল বা ট্যাগের নমুনা

 

মৃত্তিকা নমুনা সংরক্ষণের পরামর্শ ও সতর্কতা

ক্র.নংপরামর্শ ও সতর্কতা
নমুনা সংগ্রহের সময় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মরিচাবিহীন এবং পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন হওয়া আবশ্যক।
একই জমি বা প্লটের মাটি অন্য জমি বা প্লটের মাটির সাথে মেশানো যাবে না।
সংগ্রহের জন্য নির্বাচিত প্লটের মাটি পরিমিত আর্দ্র কিংবা শুকনো হওয়া প্রয়োজন।
কর্ষণ স্তরের গভীরতা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে হবে (সাধারণত ০-১৫ সেমি)।
মাটি গুঁড়ো করার জন্য ধাতব হাতুড়ি বা ধাতব পাত্র ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এতে মাটির রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হতে পারে।
তথ্য কার্ড সঠিকভাবে লাগাতে হবে, যাতে নমুনা সম্পর্কে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত থাকে।
নমুনা সংগ্রহের সময় জমি কাদা অবস্থায় থাকলে বা সম্প্রতি সার প্রয়োগ করা হলে নমুনা সংগ্রহ এড়িয়ে চলুন।
বড় গাছের নিচ, গোবর স্তুপ, খেতের বাঁধ বা নিকাশি নালার কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করবেন না, কারণ এসব স্থানে মৃত্তিকার গুণাগুণ ভিন্ন হতে পারে।
প্রতিটি নমুনার ওজন প্রায় ৫০০ গ্রাম রাখা উচিত, যা বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট।
১০নমুনা সংগ্রহের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুকানো ও প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন করুন, যাতে নমুনার গুণাগুণ বজায় থাকে।
১১নমুনা শুকানোর সময় সরাসরি সূর্যালোক বা অতিরিক্ত তাপে শুকানো এড়িয়ে চলুন।
১২নমুনা প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের সময় সব সময় পরিষ্কার হাত গ্লাভস ব্যবহার করুন।
১৩নমুনা ব্যাগ বা বোতলে নমুনা সংরক্ষণের আগে তা সম্পূর্ণ শুকানো এবং পরিস্কার হওয়া উচিত।
১৪নমুনা পাত্রে স্পষ্টভাবে লেবেল লাগান, যাতে নিম্নলিখিত তথ্য থাকে: নমুনা সংগ্রহের তারিখ, স্থান, গভীরতা, জমির নাম, পূর্ববর্তী ফসল, সার প্রয়োগের ইতিহাস ইত্যাদি।
১৫নমুনা ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে, যেমন আলমারি, শেল্ফ বা ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
১৬নমুনা সংগ্রহের পরে যত দ্রুত সম্ভব বিশ্লেষণাগারে প্রেরণ করুন, যাতে নমুনার গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।

 

Leave a Comment