মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আজকের আলোচনা। মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক বস্তু। এটি মানুষ ও জীবজগতের খাদ্য উৎপাদনের উৎস এবং বিচরণ ক্ষেত্র৷ বিরাট মহীরুহ থেকে শুরু করে আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ এই মৃত্তিকায় লালিত ও পালিত হয়। সকল জীবের অস্তিত্বের জন্য মৃত্তিকা অপরিহার্য হলেও মৃত্যুর পর সকল জীবই মৃত্তিকায় মিশে যায়।

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ১ , পাঠ ১.১

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা

মৃত্তিকা কী?

মৃত্তিকা একটি প্রকৃতিজাত বস্তু (Natural body)। আজ আমরা মৃত্তিকাকে যেভাবে দেখতে পাচ্ছি তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। লক্ষ লক্ষ বৎসরের আবর্তে পৃথিবীর উপরিভাগের কঠিন শিলা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বিভিন্ন জীবজন্তু ও উদ্ভিদের দেহাবশেষের সাথে মিশে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্তিকা একটি মিশ্র পদার্থ। ইহা মৌলিক বা যৌগিক পদার্থ নয় কারণ এর কোন সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন নেই। মৃত্তিকা সৃষ্টির পর থেকে সর্বদাই এটি পরিবর্তিত হচ্ছে।

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , মৃত্তিকা বিজ্ঞান

মানুষের কার্যক্রম, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির ক্রিয়া এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহাবশেষের মিশ্রণের ফলে মৃত্তিকা দিন দিন তার বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে। মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী উৎস শিলার বৈশিষ্ট্য, জলাবায়ু, মানুষের কার্যক্রম, জীব বৈচিত্র্য ইত্যাদি মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী উপাদান। এসকল উপাদানের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যও বিভিন্ন হয়ে থাকে।

বৈশিষ্ট্যগত তারতম্য যাই থাকুক না কেন, সকল এলাকার মৃত্তিকা চারটি উপাদানে গঠিত। এ চারটি উপাদান হলো খনিজ দ্রব্য, পানি, বায়ু ও জৈব পদার্থ। খনিজ দ্রব্য মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী কঠিন শিলা থেকে, জৈব পদার্থ জীবের মৃতদেহের মিশ্রণ থেকে আর পানি বারিপাত (Precipitation) থেকে এবং বায়ু প্রাকৃতিক বায়ুমন্ডল থেকে এসেছে। এ চারটি উপাদান কোন নির্দিষ্ট অনুপাতে মাটিতে থাকে না। বিভিন্ন স্থানের মৃত্তিকায় এদের অনুপাতে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। সেজন্য মাটিকে মিশ্র পদার্থ বলা হয়।

মৃত্তিকার সংজ্ঞা (Definition of Soil):

বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার দ্রুত উন্নতির সাথে সাথে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের উন্নতিও এগিয়ে চলছে। গবেষণার ফলে মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের ধ্যান ধারণা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন রহস্য। ফলে মৃত্তিকার সংজ্ঞাও দিন দিন পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হচ্ছে। নিচে বিভিন্ন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্তিকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো।

১। মৃত্তিকা হলো একটি রাসায়নিক গবেষণাগার যেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক বিয়োজন (Chemical Decomposition) এবং সংশ্লেষণ বিক্রিয়া সংগোপনে (Hidden manner) ঘটে থাকে (Berzilius JJ, Sweden ) |

২। মাটি হলো খাদ্য তৈরির কারখানা (Davy, UK )

৩। মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরের স্তর যা শিলা ক্ষয়ের ( Weathering) মাধ্যমে গঠিত এবং উদ্ভিদের অবলম্বন (Support) ও পুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করে (Schubler, Germany)।

8। মৃত্তিকা হলো বিচূর্ণ কঠিন কণা, বায়ু এবং পানির মিশ্রণ যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য সহজলভ্য খাদ্যোপাদানের বাহক হিসেবে কাজ করে (Mitscherlich A, Germany)।

৫। মৃত্তিকা খনিজ ও জৈবিক উপাদানে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক বস্তু যা বিভিন্ন গভীরতাবিশিষ্ট স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং আঙ্গিক (Morphology), ভৌত গঠন, রাসায়নিক ধর্ম ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র (Joffe, USA)। সংজ্ঞাটি ইংরেজি পরিভাষায় এরূপ – The soil is a natural body of mineral and organic constituent differentiated into horizons of variable depths, which differs from the material below in morphology, physical make-up, chemical properties and biological characteristics এ সংজ্ঞাটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত।

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , মৃত্তিকা বিজ্ঞান

৬। কৃষিতাত্ত্বিক (Agronomic) বিবেচনায় বিজ্ঞানী হিলগার্ডের সংজ্ঞাটি গুরুত্বপূর্ণ। সংজ্ঞাটি হলো মৃত্তিকা হলো কম বেশি আলাদা এবং ঝুর ঝুরে পদার্থ যেখানে উদ্ভিদ শিকড় প্রবেশ করিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এবং পুষ্টিসহ বৃদ্ধির অন্যানা শর্তসমূহ পেয়ে থাকে। ইংরেজি পরিভাষায় সংজ্ঞাটি এরূপ- Soil may be defined as the more or less loose and friable material in which by means of their roots, plants may or do find a foot-hold and nurishment, as well as other conditions of growth.

৭। আমেরিকান মৃত্তিকা বিজ্ঞান সমিতি মৃত্তিকার একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। সংজ্ঞাটি হলোঃ মৃত্তিকা হলো কতকগুলি প্রাকৃতিক বস্তুর সমষ্টি যা পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের বিভিন্ন রকম সহায়তা প্রদান করে এবং সময়ের পরিবর্তনে উৎস দ্রব্যের উপর সজীব বস্তু ও জলবায়ুর ক্রিয়ায় বন্ধুরতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু ধর্মাবলী প্রাপ্ত হয়। এটি ইংরেজি পরিভাষায় এরূপ- Soil is a collection of natural bodies occupying portion of earth surface that support plants and have definite properties due to the integrated affect of climate and living matter acting upon parent material as conditioned by relief over period of time.

৮। খনিজ মৃত্তিকার সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে বিজ্ঞানী Nyle C. Brady’র সংজ্ঞাটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ক্ষয়ীভূত খনিজ এবং পচনরত জৈব দ্রব্যের চল মিশ্রণ থেকে পার্শ্বচিত্রের আকারে সংশ্লেষিত নানা প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ, যা ভূ-পৃষ্ঠকে একটি পাতলা আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত করেছে এবং উদ্ভিদকে দৈহিকভাবে ধারণ ও উপস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি, বায়ু এবং পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে তাকে মৃত্তিকা বলে।

উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে মৃত্তিকাকে নির্ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করা বেশ দূরহ। প্রকৃতপক্ষে আধুনিককালে মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ধ্যান ধারণার আবিষ্কারের ফলে মৃত্তিকার সংজ্ঞাতেও পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। যাহোক, উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।

মৃত্তিকা সৃষ্টি হলো যেভাবে:

পৃথিবীর বুকে মৃত্তিকা সৃষ্টি এক অনন্য রহস্য। বিজ্ঞানীদের মতে, সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী উত্তপ্ত গলিত পদার্থে পূর্ণ ছিল। ক্রমান্বয়ে তা ঠান্ডা হয়ে কঠিন শিলা বা প্রস্তর খন্ড সৃষ্টি হয়। লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে তাপমাত্রা, শৈত্য, বায়ুপ্রবাহ, অন্যান্য ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ঐ সমস্ত শিলাখন্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।। এসব চূর্ণ-বিচূর্ণ পদার্থই মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান উপাদান। মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী এসব পদার্থকে উৎস বস্তু (Parent material) বা উৎস শিলা (Parent rock) বলা হয়। এভাবে উৎস শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়।

মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , মৃত্তিকা বিজ্ঞান

শিলাচূর্ণ থেকে খনিজ পদার্থ সৃষ্টি চলতে চলতে এক পর্যায়ে তাতে প্রাণের সঞ্চার হয়। আর তখন থেকেই মৃত্তিকা সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। তাতে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধি ও উন্নয়ন চলতে থাকে। চূর্ণ বিচূর্ণ শিলা ও খনিজের উপর তাদের কার্যকলাপের ফলে শিলা ও খনিজের ক্ষয় দ্রুত চলতে থাকে। অপরপক্ষে, উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহাবশেষের মিশ্রণের ফলে শিলা ও খনিজ পদার্থ থেকে উন্নত মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকা সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে দিন দিন এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন চলতে থাকে।

সে জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যে এত বৈচিত্র্য! মৃত্তিকা সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়ায় প্রভাবকারী বিভিন্ন উপাদান এবং এদের প্রভাব সম্পর্কে পরবর্তি পাঠে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্তিকা গঠনকারী এসব উপাদানের প্রভাব সম্পর্কে জানলে মৃত্তিকা সৃষ্টির রহস্য আরও সহজভাবে বোধগমা হবে।

সূত্র:

  • মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , পাঠ ১.১, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

Leave a Comment