আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-মৎস্য সংরক্ষণ আইন
মৎস্য সংরক্ষণ আইন
মৎস্য সংরক্ষণ আইন
বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর অসংখ্য জলাশয়, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী রয়েছে। এসবের মধ্যকার কর্মকান্ড এবং আন্তঃক্রিয়া সূচারুভাবে পরিচালনার জন্য একটি আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে মৎস্য প্রতিরক্ষা ও সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৫০ নামে একগুচ্ছ বিধিমালা তৈরি করা হয়।
এই বিধিমালা পরবর্তীতে কালের সাপেক্ষে আরও পরবর্তিত হয়ে নতুন নতুন সংযোজনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
মৎস্য সংরক্ষণ আইনের উদ্দেশ্য
বাংলাদেশের জলাশয়সমূহে মাছের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে ডিমযুক্ত মাছ ধরা, পোনা মাছ ধরা, বিভিন্ন ধরনের অবৈধ উপকরণ, যেমন- বিস্ফোরক, কারেন্ট জাল ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরা, বৃহদাকার জলাশয়ে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি কার্যক্রমকে।
এসব কার্যক্রম মাছ সংরক্ষণের দিক থেকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত অবৈধ এবং মৎস্য সম্পদ বিনষ্টকারী এসব কার্যক্রম প্রতিহত করার জন্যই মৎস্য সংরক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। মৎস্য সংরক্ষণ নীতিমালা প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য হলো :
(ক) মাছের আবাসভূমি সংরক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা:
(খ) জলাশয় থেকে মাছ ধরার ব্যাপারে সুষ্ঠু নিয়মনীতির প্রয়োগ:
(গ) মাছ, মাছের আবাসস্থল ইত্যাদির প্রতি মৎস্যজীবী ও আমজনতার সচেতনতা সৃষ্টি:
(ঘ) মৎস্য সংক্রান্ত সকল প্রকার অবৈধ কার্যক্রম থেকে সবাইকে বিরত রাখা এবং
(ঙ) মাছের পরিবেশগত উন্নয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রমে মৎস্যজীবীসহ আমজনতাকে সম্পৃক্ত করা
মৎস্য প্রতিরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের নীতিসমূহ
বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের প্রতিরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মৎস্য প্রতিরক্ষা ও সংরক্ষণ অ্যাক্ট, ১৯৫০ নামে একগুচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে এ নীতিমালা বাংলাদেশেও প্রচলন করা হয়।
এই অ্যাক্টে ৮টি ধারা রয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য ১৯৮২, ১৯৮৫, ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৮৫ সালে এসব বিধিতে প্রয়োজন এবং সময়ানুগ কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণভাবে এসব নীতিমালা মৎস্য আইন নামে পরিচিত। এই আইনের বিশেষ ধারাগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :
১। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস) ২৩ সেন্টিমিটার বা নয় ইঞ্চি বা তার চেয়ে ছোট আকারের ইলিশ মাছ ( যা জাটকা নামে সমধিক পরিচিত) ও পাঙ্গাস মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
২। মধ্য আষাঢ় মাস থেকে মধ্য পৌষ মাস (জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস) ২৩ সেন্টিমিটার (নয় ইঞ্চির চেয়ে ছোট) বা তার চেয়ে ছোট আকারের রুই, কাতল, কালবাউশ, ঘনিয়া প্রভৃতি মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
৩। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত) ৩০ সেন্টিমিটার (বারো ইঞ্চি) বা তার চেয়ে ছোট পাঙ্গাস, শিলং, বোয়াল, আইড় প্রভৃতি মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
৪। প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ চৈত্র মাসের প্রথম থেকে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি (১৫ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই) পর্যন্ত দেশের কিছু নির্দিষ্ট নদ-নদী, খাল-বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে যে কোন
আকারের রুই তথা কার্পজাতীয় মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
৫। এপ্রিল মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত মুক্ত জলাশয়ে বোয়াল, গজার ও টাকি মাছের রেনু পোনা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে চলাচল করে, তখন এসব পোনা ও এদের সাথে বিচরণকারী অন্য মাছ ধরা, পরিবহন ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
৬। নদ-নদীসহ বৃহদাকার জলাশয়ে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বা স্থায়ীভাবে জাল পেতে মাছ ধরা বা মাছের স্বাভাবিক চলাচলে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
৭। বিস্ফোরক দ্রব্য, বন্দুক, তীর, বর্ণা ইত্যাদি মারণাস্ত্র ব্যবহার করে বা জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছের আবাসস্থল বা প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট করা আইনগত দণ্ডনীয়।
৮। মৎস্য সংরক্ষণ আইন অমান্যকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রথমবারে কৃত অপরাধের জন্য ১,০০০ (এক হাজার টাকা জরিমানা) বা ৬ মাসের জেল বা উভয় ধরনের দন্ড প্রদান করা যেতে পারে। পরবর্তীতে একই ধরনের অপরাধের জন্য শাস্তির পরিমাণ দিগুণ হবে।
মোটামুটিভাবে বাংলাদেশে প্রচলিত মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এ বর্ণিত এবং সর্বসাধারণে প্রচলিত নীতিমালাসমূহের সারসংক্ষেপ উপরে দেয়া হলো।
অন্যান্য সম্পূরক আইন
বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য মৎস্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ ছাড়া একাধিক সম্পূরক আইন বা নীতিমালা প্রচলিত রয়েছে। এসব আইন বা নীতিমালার মধ্যে পুকুর উন্নয়ন আইন, ১৯৩৯ সামুদ্রিক মৎস্য আইন ১৯৮৩: চিংড়ি চাষ আইন, ১৯৯২ ইত্যাদি উলেখযোগ্য। নিচে এসব আইন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো :
(ক) পুকুর উন্নয়ন আইন, ১৯৩৯
১৯৩৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে পুকুর উন্নয়ন আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে সংশোধিত হয়। এই আইনে সংযুক্ত বিভিন্ন নীতি হচ্ছে-
• অধিগ্রহণকৃত পুকুরটিতে মাছ চাষে আগ্রহী স্থানীয় কোন সংস্থা, সমিতি বা ব্যক্তির কাছে নির্দিষ্ট সময়ের (অনধিক বিশ বছর) জন্য হস্তান্তর করবেন।
• সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকাকালীন মালিক পুকুরটির জন্য সরকার নির্ধারিত খাজনা পাবেন।
• পুকুর থেকে ২৩ সেন্টিমিটারের চেয়ে কম আকারের পোনা মাছ ধরা যাবে না। যেসব জালের ফাঁস ৪৫ সেন্টিমিটার বা তার কম (যেমন, কারেন্ট জাল), সেসব ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
• মৎস্য সংরক্ষণ আইন প্রথমবার অমান্যকারীর জন্য ১,০০০ (এক হাজার টাকা) জরিমানা বা ৬ মাসের জেল বা উভয় ধরনের শাস্তি হতে পারে।
• মাছ চাষের আওতায় আনার জন্য ডিসি বা থানা নির্বাহী কর্মকর্তা হাজা-মজা পুকুরের মালিককে পুকুর সংস্কার করে মাছ চাষ করার জন্য নোটিশ দেবেন।
• হাজা-মজা পুকুর সংস্কারের নোটিশ পাওয়ার পরও যদি পুকুরটির সংস্কার না করেন, তবে পুকুরটিকে পতিত হিসেবে ঘোষণা করে তা অধিগ্রহণ করবেন।
(খ) সামুদ্রিক মৎস্য আইন, ১৯৮৩
বাংলাদেশের বিস্তৃত তটরেখা বরাবর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সম্প্রসারিত সামুদ্রিক জলাশয়ের পরিমাণ ১.৬৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রোপকূলবর্তী এ এলাকা থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ মাছ সংগ্রহ করা হয়। এ বিস্তৃত এলাকা থেকে কিভাবে মাছ সংগ্রহ করা হবে, কি উপকরণ ব্যবহার করা হবে, কোন ধরনের মাছ সংগ্রহ করা হবে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নিয়ে এ আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করা হয়।
(গ) চিংড়ি চাষ আইন, ১৯৯২
বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ এবং উপকূলবর্তী এলাকাতে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি চাষাবাদের জন্য ১৯৯২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার চিংড়ি চাষ আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ হচ্ছে-
• চিংড়ি চাষোপযোগী এলাকাতে সরকার চিংড়ি চাষ এবং চাষাবাদ কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করবেন।
• চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির মালিকগণ নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মমাফিক বিভিন্ন কর পরিশোধ করবেন।
সারমর্ম
মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মাছের বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডে নানা ধরনের আইন প্রচলিত রয়েছে। এসব আইন ঠিকমতো মেনে চললে, দেশে মাছের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি ভোক্তাদের চাহিদাও সুনির্দিষ্ট থাকবে। তবে এক্ষেত্রে মাছ বা মাছ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকার নিয়ম-নীতিও মেনে চলা একান্তভাবেই প্রয়োজন।