আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি। যা কৃষিজ উৎপাদন বিষয়ের মাছ চাষ এর অন্তর্ভুক্ত। শিং ও মাগুর মাছের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছুটা মিল রয়েছে। এদের দেহ লম্বাটে, সামনের দিক নলাকার, পিছনের দিক চ্যাপ্টা ও আঁশ বিহীন এবং মাথার উপর নিচ চ্যাপ্টা। মুখে চার জোড়া শুড় ও মাথার দুই পাশে দুটি কাঁটা আছে। কিন্তু শিং মাছ মাগুর মাছের চেয়ে আকারে ছোট হয় এবং মাথা তুলনামূলক সরু হয়। শিং মাছের পার্শ্বিয় কাটা দুটো বিষাক্ত হয়। এজন্য শিং মাছের কাঁটা খেলে আক্রান্ত স্থানে যথেষ্ট ব্যথা অনুভব হয়। শিং মাছের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি লাল এবং বড় অবস্থায় ধূসর কালচে। অন্যদিকে মাগুরের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি খয়েরি ও বড় হলে ধূসর বাদামি হয়।
Table of Contents
শিং ও মাগুর মাছ চাষ পদ্ধতি
শিং ও মাগুর মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফুলকা ছাড়াও এদের অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন নিতে পারে। ফলে এরা অল্প অক্সিজেন যুক্ত পানিতে বা পানি ছাড়াও দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। এজন্য শিং ও মাগুর মাছকে জিওল মাছ বলা হয়। শিং ও মাগুর মাছ সর্বভুক জাতীয় মাছ। এরা জলাশয়ের তলদেশে থাকে এবং সেখানকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী ও পচা জৈব আবর্জনা খায়। এরা বছরে ১ বার প্রজনন করে থাকে। এদের প্রজনন কাল হচ্ছে মে থেকে সেপ্টেম্বর | তবে জুন-জুলাই মাসে এদের সর্বোচ্চ প্রজনন হয়ে থাকে।
শিং মাছ লম্বা ও কালো রং এর মাছ। এদের দেহ চাপা ও পেট গোলাকার। এদের মাথা উপরে নিচে চেপ্টা, ক্ষুদ্রাকৃতি চোখ, মাথা সম্মুখভাবে পার্শ্বদেশে অবস্থিত। এদের বক্ষ পাখনায় বিষযুক্ত দুটি বড় কাটা থাকে। দৃষ্ট পাখনা অত্যন্ত ছোট এবং গায়ে কোনো আঁইশ থাকে না। মাগুর মাছের দেহ লম্বাটে সামনে অবনমিত পশ্চাতে চাপা এবং লেজ ক্রমান্বয়ে সরু। এ মাছের গায়ে কোনো আঁইশ থাকে না।
শিং মাছের দেহের রং ছোট অবস্থায় বাদামি লাল অন্যদিকে মাগুরের দেহের রং বাদামি হয়েরি। উভয় মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ফুলকা ছাড়াও এদের অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন নিতে পারে।
এতে করে এরা অল্প অক্সিজেনযুক্ত পানিতে দীর্ঘক্ষণ বেচে থাকতে পারে। এজন্য শিং ও মাগুর মাছকে জিওল মাছ বলা হয়। শিং মাছের বক্ষ পাখনা বিষ গ্রন্থি যুক্ত এজন্য কাটার আঘাতে মানুষের যন্ত্রণা হয়। এরা সর্বভূক্ত জাতীয় মাছ এবং প্রজনন কাল বছরে এক বার ।

শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগত গুরুত্ব
বড় অনেক প্রজাতির তুলনায় শিং ও মাগুর মাছের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এসব মাছে শরীরের উপযোগী লৌহ অধিক পরিমাণে আছে। এসব মাছে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি ও তেল কম থাকে। এজন্য সহজে হজম হয়। অসুস্থ ও রোগ মুক্তির পর স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতির জন্য পথ্য হিসেবে এসব মাছ সমাদৃত। শিং ও মাগুর মাছ রক্ত স্বল্পতা রোধে ও বল বর্ধনে সহায়তা করে।

শিং ও মাগুর মাছ চাষের সুবিধা
১। শিং ও মাগুর মাছ সুস্বাদু এবং বাজারে এদের চাহিদা বেশি।
২। ডোবা, ছোট জলাশয়, পুকুর ও যাহাতে এদের চাষ করা যায় ।
৩। অন্যান্য মাছের তুলনায় কম খাদ্য লাগে।
৪। সাধারণ প্রতিকূল অবস্থায় এরা বেঁচে থাকতে পারে ।
৫। হ্যাচারিতে এদের পোনা উৎপাদন করা যায়।
৬। এদের একক এবং মিশ্র চাষ করা যায়।
৭। এদের রোগ বালাই কম হয়।
শিং ও মাগুর মাছের চাষ পদ্ধতি
শিং ও মাগুর চাষের জন্য পুকুর ও পরিবেশ প্রস্তুতি
শিং ও মাগুর মাছ চাষের পানির পুকুরের গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়। বন্যামুক্ত আয়তাকার পুকুর চাষের জন্য উপযুক্ত। পুকুরের আয়তন ৪০-৫০ শতাংশ হলে ভালো। নতুন পুকুরের চেয়ে পুরাতন পুকুরে শিং মাছ চাষ ভালো হয় ।
চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরটির পাড় ভাঙ্গা থাকলে মেরামত করতে হবে। কচুরিপানাসহ অন্যান্য জলজ আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে । পুকুর শুকানো হলে তলায় চুন, গোবর, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, ইউরিয়া, টিএসপি সার প্রতি শতকে নির্ধারিত হারে প্রয়োগ করতে হবে। মাগুর মাছ সামান্য বৃষ্টি বা বন্যা হলে প্রায়শই হেঁটে পুকুর থেকে বাইরে চলে যায় ।
এজন্য পুকুরের চারপাশে পাড়ের ওপর অন্তত ৩০ সে.মি. উঁচু করে নেটের বেষ্টনি বা ভেড়া নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া নাইলনের নেট খুঁটির সাথে বেঁধে পাড়ের চার দিকে ঘিরে দিতে হবে এবং নেটের নিচের দিক মাটির কিছুটা ভিতরে দিয়ে আটকিয়ে দিতে হবে। যাতে সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি পুকুরে ঢুকতে না পারে। পুকুর প্রস্তুতির ৫-৭ দিন পর প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০টি মাগুর মাছের পোনা এবং ৩০০-৪০০টি পর্যন্ত শিং মাছের পোনা মুজত করা যেতে পারে।
মিশ্র চাষের ক্ষেত্রের কার্পজাতীয় মাছের সাথে প্রতি শতাংশে ৫০টি পর্যন্ত শিং বা মাগুর মাছের পোনা ছাড়া যায়। পোনা ছাড়ার পূর্বে পোনাকে এন্টি ফাংগাস মেডিসিন বা লবণ পানিতে শোধন করতে হবে। সকাল বা বিকাল ঠাণ্ডা আবহাওয়া পুকুরের পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়।
শিং ও মাগুর মাছ চাষে পুকুর প্রস্তুতির সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পুকুরের চারদিকে পাড়ের উপর অন্তত ৩০ সে.মি. উঁচু করে নেটের বেষ্টনী বা বেড়া নিমার্ণ করা। বেষ্টনী দেওয়ার সুবিধা হচ্ছে এতে করে বৃষ্টির সময় মাছ পুকুরের বাইরে চলে যেতে পারে না। বিশেষত মাগুর মাছকে সামান্য বৃষ্টি বা বন্যা হলে প্রায়ই হেঁটে (গড়িয়ে) পুকুর থেকে বাইরে যেতে দেখা যায়। অন্যদিকে বেষ্টনী দেওয়ার ফলে মাছের শত্রু যেমন-সাপ,ব্যাঙ ইত্যাদি পুকুরে প্রবেশ করতে পারে না।
নাইলনের নেট খুটির সাথে বেঁধে পাড়ের চারদিকে ঘিরে দিতে হবে। নেটের নিচের দিক মাটির ভিতর কিছুটা ঢুকিয়ে আটকে দিতে হবে যেন মাটি ও নেটের মাঝে ফাঁক না থাকে। পুকুর শুকানো হলে শুকানোর পর পরই এ কাজ করতে হবে। কারণ শুকনো অবস্থায় পুকুরে কোনো ক্ষতিকর প্রাণী যেমন-ব্যাঙ, সাপ থাকে না। পানি থাকা অবস্থায় পুকুরে এসব প্রাণী থাকে বিধায় তখন বেষ্টনী দিলে এরাও পুকুরে আটকা পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ভিতরে সেগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- কোচ দিয়ে বা বিষ টোপ দিয়ে।
শিং ও মাগুর চাষের জন্য পোনা মজুদ
পুকুর প্রস্তুতির ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ টি মাগুর মাছের পোনা মজুদ করতে হবে। শিং মাছ যেহেতু আকারে ছোট তাই এ মাছ কিছু বেশি যেমন- ৩০০-৪০০টি পর্যন্ত মজুদ করা যেতে পারে। শতকে ৩-৪টি সিলভার কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে যা পুকুরে উৎপাদিত অতিরিক্ত ফাইটোপস্নাংকটন খেয়ে পরিবেশ ভালো রাখবে।
পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকলে শতকে মাগুরের পোনা ২৫০-৩০০টি এবং শিং মাছের পোনা ৪০০-৫০০টি মজুদ করা যাবে। কার্প বা রুই জাতীয় মাছের সাথে শিং/মাগুর এর মিশ্রচাষ করতে চাইলে শতকে শিং/মাগুর এর পোনা ৫০টি এবং রুই জাতীয় মাছের পোনা ৪০টি মজুদ করা যায়। পোনা ছাড়ার আদর্শ সময় হচ্ছে সকাল বা বিকাল (ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়)। দুপুরে রোদে বা মেঘলা দিনে পোনা মুজুদ করা উচিত নয়। পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পটাশ বা লবণ পানিতে পোনা শোধন ও পুকুরের পানিতে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
শিং ও মাগুর মাছের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
শিং ও মাগুর মাছকে সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হয়। এদের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদান ও এদের মিশ্রনের হার নিচে দেওয়া হলো:
শিং ও মাগুরের সম্পূরক খাদ্য তৈরির উপাদান ও মিশ্রণ হার (%)
খাদ্য উপাদান ⇒ মিশ্রণ হার (%)
ফিশমিল ⇒ ২০
মুরগির নাড়ি ভুড়ি ও হাড় চুর্র্ণ (মিট ও বোন মিল) ⇒ ২৫
সরিষার খৈল ⇒ ৩০
চালের কুঁড়া ⇒ ১২
গমের ভুসি ⇒ ৫
আটা/ চিটাগুড় ⇒ ১ গ্রাম/কেজি
ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ ⇒ ৮
সয়াবিন চূর্ণ ⇒ ৫
ভুট্টা চূর্ণ ⇒ ৫
শিং/মাগুর মাছের দৈহিক ওজনের সাথে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নিচে দেওয়া হলো-
মাছের গড় ওজন (গ্রাম)⇒ দৈহিক খাদ্যের পরিমান (%)
১-৩ ⇒ ১৫-২০
৪-১০ ⇒ ১২-১৫
১১-৫০ ⇒ ৮-১০
৫১-১০০ ⇒ ৫-৭
>১০১ ⇒ ৩-৫
শিং ও মাগুর মাছের খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি:
সকাল ও বিকাল দিনে মোট দুই(২) বার প্রতিদিনের জন্য নির্ধারিত খাবার দিতে হবে। খাবারগুলো কম পানিতে মিশিয়ে ছোট বল আকারে তৈরি করে পুকুরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে দিতে হবে। পানির নিচে স্থাপিত ট্রেতে খাবার দেওয়া যেতে পারে। খাবার তৈরির ২৪ ঘন্টা আগেই খাদ্য উপকরণ সরিষার খৈল ভিজিয়ে রাখতে হবে। বাজার থেকে কৃত্রিম খাবার কিনেও মাছকে প্রদান করা যেতে পারে। তবে বাজারের যাবার দামে কিছুটা বেশি হতে পারে।
শিং ও মাগুর মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
চাষ করা মাছগুলো নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে কি না এবং মাছের মধ্যে কোনো প্রকারের রোগাক্রান্ত অবস্থা পরিলক্ষিত আছে। কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য মাঝে মাঝে জাল টেনে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
শিং মাগুর মাছে সাধারণত কোনো রোগ হয় না। তবে শীতকালে মাঝে মাঝে ক্ষত রোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ এবং পেট ফুলা রোগ দেওয়া যায়। এসব রোগের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিম্নরূপ:
শিং ও মাগুর মাছের লেজ ও পাখনা পচা রোগ:
মিক্সোব্যাক্টর ও অ্যারোমোনাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রিত করে আক্রান্ত মাছগুলোকে ৩-৫ মিনিট ডুবায়ে রেখে গোসল করাতে হবে। এসময় পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগে এ রোগ দূর হতে পারে।
শিং ও মাগুর মাছের ক্ষত রোগ:
এ রোগ ছত্রাকের আক্রমণের হয়। এক্ষেত্রে মাছের মাংসপেশিগুলোতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এ রোগের আরোগ্য লাভের জন্য পুকুরে ১-১.৫ মিটার পানির গভীরতায় প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন এবং ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হয় । এতে ২ সপ্তাহের মধ্যেই মাছগুলো আরোগ্য লাভ করে। তাছাড়া শীতের শুরুতে উপরোক্ত হারে চুন ও লবণ প্রয়োগ করলে প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করের এবং শীতকালে এ রোগ হয় না।
পেট ফুলা রোগ:
এই রোগটি ব্যাকটেরিয়াজনিত। এতে মাছে পেট ফুলে যায় ও মাছ ভারসাম্যহীনভাবে পানিতে চলাফেরা করে এবং পরিশেষে মৃত্যু ঘটে।
এক্ষেত্রে আক্রান্ত মাছের পেট থেকে খালি সিরিঞ্জ দিয়ে পানি বের করতে হয়। এক কেজি খাবারের সাথে ২০০ মিলিগ্রাম ক্লোরামফেনিকল মিশিয়ে খাওয়ালে এ সমস্যা দূর হতে পারে। এছাড়াও আক্রান্ত পুকুরে ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে ।
মাছ আহরণ সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা করা হলে ৭-১০ মাসেই শিং ও মাগুর মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগী হয় এবং উক্ত সময়ে শিং মাছ গড়ে ১০০-১২৫ গ্রাম ও মারে ১২০-১৪০ গ্রাম হয়ে থাকে। পুকুরে জাল টেনে আংশিক মাছ আহরণ করতে হবে। সম্পূর্ণ পুকুর শুকায়ে সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হবে।
শিং ও মাচর মাছের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এদের ফুলকা ছাড়াও অতিরিক্ত শ্বসনতন্ত্র আছে যার মাধ্যমে এরা | বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। ফলে এরা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। এদেরকে জিওল মাছও বলা হয়। সঠিকভাবে দাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করা হলে এদের অধিক উৎপাদন সম্ভব।