শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার – যা শিল্পের কাঁচামাল: কৃষিজ দ্রব্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।

শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার

আমজাত খাদ্যসমাগ্রীর ব্যবহার

ফল হিসাবে আম খাওয়া যায়। কারণ এতে শর্করা, ভিটামিন বি ও সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও খনিজ লবন রয়েছে। কাঁচা আম, পাকা আম প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আমের মোরব্বা, আমের চাটনি, আমের আচার, আমচুর, আমসত্ত্ব, পাকা আমের বোতলজাত জুস ইত্যাদি মুখরোচক খাদ্য তৈরি হচ্ছে।

নারিকেলজাত দ্রব্যের ব্যবহার

নারিকেল গাছ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। নারিকেলের ফলের ভিতরের অংশ মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তা হতে তেলও পাওয়া যায়। নারিকেলের কচি ফলকে ডাব বলে। ডাবের পানি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। নারিকেল থেকে মাথায় দেওয়ার এবং খাওয়ার তেল তৈরি করা হয়। শুকনো নারিকেলের শাঁস থেকে তৈরি উদ্ভিজ্জ তেল মাথায় ব্যবহার ছাড়াও রান্নায়, সাবান, শ্যাম্পু এবং অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তেল নিষ্কাশনের পর পরিত্যক্ত খৈল পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

নারিকেলের খোল দিয়ে তৈরি হয় হুঁকো। গাছের কান্ড দিয়ে ঘরের আড়া, পুলের খাম্বা, ঘরের খুঁটি ও বর্ণার হাতল তৈরি করা হয়। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি, মাদুর প্রভৃতি তৈরি হয়। নারিকেল গাছের পাতার মধ্যশিরা দিয়ে ঝাঁটাও তৈরি হয়।

বাঁশজাত দ্রব্যাদির ব্যবহার

আসবাবপত্র, গৃহনির্মাণ ও গৃহ সজ্জার কাজে প্রাচীনকাল থেকেই কাঠের বিকল্প হিসেবে বাঁশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গৃহনির্মাণ ও গৃহসামগ্রী থেকে শুরু করে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যন্ত এর ব্যবহার বিস্তৃত।

বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাঁশ থেকে কাগজ পার্টিকেল বোর্ড, পাইবোর্ড, বাঁশ পাতলা করে চেরাই করে চাটাই, ঢোল, বীম, আড়, ঘরের খুটি, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। আধুনিক বিশ্বে দেশে ও বিদেশে বাঁশের হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বাশঁ থেকে স্বাস্থ্যকর লেমিনেটেড বাশের মেঝে ও দেওয়াল কভার, মাদুর, কুশন, সিটকভার এমনকি পাদুকা পর্যন্ত তৈরি সম্ভব হচ্ছে ।

বাঁশ শিল্পের শ্রেণী বিভাগ
বাঁশ শিল্পকে নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথাঃ

১। কাগজ শিল্প
২। নির্মাণ শিল্প
৩। হস্ত শিল্প

কাগজ শিল্প

মূলিবাশ কাগজ শিল্পের জন্য বিশেষ উপযোগী। মূলিবাঁশের তৈরি কাগজের মন্ড দিয়ে উন্নত মানের কাগজ তৈরি হয়। কাগজের উপজাত হিসেবে রেয়নও প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশের নানা জায়গায় কাগজ শিল্প গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ বাঁশই এই শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়। কাগজ ছাড়াও বাঁশ থেকে পার্টিকেল বোর্ড, পাইবোর্ড বাঁশের ঢেউটিন, প্যানেলবোর্ড ইত্যাদি তৈরি করা যায়।

নির্মাণ শিল্প

বিভিন্ন নির্মাণশিল্পে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। নির্মাণ শিল্পের মধ্যে গৃহ বা দালান কোঠা নির্মাণই প্রধান। বাঁশ গ্রামীণ গৃহ নির্মাণের বিভিন্ন কাজে যেমন খুটি দেওয়া, ঘরের বেড়া দেওয়া, বীম বা আড় তৈরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। বড় বড় দালান কোঠা নির্মাণেও বাঁশ ব্যবহৃত হয়।

আরও অনেক নির্মাণ শিল্প যেথায় বাঁশ অতীত কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন, গ্রামের খাল বা অপ্রশস্ত নদীতে সেতু বা সাঁকো তৈরিতে, নৌকার মাস্তুল, হই, পাটাতন, গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, জোয়াল, ঘানি ও মাড়াই কল ইত্যাদি । বৈদ্যুতিক খুটি, মাছ ধরার চাঁই, খাড়া জাল ইত্যাদি তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়।

ধর্ম জালের দন্ড, সবজি লাগানো গাছ বেয়ে উঠার জন্য মাচা, নৌকার হাল ও দাঁড়ের দন্ড, বক্তৃতার মঞ্চ, তোরণ এসব তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মিত। পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ দ্বারা কূপ তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় আর্টেজীয় কূপ। এই কূপের সাহায্যে পাহাড়ি এলাকায় জমি চাষ করা হয়।

 

শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার
চিত্র ১১.২.২ঃ দালানকোঠা নির্মাণে

 

ক্ষুদ্র হস্তশিল্প

ক্ষুদ্র হস্তশিল্পেই অধিক হারে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। কেননা এই শিল্পের দ্রব্যজাত তৈরি ও ব্যবহার বেড়ে গেছে। সমস্ত প্রকার বাঁশ বয়ন ক্ষুদ্র হস্তশিল্পরই অন্তর্ভুক্ত। এই শিল্পের অধীনে তৈরি হয় চাটাই, ডোলা, কুলা, ঝুড়ি, ঝাকা, চালনি, খাঁচা, খেলনা, কলম, টুপি, ফুলদানি, লাইট স্টান্ড, লাঠি এমনকি দাঁত খিলান, বুকসেলক ইত্যাদি।

 

শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার
চিত্র ১১.২.৩: বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্র হস্তশিল্প

 

বেতের ব্যবহার

বেতের শিল্পক্ষণের জন্যই বেত সবার নিকট সুপরিচিত। বেতের কান্ড বেত শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বেতের কান্ড শক্ত বটে কিন্তু নমনীয়ও চেরাইযোগ্য। এ থেকে আকর্ষণীয় ও আভিজাত্য বহনকারী শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত করা হয়।

বেতের আসবাবপত্র তৈরি

বেতের তৈরি আসবাবপত্র একেবারেই প্রাকৃতিক । এতে কোনো প্রকার কৃত্রিমতা নেই বলে। বেতকে সুতার মতো ব্যবহার করে কোন শক্ত জিনিসের (রঙ, বাঁশ) উপর পেঁচিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। আবার বেতের মোটা শাখা প্রশাখা শুকিয়ে শোধন করে শক্ত কাঠামো দাড় করিয়ে সোফা চেয়ার, টেবিল, বুকসেলফ, খাট, দোলনা, মোড়া, জুতা রাখার তাক কর্ণার সেলভ, ওয়ার্ডড্রোবস, রকিং চেয়ার, আরাম কেদারা ইত্যাদি আসবাবপত্র তৈরি করা যায়।

আসবাবপত্র তৈরির আগে বেতগুলোকে সাইজ মতো কেটে শোধন করতে হবে। একটি চাড়িতে আনুমানিক হারে বরিক এসিড ও পানির দ্রবণ তৈরি করে এই দ্রবণে বেত এক সপ্তাহ ভিজিয়ে রাখলে ভালোভাবে শোষিত হবে। এতে ঘুরা বা অন্যান্য পোকা মাকড় আক্রমন করবে না।

 

শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে কৃষিজ দ্রব্যাদির ব্যবহার
চিত্র ১১.২.৫। বেতের তৈরি আসবাবপত্র

 

বেতজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান

বেতের ব্যবহার ব্যাপক । বেত শিল্পই হচ্ছে গ্রামীণ শিল্প ঐতিহ্য। বেতের শিল্পকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়-

১। হালকা নির্মাণ শিল্প

২। বুনন শিল্প

৩। ক্ষুদ্র হস্ত শিল্প

৪। মিশ্র শিল্প

হালকা নির্মাণ শিল্প

বেতের হালকা নির্মাণশিল্প বলতে বোঝায় মোটা বেতের আসবাবপত্র, যা হালকা ভার বহন করতে পারে। হালকা নির্মাণ শিল্পের প্রধান উদাহরণ হচ্ছে সোফাসেট, চেয়ার, ঘাট, পার্টিশন, শেলফ, টেবিল ইত্যাদি।

এই শিল্পে যে বেত ব্যবহার করা হয় তা অপেক্ষাকৃত মোটা এবং পরিমাণে বেশি। আর এই বেত ব্যবহারে শিল্প নৈপুণ্যের দরকার হয়ে থাকে। দেশ- বিদেশের অভিজাত মহলে হালকা নির্মাণ শিল্প দ্রব্যাদিরও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই শিল্পে সাধারণত গোল্লাতে, উপমবেত, কদমবেত ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।

বুনন শিল্প

বুননশিল্পে সরু ও নমনীয় বেত ব্যবহার করা হয়। এসব বেত চেরাই করে আরও সরু ফালি পাওয়া যায়। এই সরু ফালিকে বেশি বলা হয়। বাঁধাই ও বুনন কাজে এই বেভি ব্যবহার করা হয়। বুনন শিল্পের মাধ্যমে হালকা নির্মাণ শিল্পকে কারুকার্যময় ও নান্দনিক করা হয়। বুনন শিল্পের জন্য বান্দরিয়েত ও জালিবেত ব্যবহার করা হয়।

ক্ষুদ্র হস্ত শিল্প

ক্ষুদ্র হোক অথবা বড় হোক বস্তুত বেতশিল্পের পুরোটাই হস্তশিল্প। নির্মাণশিল্প ও বুনন শিল্পের অপ্রয়োজনীয় অবশিষ্ঠাংশ ব্যবহার করে যেসব সৌন্দর্যবর্ধক দ্রব্যাদি হাতে তৈরি করা হয় তাকেই বলে বেতের ক্ষুদ্র হস্তশিল্প। বেতের ক্ষুদ্র হস্তশিল্পের উদাহরণ হচ্ছে খেলনা, ফুলের সাজি, কলমদানি, বেতের ধামা, জুতার র্যাক, মোড়া, ফুলদানি ইত্যাদি ।

মিশ্র শিল্প

বেতের সাথে বাঁশ, কাঠ, প্লাষ্টিক, নাইলন, স্টিল, ইত্যাদি মিশ্রণ করে যেসব দ্রব্যাদি তৈরি হয় তাকে বেতের মিশ্রশিল্প বলে। মোটা বেতের অভাব হলে এর স্থলে কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি ব্যবহার করে মিশ্র শিল্প হিসেবে দোলনা, মোড়া, র্যাক, সেলফ, চেয়ার তৈরি করা হয়। আবার, সরু বেতের অভাব হলে এর স্থলে নাইলনের বা প্লাস্টিকের বেতি মোটা বেতের সাথে মিশ্রণ করে ফাট, বক্স, সোফা ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

সারসংক্ষেপ

বিভিন্ন কৃষিজ দ্রব্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে সরাসরি ব্যবহৃত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কৃষিজ প্ৰবা যেমন আম, নারিকেল, বাঁশ এবং বেত বিভিন্ন শিল্পে যেমন কাগজশিল্পে, নির্মাণশিল্পে, ক্ষুদ্র হস্তশিল্পে, বুনন শিল্পে ও মিত্রশিল্পে ব্যবহৃত হয়। অতএব কৃষিজ প্র শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে আমরা আমাদের দেশের শিল্প | প্রতিষ্ঠানের উন্নতি সাধন করতে পারি সেটা অনুসন্ধান করা উচিত।

 

Leave a Comment