সেচ ও নিষ্কাশন

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সেচ ও নিষ্কাশন

সেচ ও নিষ্কাশন

 

সেচ ও নিষ্কাশন

 

সেচ ও নিষ্কাশন

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলে অবস্থিত এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এখানকার মটি উর্বর বলে বহু ফসলের চাষ হয়। প্রচুর বৃষ্টিপাত ( বার্ষিক ২০৮.৬৬ সে.মি.) সত্ত্বেও এখানে সেচের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবার কারণ হলো বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন সব জায়গায় এক রকম নয়, তেমনি প্রত্যেক মাসেও সমপরিমাণ নয়।

রাজশাহী জেলার লালপুরে বৃষ্টির পরিমাণ সবচাইতে কম, বার্ষিক মাত্র ১২৯.৬৭ সে.মি., অন্যদিকে সিলেটের লালাখালে সবচাইতে বেশি, বার্ষিক ৫৭৩.৪৩ সে.মি.। বৎসরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসের বৃষ্টির পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৮২ ভাগের বেশি, আর বাকি ৭ মাসে ১৮ ভাগের কম।

আর যদি ফসল মৌসুম হিসেবে দেখা হয়, তাহলে খরিপ মৌসুমে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) শতকরা ৮৮ ভাগ এবং রবি ঋতুতে (অক্টেবর-মার্চ) মাত্র ১২ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। তাই রবি মৌসুমে সেচের এবং খরিপ মৌসুমে নিষ্কাশনের প্রয়োজন দেখা দেয়। রবি মৌসুমে পানির অভাবে অনেক জমি পতিত থাকে। অন্যদিকে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের অভাবে ফসলের অনেক তি হয়। বাংলাদেশের মাসওয়ারী বৃষ্টিপাতের একটি তালিকা নিচে উপস্থাপন করা হলো।

ছক ১৪ বাংলাদেশের মাসওয়ারী গড় বৃষ্টিপাত (সেন্টিমিটার)

 

সেচের সংজ্ঞা: ফসল ‘ তে ফসলের প্রয়োজনে কৃত্রিম উপায়ে পানি সরবরাহের প্রক্রিয়াকে সেচ (Irrigation) বলে।

সেচের উপকারী প্রভাব

উদ্ভিদ মাটি থেকে খাদ্যোপাদান পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় আয়ন হিসেবে পরিশোষন করে। গাছের দেহে শুষ্ক পদার্থ (Dry matter) উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন। প্রাকৃতিক পন্থায় মাটির নিচের স্তরের খাদ্যোপাদান পানিতে দ্রবীভূত হয়ে কৈশিক নালীর মাধ্যমে মাটির ওপরের স্তরে উঠে আসে। মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও পানির প্রভাব রয়েছে।

পানি মাটির জৈব পদার্থ পচনে সহায়তা করে, আগাছা দমনে ভূমিকা রাখে। সেচের পানি মাটির লবণাক্ততা ও ারত্ব দূরীকরণে সাহায্য করে। বীজতলা তৈরিতে, চারা উঠানোতে, মাটি কাদা করতে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া সেচের পানির সাহায্যে জমি তৈরি ও বপন/রোপণ কার্য সময়মত সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রাকৃতিক নিয়মে এসব কার্যকলাপ বৃষ্টির পানি দিয়ে করা হয়। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে সেচই একমাত্র বিকল্প।

সেচের পানির উৎস

সেচের পানির উৎসগুলো হলো নদীনালা, খালবিল, পুকুর, কূপ, নলকূপ, গভীর নলকূপ ও অগভীর নলকূপ ।

সেচের পানির গুণাবলী

সেচের পানির উৎস যাই হোক না কেন, পানির গুণাগুণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেচের পানিতে এমন কোন জিনিস থাকা উচিত নয় যা ফসলের জন্য বা জমির জন্য তিকর, যেমন দ্রবীভূত লবণ বা খনিজ পদার্থ, ভাসমান বালি বা পলিমাটি, আগাছার বীজ, রোগের জীবাণু ইত্যাদি। তা ছাড়া পানির তাপমাত্রাও যেন অতি উষ্ণ বা অতি শীতল না হয়। পানির pH (পিএইচ) মান সাত অর্থাৎ নিরপে হওয়া ভাল।

সেচ পদ্ধতি (Methods of irrigation)

পৃথিবীতে চার প্রকারের সেচ পদ্ধতি চালু আছে। যেমন- ভূপৃষ্ঠস্থ সেচ, ভূনিম্নস্থ সেচ, বর্ষণ সেচ ও ফোঁটা সেচ পদ্ধতি ।

ভূপৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি (Surface irrigation)

উৎস থেকে পানি মাটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত করে ফসল তে পৌঁছানোকে ভূপৃষ্ঠস্থ সেচ বলে। যেমন- খাল কাটা।

ভূনিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি (Sub-surface irrigation )

উৎস থেকে মাটির নিচ দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফসল তে পানি সরবরাহ করাকে ভূনিম্নস্থ সেচ বলে।

বর্ষণ সেচ পদ্ধতি (Sprinkler or Overhead irrigation )

বিশেষ প্রক্রিয়ায় বন্ধনলে পাম্পের সাহায্যে চাপ প্রয়োগে বৃষ্টির মত ছিটিয়ে পানি সরবরাহ করাকে বর্ষণ সেচ বলে। বর্ষণ সেচ সবচাইতে ভাল পদ্ধতি ।

ফোঁটা সেচ পদ্ধতি (Drip irrigation )

পানির উৎস থেকে নলের ভিতর দিয়ে ফসল গাছে ফোটায় ফোটায় পানি সরবরাহকে ফোঁটা সেচ বলে।
কোন এলাকায় কোন সেচ পদ্ধতির ব্যবহার অধিকতর উপযোগী তা নির্ভর করে সেখানকার পানির উৎস ও পরিমাণ, ভূমির বন্ধুরতা, মাটির প্রকৃতি, ফসল উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রমিকের পর্যাপ্ততা ইত্যাদির উপর।

বাঁধ সেচের সুবিধা

পানির নিয়ন্ত্রণ সহজ, পানির অপচয় কম, চারদিকে আইল থাকায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সেচ দেয়া সম্ভব। ভূমি য়ের সম্ভাবনা কম। পানি ইচ্ছানুযায়ী অনেকদিন পর্যন্ত ধরে রাখা যায়। যেসব ফসলের পানির চাহিদা বেশি এবং জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে সেসব েেত্র এ পদ্ধতি বিশেষ উপযোগী। যেমন- বোরো ও রোপা আমন ধান ইত্যাদি।

অসুবিধা

আইল তৈরিতে খরচ বৃদ্ধি পায় এবং ফসল ও জমির অপচয় হয়। ভারি বুনটের মাটি ছাড়া অন্যত্র তেমন উপযোগী নয়। প্রয়োজনের সময় জমি শুকোতে অনেক সময় নেয়।

বেসিন বা থালা সেচ পদ্ধতি (Basin irrigation )

বৃ জাতীয় গাছের গোড়ার চারদিকে আইল বেধে পানি সরবরাহ করাকে বেসিন বা থালা সেচ বলে। এ েত্রে যথেষ্ট দূরে দূরে লাগানো বহুবর্ষজীবী ফল জাতীয় বৃ ের দু’সারির মধ্যবর্তী স্থানে লম্বালম্বিভাবে কাটা একটি প্রধান নালা থেকে গাছের চারদিক বেষ্টিত বেসিন পর্যন্ত পার্শ্বনালা কেটে পানি সরবরাহ করা হয়। প্রয়োজন অনুসারে এ বেসিন পানি দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া হয়। নারিকেল, আম, লিচু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলগাছে সেচের জন্য এ পদ্ধতি বেশ উপযোগী।

বেসিন বা থালা সেচের সুবিধা

পানির নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং পানির অপচয় কম। প্রয়োজনীয় পরিমাণে এবং গভীরতায় সেচ দেয়া সম্ভব। ভূমি য়ের সম্ভাবনা থাকে না।

 

সেচ ও নিষ্কাশন

 

অসুবিধা

প্রাথমিক খরচ কিছুটা বেশি। অনেক পানির প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময়ে জলাবদ্ধতার জন্য গাছ মরে যেতে পারে ।

বর্ষণ/উপরি সেচ পদ্ধতি

এ পদ্ধতিতে হালকা ধাতব অথবা প্লাষ্টিক নলে কিছু দূর পর পর নজল ( সিঞ্চন যন্ত্র) যুক্ত করা থাকে। নলের ব্যাস ৫-১০ সেন্টিমিটার ও দৈর্ঘ্য ৮-২০ মিটার হয়। নলগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত করা হয়। নলের এক মাথা একটি পাম্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে ও অন্য মাথা বন্ধ থাকে।

পাম্প চালু হলে নলের ভেতরে চাপ সৃষ্টি হয় এবং নজলের মাধ্যমে পানি সজোরে বৃষ্টির মত ছিটিয়ে পড়ে। নলগুলো প্রয়োজনে এক তে থেকে অন্য েেত সহজে আনা নেয়া করা যায়। নজলগুলো ঘুর্ণায়মান থাকার ফলে পানি চারদিকে সমভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্ষণ সেচের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ স্থায়ীভাবেও বসানো হয়।

বর্ষণ সেচের সুবিধা

সমতল ও উঁচুনিচু উভয় প্রকারের জমির জন্য উপযোগী। তবে পাহাড়ি উঁচুনিচু জমিতে এবং বেলে ধরনের জমিতে (যার পানি ধারণ মতা খুবই কম) অত্যন্ত উপযোগী। অল্প পানি দ্বারা বেশি জায়গায় সেচ দেয়া যায়। পানির অপচয় হয় না বা জলাবদ্ধতার কোন সম্ভাবনা থাকে না। সর্বত্র সমভাবে সেচ দেয়া যায়। যে কোন ফসলের বেলায় অতি উপযোগী।

সেচের পানির সঙ্গে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা সম্ভব। নলগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সহজেই স্থানান্তর করা যায়।

অসুবিধা

প্রাথমিক খরচ বেশি। প্রবল বায়ু প্রবাহ সেচের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পানির কিছু অপচয় হয়। পানি পাতায় পড়ে বলে পাতায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা থাকে। যন্ত্রপাতি পরিবহণে বেশ খরচ পড়ে।

সেচ যন্ত্রপাতি

বাংলাদেশে কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত ও প্রধান সেচ যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল দোন, সেউতি এবং দমকল (পাওয়ার পাম্প)। বর্তমানে নলকূপ, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত সেচ যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল পার্সিয়ান হুইল (Persian wheel) ইজিপশিয়ান স্ক্রু (Ezyption screw) মোট (Mhote) পিকোটা ইত্যাদি।

এদের ব্যবহারও দিন দিন কমে আসছে। নিচে সচরাচর ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রপাতিগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো:

দোন ( Swing shovel)

টিন, কাঠ বা লোহার পাত দিয়ে নির্মিত এ নৌকাকৃতির যন্ত্রটি লম্বায় ২.৫ – ৫ মিটার, পাশে এবং গভীরতায় যথাক্রমে ২৫-৩০ এবং ২০-২৫ সেন্টিমিটার। এর এক মাথা খোলা ও অন্য মাথা বন্ধ ও কিছুটা বাঁকা ও সরু।

আড়াআড়িভাবে দুটো বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে পাতা লম্বা অন্য একটি বাঁশের এক মাথায় দোনের বাঁকা বন্ধ মাথাটি দড়ি দিয়ে সংযুক্ত থাকে, অন্য মাথায় একটি ওজন বেধে দেওয়া হয় । একজন লোক পানির ওপরে বাঁশের একটি মাচায় দাঁড়িয়ে দোনটি চালনা করেন।

 

সেউতি (Swing busket)

এটি বাঁশের চাটাই বা টিনের পাত বা বেতের তৈরি ত্রিভুজাকৃতির যন্ত্র । যন্ত্রটির সামনের দুকোণে দুটো এবং পিছনের কোণে দুটো লম্বা দড়ি বাঁধা থাকে। দুদিক থেকে দুজন লোক প্রত্যেকে দুটো দড়ির মাথা ধরে যন্ত্রটিকে দোলনার মত দুলিয়ে পানি ওঠায়। সেউতির পানি ধারণ মতা ১.৫-২ গ্যালন এবং প্রায় ১.৫ মিটার নিচ থেকে ১ ঘন্টায় ১৫০০-২৫০০ গ্যালন পর্যন্ত পানি সেচ দেয়া যায়। সাধারনত উঁচু জায়গায় সেচ দেবার জন্য সেউতি ব্যবহৃত হয়।

Leave a Comment