ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৪

ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৪ , পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। বাংলাদেশের মাঝামাঝি দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে
গিয়েছে। তাই এদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর—পূর্ব ও দক্ষিণ—পূর্ব দিকে রয়েছে কিছু পাহাড়িয়া অঞ্চল এবং ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়িয়া অঞ্চল। তাছাড়া পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় অবস্থিত বাংলাদেশের উত্তরে। এদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের ভূখন্ড উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু।

ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট – ৬ , পাঠ – ৬.৪

এর ফলে নদ—নদীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান জনিত কারণে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, কালবৈশখী, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রতিকূল অবস্থা দেখা যায়। জলবায়ুগত কোন কোন উপাদানগুলো ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টিকারী জলবায়ুগত উপাদানগুলো মধ্যে রয়েছে— ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বোস, বন্যা, খরা ইত্যাদি।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রোপকূল এলাকায় এর তীব্রতা বেশি। উপকূলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমুদ্রে যখন নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় তখন তা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আকারে স্থলভাগের দিকে আসে।

 

ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৪

 

এর ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই স্থলভাগে ঢুকে পড়ে। তখন তাকে আমরা জলোচ্ছ্বাস বলি। তীব্রতা ও স্থানভেদে এই জলোচ্ছ্বাসকে কখনও বলা হয় টর্ণেডো কখনও বা হারিকেন বা সাইক্লোন। জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা কেমন তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন সময়ে এই নাম দেওয়া হয়। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকার প্রায় ০.৮৩ মিলিয়ন হেক্টর বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততার প্রধান কারণ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভূমি প্লাবিত হওয়া।

জলোচ্ছ্বাসজনিত কারণে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং পরবতীর্কালের জন্য তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ—পূর্ব এবং পূর্বমধ্যাঞ্চলের ফসল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক—ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় এমনকি ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রধানত বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল) থেকে আরম্ভ করে আশ্বিন—কর্তিক (নভেম্বর) মাসে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়। বৈশাখ মাসে হলে তাকে প্রাক—খরিফ আর আশ্বিন—কর্তিক মাসে হলে তাকে প্রাক—রবি জলোচ্ছ্বাস বলা যায়। এই উভয় সময়েই কম—বেশি মাত্রায় তীব্র জোয়ারসহ জলোচ্ছ্বাসে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

জলোচ্ছ্বাসের ফলে সাধারণত ৬—১২ ঘন্টা পর্যন্ত সমুদ্র বা নদীর অতিরিক্ত পানি জমির উপরে থাকে। তবে পানি সরে যাওয়ার পরও ক্ষতির প্রভাব থেকে যায় অনেকদিন পর্যন্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রউপকূলবতীর্ ১৩টি জেলার প্রায় একশ থানা অর্থাৎ দেশের প্রায় এলাকা জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরাসরি জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও জলোচ্ছ্বাসে সাথের ঘূর্ণিঝড়ে দেশের অভ্যন্তরে আরও সমপরিমাণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন এলাকা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কবলিত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়, মানুষ ও গবাদি পশু আহত হয় অথবা মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসকবলিত এলাকার পানি দূষিত হয়, জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের ফলে বহু গবাদিপশু ও জীবজন্তু তাৎক্ষণিক মারা যায়, পশু খাদ্যের অভাব্ দেখা যায়, জীবিত গবাদিপশু উদরাময় এবং পেটের পীড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

ফসল ও অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হয় বা ভেসে যায়, মাটিতে লোনা ধরে এবং জলাবদ্ধতার ফলে জমির ফসল ও গাছপালা মারা যেতে পারে। কোন এলাকা জলোচ্ছ্বাস কবলিত হলে সেখানকার জন্য তাৎক্ষণিক কাজের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় চাহিদা ভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, কর্মসংস্থান, উপকরণ সরবরাহ, যোগাযোগ সবগুলির সমন্বয়েই পুনবার্সন পরিকল্পনা তৈরি করা
উচিত। তবে তাৎক্ষণিক উৎপাদনশীল করণীয়ের মধ্যে কৃষির গুরুত্ব সর্বাধিক।

 

krishi 6 ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৪

 

বন্যা সাধারণভাবে নদী—নালা, খাল—বিল দিয়ে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পানি বয়ে গেলেই বন্যা দেখা দেয়। বন্যা বাংলাদেশে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কোন কোন বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবার কোন কোন বছর বিভিন্ন সময়ে বন্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়। বৃষ্টি জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ দক্ষিণ—পশ্চিম মৌসুমী বায়ু উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এই মৌসুমী বায়ু উত্তরের পাহাড়ের গায়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। বাংলাদেশের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু হওয়াতে বৃষ্টির পানি নদ—নদী দিয়ে প্রবাহিত হয় দক্ষিণ দিকে। কিন্তু নদীর পানি ধারণ ও অপসারণ ক্ষমতার তুলনায় পানির পরিমাণ যদি বেশি হয় তবে নদ—নদীর অববাহিকা অঞ্চলসহ দেশের সমতল ভূমির অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।

এতে দেশের ন্যূনতম ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়। এতে কৃষি উৎপাদন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় ৪০—৭০%। আমাদের দেশের বন্যা দেখা দেয় সাধারণত বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে যে কোন সময়ে। যে কোন স্থানে বন্যা হওয়ার পর ফসল কৃষি উপকরণ, গবাদি পশু, হাঁস—মুরগী, মৎস্য ও অন্যান্য কৃষি সম্পদ, জমি ও মাটির প্রচুর ক্ষতি হয়। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়, রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে, গো—খাদ্য পাওয়া যায় না, পানি দূষিত হয়, পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যার সৃষ্টি হয়, গবাদি পশু অপুষ্টিতে ভোগে, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও কৃমির আক্রমণ বৃদ্ধি পায়, ঘাসে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়, গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়ে, পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়, অনেক পশুর মৃত্যু হয়।

কোন কোন এলাকায় আগাম বন্যার ফলে সময়মত জমি চাষ ও ফসলের বীজ বপন বা চারা রোপণও ব্যাহত হয়। প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় যে, বন্যায় কেবলমাত্র খাদ্য শস্যের বেলাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০—২৫ লক্ষ টন। এর সাথে সাথে নানা ধরনের আর্থ সামাজিক সমস্যাও দেখা দেয়।

খরা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত ও মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরার কারণে এদেশে ৩০—৭০% পর্যন্ত ফসলহানি হতে পারে। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি হলে সেই অবস্থাকে খরা বলা হয়। যে মৌসুমে সাধারণত মাটিতে রসের এই ঘাটতি অবস্থা থাকে তাকে বলা হয় খরা মৌসুম। খরার প্রধান প্রধান কারণগুলি হল অনাবৃষ্টি, সেচের পানির অভাব, প্রখর রৌদ্রতাপ ও বেলে বা ঢালু জমিতে কোন আচ্ছাদন না থাকা। খরা অবস্থায় চারা গাছ খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খরাকে তীব্র, মাঝারি ও সাধারণ এই তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে সকল মৌসুমেই খরা দেখা দিতে পারে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও গঙ্গা পলিমাটি এলাকার নওয়াবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর প্রচন্ড খরা দেখা দেয়। এ ছাড়াও সারাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে মাঝারি ধরনের খরা দেখা দেয়। গম, মসুর, সরিষা, গোল আলু, ধান, আখ, ফলমূল, শাক সব্জিসহ প্রায় সকল ধরনের ফসলেই খরায় গড়ে ৩০% ফলন কম হয়। খরা ফসলি জমি, পশু সম্পদ, মাছ ও পরিবেশের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে। খরায় পানির অভাবে গাছ মারা যায়। ফসলের বৃদ্ধি কমে যায়, জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধা হয়।

বীজ বোনা যায় না ও জমিতে লবণাক্ততা বাড়ে। খরায় চারা গাছ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্ক গাছে ফুল—ফল ঝরে যায়। খরায় উপসর্গ হিসাবে গাছের পাতা বা কচি ডগা দুপুরে সাময়িকভাবে নুয়ে পড়ে বা সরু হয়ে যায়। পানির অভাবে মানুষ—পশু—পাখি ও মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাঁচা ঘাসের অভাব হয়, পানি দূষিত হয়, গবাদিপশু ও পাখি অপুষ্টিতে ভোগে, গবাদিপশু ও পাখির বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয়, মাঠ ঘাটের ঘাস শুকিয়ে যায়, অধিক তাপে পশুপাখির অসহনীয় অবস্থায় সৃষ্টি করে, তাপ পীড়নে খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মৃত্যু হয়।

 

krishi 4 ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব , ইউনিট - ৬ , পাঠ - ৬.৪

 

পশু—পাখির খাদ্যের অভাব এবং রোগ বালাইও বেড়ে যায়। ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়।ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা খরা ছাড়াও বাংলাদেশের কৃষি শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুযোর্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের কৃষিতে ক্ষতি হয় অপূরণীয়। প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শস্য বিন্যাসে প্রয়োজনীয় পুনবিন্যাস, দুযোর্গকালীন ফসল ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ এবং দুযোর্গ পরবতীর্ পুনবার্সন কার্যক্রম গতিশীল ও সু—সমন্বিত করে বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির মোকাবেলা করা যেতে পারে।

আরও দেখুন :

Leave a Comment