বন ও বনায়নের প্রকারভেদ | ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

বন ও বনায়নের প্রকারভেদ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ , বন একটি দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। বন নানান ধরণের হতে পারে। উৎস অনুসারে বন প্রধানত এর প্রাকৃতিক বন ও মানুষের তৈরী বন। মানুষের তৈরী বনকে কৃত্রিম বনও বলা হয়। যে সমস্ত বনাঞ্চল মানুষের কোন রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই থাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে তাকে থাকৃতিক বন বলে। যেমন বৃহত্তর খুলনার সুন্দরবন, গাজীপুর ও মধুপুরের শালবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িবন ইত্যাদি। অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষের প্রয়োজনে গাছ লাগিয়ে যে বন তৈরী করা হয়েছে তাকে মানুষের তৈরী বন বা কৃত্রিম বন বলে।

বন ও বনায়নের প্রকারভেদ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২

যেমন: রামুর রাবার বন, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় বন, সামাজিক বন ইত্যাদি। তবে বনভূমির অবস্থান ও বিস্তৃতি অনুসারে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- পাহাড়িবন, সমতল ভূমির শালবন, সুন্দরবন বা ম্যানগ্রোভ বন এবং সামাজিক বন বা গ্রামীণ বন। এছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রনাধীন অশ্রেণিভুক্ত বন। বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈচিত্র্য, উদ্ভিদের ধরণ ও ইকোলোজিক্যাল বিবেচনায় দেশের বনাঞ্চলকে কয়েকটি ফরেষ্ট টাইপে ভাগ করা হয়। যেমনবিষুবীয় চিরসবুজ বন, বিষুবীয় আংশিক চিরসবুজ বন, বিষুবীয় আর্দ্র পত্রঝরা বন বা শালবন ও ম্যানগ্রোভ বা সুন্দরবন।

Capture 200 বন ও বনায়নের প্রকারভেদ | ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রCapture 201 বন ও বনায়নের প্রকারভেদ | ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

পাহাড়ি বন
বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের বৃহত্তর অংশই হলো পাহাড়ি বন। এ বনের বিস্তৃতি দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এই বনের পরিমাণ ১৩ লক্ষ হেক্টরেরও বেশী যা দেশের মোট আয়তনের ৪.৫৪ শতাংশ।পাহাড়ি বনের বিস্তৃতি : পাহাড়ি বন পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘিরে বিস্তৃত।

প্রধান প্রধান গাছপালা ও বন্যপ্রাণী : বাংলাদেশের পাহাড়ি বনের প্রধান প্রধান বক্ষ হৃ লো— গর্জন, চাপালিশ, সেগুন, তেলশুর, চিকরাশি, বৈলাম, গামার, বাঁশ, ঢাকিজাম, শীল কড়ই, ধারমারা ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রকার বন্য প্রাণীর মধ্যে হাতি, বানর, শূকর, বন মুরগি, সাপ, শিয়াল, নেকড়ে, কাঠবিড়ালী প্রভৃতি।

বন ও বনায়নের প্রকারভেদ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২

পাহাড়ি বনের বৈশিষ্ট্য
পাহাড়ি বনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—

১। এ বনের গাছপালা চিরহরিৎ ও পত্রঝরা প্রকৃতির।

২। গাছপালা কয়েক স্তরে জন্মায়। যেমন নীচের স্তরে ছোট গাছপালা, দ্বিতীয় স্তরের গাছপালা ১৫—৩০ মি. পর্যন্ত উচু হয় এবং তৃতীয় স্তরের গাছপালা সর্বোচ্চ ৫০ মি. পর্যন্ত উচু হয়।

৩। এ বনে বহু বিচিত্র প্রজাতির গাছপালা বিদ্যমান। ধারণা করা যায় প্রায় ৬০০ প্রজাতির গাছপালা এ বনে আছে।

৪। এ বনে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৮০০—৫১০০ মি.মি.।

৫। এ বনের উচু স্তরে ৪৫—৬০ মিটার উচ্চতার গাছপালা আছে। মাঝের স্তরে ২৫—২৭ মিটার উচ্চতার গাছপালা বিদ্যমান।

সমতল ভূমির শালবন
ঢাকা জেলার সাভার, গাজীপুরের ভাওয়াল গড়, টাংগাইল ও ময়মনসিংহের মধুপুর গড় নিয়ে সমতল ভূমির বন গড়ে উঠেছে। আগে এ বন রংপুর, দিনাজপুর ও কুমিল্লা জেলায়ও বি¯ৃÍত ছিল। এ বনের প্রধান বৃক্ষ হলো শাল। যারজন্য এ বনের অপর নাম শালবন। শাল গাছ কাটার পর গোড়া থেকে অসংখ্য কুশি বাহির হয় বলে স্থানীয় ভাষায় একে গজারি বনও বলা হয়।

সমতল ভূমির বনের বিস্তৃতি : এ বন বৃহত্তর ঢাকার সাভার ও গাজীপুর অঞ্চল, ময়মনসিংহের ভালুকা ও মুক্তাগাছা, টাংগাইলের মধুপুর গড় অঞ্চল, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা, কুমিল্লা জেলার লালমাই ও ময়নামতি এলাকা, রংপুরের মিঠাপুকুর, দিনাজপুরের সদর, বিরামপুর ও হাকিমপুর এবং রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় বিস্তৃত।

সমতল ভূমির বনের বৈশিষ্ট্য

১। এ বনের প্রধান বৃক্ষই হলো শাল। বনের ৯০ ভাগ এলাকায় শাল গাছ বিদ্যমান। এইজন্য ইহা শালবন নামে সমধিক পরিচিত।

২। শাল বৃক্ষ ২০—২৫ মিটার পর্যন্ত উচু হয়। শীতকালে শাল বৃক্ষের সমস্ত পাতা ঝরে যায়। এজন্য ইহাকে পাতাঝরা বন বা উবপরফঁড়ঁং ভড়ৎবংঃ বলে।

৩। এ বনের কোথায়ও উচু ও কোথায়ও নিচু। উচু জায়গাকে বলে চালা যেখানে শালসহ অন্যান্য বৃক্ষ জন্মায়। নিচু জায়গাকে বলে বাইদ যেখানে প্রধাণত কৃষি কাজ অর্থাৎ ধান চাষ করা হয়ে থাকে।

৪। এ বনে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০০০ মি.মি. এর কম। এ বনের প্রধান বৃক্ষ হলো শাল বা গজারী। অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে হলদু, পলাশ, কুম্ভি, হাড়গোজা, হরিতকী, বয়রা উল্লেখযোগ্য।

বনায়ন 2 বন ও বনায়নের প্রকারভেদ | ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

ম্যানগ্রোভ বন

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি হয়েছে। এ বনের অধিকাংশ এলাকা জোয়ার ভাটার কারণে দিনে দু’বার লোনা পানি দ্বারা বিধৌত হয় বলে একে ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। এই বন সুন্দরবন নামে সমধিক পরিচিত। সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় এবং বাকী অংশ পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলায় অবস্থিত। এ বনাঞ্চলের আয়তন প্রায় ৬১১৭ বর্গমাইল যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা ৪.০৭ ভাগ।

ম্যানগ্রোভ বনের বিস্তৃতি : প্রাকৃতিকভাবে ম্যানগ্রোভ বন বা সুন্দরবন বৃহত্তর খুলনা জেলার দক্ষিণাংশে এবং চট্টগ্রামের চকরিয়া অংশে অবস্থিত। ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্য ম্যানগ্রোভ বা সুন্দরবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো :

১। ম্যানগ্রোভ বনের অধিকাংশ এলাকা জোয়ার ভাটার ফলে দৈনিক দু’বার লোনা পানি দ্বারা বিধৌত হয়।

২। এ বনের গাছপালা লোনা পানি সহনশীল এবং বৃক্ষসমূহের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম।

৩। সুন্দরবনের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৬৫১ থেকে ১৭৭৮ মি.মি.।

৪। এ বনের মাটিতে অতিরিক্ত লবণ ও পচা জৈব পদার্থ থাকায় অক্সিজেনের অভাব ঘটে বলে গাছপালা শ্বাসমূল তৈরী করে। বৃক্ষসমূহ চিরহরিৎ।

৫। ম্যানগ্রোভ বনের আবহাওয়া সব সময় আর্দ্র এবং লোনা পানিতে ভেজা থাকে।

প্রধান প্রধান গাছপালা ও বন্যপ্রাণী : ম্যানগ্রোভ বনের প্রধান প্রধান বৃক্ষ হলো— সুন্দরী, ধুন্দুল, গরান, বাইন, কেওড়া, পশুর, গোলপাতা, হেন্তাল ইত্যাদি। বন্যপ্রাণীসমূহের মধ্যে— রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর ইত্যাদি।

সামাজিক বন সামাজিক বন বলতে আমরা বুঝি “যে বন সৃষ্টিতে বা বন ব্যবস্থাপনায় জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং এ বনায়নে যে লাভ হয় তা অংশগ্রহণকারী জনগণ সরাসরি ভোগ করে। অর্থাৎ জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণে এবং জনগণ দ্বারা সৃষ্ট বনকে সামজিক বন বলে ”। সামাজিক বনের ধারণাটি সর্বপ্রথম ভারতের জাতীয় কৃষি কমিশন ১৯৭৬ সালে প্রবর্তন করে। সাধারণভাবে সামজিক বনায়ন সেইসব বৃক্ষ উৎপাদন কর্মকান্ডকে বুঝায় যা স্থানীয় জনসাধারণকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জড়িত করে এবং তাদের প্রত্যক্ষ সংরক্ষণ তৎপরতা ও ব্যবস্থাপনায় বাস্তবায়ন করা হয়। সামজিক বন বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: (ক) কমিউনিটি ফরেষ্ট (খ) গ্রামীণ বন (গ) অংশীদারিত্বের বন (ঘ) গ্রামীণ উন্নয়নের বন বা স্বনির্ভর বন ইত্যাদি।

বনায়ন 4 বন ও বনায়নের প্রকারভেদ | ইউনিট – ১৫ , পাঠ – ১৫.২ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

সামাজিক বনের বিস্তৃতি : সাধারণভাবে সমগ্র বাংলাদেশে সামাজিক বন বিস্তৃত। তবে বিশেষভাবে প্রাকৃতিক বনের ক্ষয়িষ্ণু অংশে, রাস্তা—ঘাট, রেল—লাইনের ধারে, স্কুল কলেজের আঙ্গিনায়, নদী ও বাঁধের খালি জায়গায় এ বন বি¯ৃÍত।

সামাজিক বনের বৈশিষ্ট্য সামাজিক বনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

১. স্থানীয় জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ বনায়ন কর্মসূচী পরিচালিত হয়।

২. উপকারভোগী জনসাধারণ সংঘবদ্বভাবে এ বনায়ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে।

৩. এ বনায়নের মাধ্যমে উপকারভোগী জনগণের জ্বালানি, পশুখাদ্য ও কাঠের চাহিদা পূরণ হবে।

৪. এ বনায়ন কর্মসূচী গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠির উন্নয়নে এবং দারিদ্রমোচনে সহায়ক হতে হবে।

৫. উপকারভোগী জনগণ ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সুনির্দিষ্ট চুক্তিনামা থাকতে হবে।

৬. উপকারভোগীদের দলভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধান প্রধান গাছপালা : এ বনায়নের প্রধান উদ্দেশ্য গ্রামীণ জনগণের প্রয়োজনীয় জ্বালানি, পশুখাদ্য এবং ঘরবাড়ি বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের চাহিদা পূরণ করা। তাই প্রধাণত জ্বালানি কাঠ যেমন— ইউক্যালিপটাস, কড়ই, বাবলা ইত্যাদি, পশুখাদ্যের জন্য ইপিল ইপিল, গ্লিরিসিডিয়া বকুল, ডুমুর ইত্যাদি এবং ঘরবাড়ি বানানোর কাঠ যেমন: আকাশমনি, মেনজিয়াম, গোড়ানিম, কড়ই ইত্যাদি ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment