বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ , কমছে ভূমি, বাড়ছে মানুষ। ভূমি আর জনসংখ্যার এই ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের ক্ষুধা, কমছে ভূমির সক্ষমতা। ‘স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন’ সফল করতে গিয়ে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানকে। বাড়তি মানুষের বাস্তুভিটার চাপ সামলাতে গিয়ে বন-জঙ্গল তো বহু আগেই কাটা গেছে; আধুনিক পৃথিবীতে হারাতে বসেছে গ্রামের সংজ্ঞায়নও। ভরাট হয়ে যাচ্ছে ফসলী জমি, খেলার মাঠ, খাল-বিল-পুকুর! রূপকথায় ঠাঁই পেতেছে গোলায় ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের সোনালী সময়টাও।
বায়োফ্লকে মাছ চাষে কম খরচে অধিক লাভ

তবে, অধুনা যুগের কৃষি সংকটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে কার্যকর একটি উপায় হতে পারে বায়োফ্লক। মাছ চাষের জন্য পুকুর লাগবেই এমন কোনও কথা নেই। তার জন্য চাই কেবল উপযুক্ত জলাধার। বায়োফ্লকের ব্যাতিক্রমী এই ধারণাকে খাটিয়েই মাছ চাষ এখন ঢুকে গেছে মানুষের ঘরে। নির্দিষ্ট কলাকৌশল আর প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ঘরের ভিতর চৌবাচ্চাতে চাষ করা যাচ্ছে মাছ।
একদিকে খরচ কমে যাচ্ছে তিন ভাগের এক ভাগ, আরেকদিকে উৎপাদনও হচ্ছে ২০ গুণ বেশি। বাড়ির ভেতরে এ্যাকুরিয়ামে শখের বশে আমরা যে মাছ পালন করি, সেই এ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিরই উন্নত সংস্করণ হচ্ছে নতুন এই প্রযুক্তি। ‘বায়োফ্লক’ ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব।
প্রযুক্তিটির জনক ইজরায়েলি বিজ্ঞানী ইয়ান এভনিমেলেচ। এবার বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক, কি এই বায়োফ্লক আর কিভাবেই বা এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে সম্ভব অধিক লাভবান হওয়া।

বায়ো শব্দটি এসেছে গ্রীক বায়োস থেকে, যার অর্থ জীবন। আর ফ্লক অর্থ হচ্ছে আলতোভাবে লেগে থাকা কণার সমষ্টি। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগত ভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চৌবাচ্চার পানিতে ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ও শৈবালের সমম্বয়ে পাতলা একটি আস্তরণ তৈরি হয়।
যা পানিকে ফিল্টার করে পানি থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয় এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ যে উপাদান গুলো থাকে সেগুলো মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অনুজীব মুলত দুটি প্রধান ভূমিকা পালন করে-
- অণুজীব পানিতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ যৌগ গুলোকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিনে রূপান্তর করার মাধ্যমে পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখে।
- এই প্রযুক্তি খাদ্য রূপান্তর হার এবং মাছ চাষে খাদ্য ব্যয় কমিয়ে চাষের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করে।

একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক এই ব্যাতিক্রমী প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করতে গেলে অবশ্যই জানতে হবে কার্যকর উপায়ে ফ্লক তৈরির কলাকৌশল। আর এই ফ্লক তৈরিতে লাগবে চৌবাচ্চা বা ট্যাংক বা হাউজ, লোহার খাঁচা, ত্রিপল, আউটলেট, টিডিএস মিটার, পিএইচ মিটার, অ্যামোনিয়াম টেস্ট কিড, অক্সিজেনের জন্য মটর, বিদ্যুৎ, মাছের পোনা, খাদ্য ও প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।
বায়োফ্লকের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের ট্যাংকই চাইলে তৈরি করা যায়। ইট সিমেন্ট দিয়ে কিংবা স্টিলের পাত দিয়ে কিভাবে স্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয় সেটা সবাই জানেন। এখানে আমরা জানবো কিভাবে অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী ট্যাংক তৈরি করতে হয়। এর জন্য প্রথমে গ্রেড রড দিয়ে ট্যাংকের বৃত্তাকার খাঁচাটি তৈরি করতে হবে। তারপর যে স্থানে ট্যাংকটি স্থাপন করা হবে সেই জায়গাতে খাঁচার পরিধির সমান করে সিসি ঢালাই দিতে হবে। বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে পানির একটি আউটলেট পাইপ স্থাপন করতে হবে।
এরপর খাঁচাটিকে ঢালাই মেঝের উপর স্থাপন করে মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। মেঝের মাটি শক্ত ও সমান হলে ঢালাইয়ের পরিবর্তে পরিধির সমান করে পুরু পলিথিন বিছিয়েও মেঝে প্রস্তুত করা যায়। এরপর উন্নতমানের তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে সম্পূর্ণ খাঁচাটি ঢেকে দিতে হবে। তার উপর পুরু পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদিত করে তাতে পানি মজুদ করতে হবে।
জানা জরুরী ৩০০০ লিটার পানি ধারনের জন্য ট্যাংকের সাইজ হবে ৬ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৫০০০ লিটারের জন্য ৮ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ৭৫০০ লিটারের জন্য ১০ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা, ১০০০০ লিটারের জন্য ১৩ ফিট ব্যাস এবং ৪.৫ ফিট উচ্চতা।
তারপর ট্যাংকের সঙ্গে এয়ার পাম্পের সংযোগ ঘটাতে হবে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য। প্রতি ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ৭০ থেকে ৮০ ওয়াটের এয়ার পাম্প লাগবে; সেইসঙ্গে ৮ থেকে ১০টি এয়ার স্টোন প্রয়োজন হবে।

স্থায়ী বা অস্থায়ী; যেমন ট্যাংকই হোক না কেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের পরবর্তী ধাপ শুরু হয় চাষের ট্যাংকে পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। প্রথমে ট্যাংক ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এর পর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এরপর পানিতে আয়রনের মাত্রা ০.২ পিপিএম এর বেশি হলে পানি থেকে আয়রন দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। আয়রন দূর করার জন্য প্রতি টন পানিতে ২৫- ৩০ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগের পর ১০ – ১২ ঘন্টা একটানা বাতাস সরবরাহ করতে হবে।
তারপর ৫০ পিপিএম হারে ফিটকিরি প্রয়োগ করে আরও ১২ ঘন্টা পানিতে অনবরত বাতাস সরবরাহ করতে হবে। ২৪ ঘন্টা পর পানিতে ১০০ হারে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ( CaCO3) চুন প্রয়োগ করে বাতাস সরবরাহ নিয়মিত করতে হবে। এরপর নির্বাচিত পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করে পানি প্রবেশ করাতে হবে। এসময় পানির যে গুনাবলীর দিকে নজর রাখতে হবে সেগুলো হলো-
- তাপমাত্রা থাকতে হবে ২৫ – ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে
- পানির রং – সবুজ, হালকা সবুজ, বাদামী হলে চলবে
- দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান প্রতি লিটারে ৭- ৮ মিলিগ্রাম থাকতে হবে
- পিএইচ হতে হবে ৭.৫ থেকে ৮.৫ এর মধ্যে
- ক্ষারত্ব থাকতে হবে প্রতি লিটারে ৫০ – ১২০ মিলিগ্রাম
- খরতা প্রতি লিটারে ৬০ – ১৫০ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম প্রতি লিটারে ৪ – ১৬০ মিলিগ্রাম
- অ্যামোনিয়া প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
- নাইট্রাইট প্রতি লিটারে ০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
- নাইট্রেট প্রতি লিটারে ০ – ৩ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস প্রতি লিটারে ০.১ – ৩ মিলিগ্রাম
- হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম
- আয়রন প্রতি লিটারে০.১ – ০.২ মিলিগ্রাম
- পানির স্বচ্ছতা ২৫ – ৩৫ সে.মি.
- পানির গভীরতা – ৩ থেকে ৪ ফুট
- ফলকের ঘনত্ব – ৩০০ গ্রাম / টন
- টিডিএস প্রতি লিটারে ১৪০০০ – ১৮০০০ মিলিগ্রাম
- লবণাক্ততা – ৩ – ৫ পিপিটি
এ তো গেল মাছের জন্য জলাধার নির্মাণের খেলা। এবার তার বাঁচা ও বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত জলজ পরিবেশ, অর্থাৎ ফ্লক তৈরির পালা। পানিতে ফ্লক তৈরির জন্য প্রথমে চাষ ট্যাংকের ১২ ভাগের ১ ভাগ পানি নিয়ে সেই পানিতে ১০০০ পিপিএম হারে আয়োডিনবিহীন লবণ প্রয়োগ করতে হবে। লবণ প্রয়োগের পর টিডিএস পরীক্ষা করে নিতে হবে। বায়োফ্লকের জন্য ১৪০০ – ১৮০০ পিপিএম, টিডিএস থাকা ভাল।
যদি লবণ প্রয়োগের পর কাঙ্খিত টিডিএস পাওয়া না যায়, তা হলে কম পরিমাণ লবণ প্রয়োগ করে আদর্শ মাত্রায় টিডিএস রাখতে হবে। এরপর প্রথম ডোজে ৫ পিপিএম প্রেবায়োটিক, ৫০ পিপিএম চিটাগুড়, ৫ পিপিএম ইস্ট, পানি প্রতি টনের জন্য ১ লিটার, একটি প্লাস্টিকের বালতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে ৮- ১০ ঘন্টা কালচার করে প্রয়োগ করতে হবে। ২য় দিন থেকে ১ পিপিএম প্রোবায়োটিক, ৫ পিপিএম চিটাগুড়, ১ পিপিএম ইস্ট, প্রতি টনের জন্য ১ লিটার পানি দিয়ে কালচার করে প্রতি দিন প্রয়োগ করতে হবে।

পানিতে যথাযথ পরিমাণ ফ্লক তৈরি হলো কিনা সেটা বুঝতে কিছু ব্যাপার নজরে রাখতে হবে। যেমন-
- পানির রং যেন সবুজ বা বাদামী দেখায়।
- পানিতে যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ কণা দেখা যায়।
- পানির অ্যামোনিয়া পরীক্ষা করলে যেন পানি অ্যামোনিয়া মুক্ত দেখায়।
- প্রতি লিটার পানিতে ফ্লকের ঘনত্ব যেন ০.৩ গ্রাম পাওয়া যায়।
- ক্ষুদেপানা দেওয়ার পর তাদের যেন ঠিকঠাক বংশবিস্তার হয়।

এইভাবে বায়োফ্লক তৈরি করে চাষ করা যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ । কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর যেসব মাছ চাষ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, চিংড়ি প্রভৃতি। তবে, যারা বায়োফ্লক প্রযুক্তিটি প্রথমবারের মত ব্যবহার করতে যাচ্ছেন তারা অবশ্যই প্রথমে তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ দিয়ে চাষ শুরু করবেন। অন্যান্য দেশে অবশ্য তেলাপিয়া ও চিংড়িই মূলত বায়োফ্লক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। বায়োফ্লকে চাষকৃত মাছের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছটির নাম চিংড়ি।
বায়োফ্লকে পুকুরের চেয়ে মাছের খাদ্য খরচ ৩০ শতাংশ কম লাগে। মাছ চাষে মুলত শতকরা ৬০ ভাগ খরচই খাবারের জন্য ব্যয় হয়। এই পদ্ধতিতে সিস্টেমের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ট্যাংকেই অণুজীব প্রোটিন তৈরি করে, তাই এ পদ্ধতিতে অন্যান্য সিস্টেমের চেয়ে অনেক কম খাবার লাগে। ফলে চাষের খরচ কমে যায় এবং লাভ হয় বেশি। তাছাড়া পুকুরের সমপরিমাণ জায়গায় বায়োফ্লকে অন্তত ২০ গুণ বেশি মাছ চাষ করা যায়। অর্থাৎ কম জায়গা ব্যবহার করে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন সম্ভব এই পদ্ধতিতে।

বায়োফ্লকে মাছের রোগবালাই হয় খুবই কম। এই পদ্ধতিতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপকারি ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয় বলে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে পুরো সিস্টেমকে প্রদান করা সম্ভব হয় উচ্চ বায়োসিকিউরিটি। ফ্লকে ব্যবহৃত এসব উপকারি ব্যাকটেরিয়া মাছের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বৃদ্ধি পেতে বাধা প্রদান করে।
ফলে ঐসব ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ থেকে রক্ষা পায় মাছ। তাই উন্নত এই প্রযুক্তিতে মৎস্য খামারকে রক্ষা করা সম্ভব হয় রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে। শুধু কি তাই? এটি স্বীকৃতভাবে পরিবেশবান্ধব একটি মাছ চাষ পদ্ধতি। কারণ এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে।
আরও দেখুনঃ