সবজি চাষের সঠিক নিয়ম এবং উপায় , বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে প্রতিনিয়ত চাষের জমি কমে যাচ্ছে। কিন্তু খাদ্যের চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে। ফলে ফসলের সঠিক যোগান দিতে আমাদের সবজি চাষ হোক কিংবা সাধারণ ভেষজ উদ্ভিদ চাষ হোক; সঠিক উপায় মেনে চললে ভালো ফল আশা করতে পারবো।
আমরা যেসব ফলমূল রান্না করে খাই, তাদের সাধারণভাবে সবজি বলা হয়। যেমন—আলু, বেগুন, পটল, মুলা, ঝিঙে, কপি, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি।
ঋতু বা বপনকাল অনুসারে সবজিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—গ্রীষ্মকালীন বা বর্ষাকালীন সবজি ও শীতকালীন সবজি।
Table of Contents
সবজি চাষের সঠিক নিয়ম এবং উপায়
খারিফ সবজি
শসা, বেগুন, ঢেঁড়স, পটল, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, উচ্ছে প্রভৃতি সবজির চাষ গ্রীষ্মকাল বা বর্ষাকালে হয়। এদের খারিফ সবজি বলে।
রবি সবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, টম্যাটো, বীট, গাজর, শিম, মুলা প্রভৃতি সবজির চাষ শীতকালে হয়। এদের রবি সবজি বলে। হেমন্তকালে বীজ বুনে যে ফসল কৃষক বসন্তকালে ঘরে তোলে তা-ই রবিশস্য।
সবজি চাষের জন্য প্রধান উপকরণ হল জমি। সাধারণত সবজি চাষের জন্য দো-আঁশ মাটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী। মাটিতে যেন রৌদ্র পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সবজি চাষের জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেগুলো হল—কোদাল, খুরপি, নিড়ানি, পানির ঝাঁঝরি ইত্যাদি।
সবজি চাষের জন্য কয়েক দফা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যেমন— বীজতলা কর্ষণ ও প্রস্তুত করা, বীজ বপন, চারা লাগানো, সেচ, সার প্রয়োগ, আগাছা তোলা, কীটনাশক প্রয়োগ, ফসল তোলা।

বীজতলা ও মূল জমি প্রস্তুত করা
কিছু সবজি আছে যাদের চারা প্রস্তুত করে মূল জমিতে লাগানো হয়। সে কারণে সবজির বীজতলা প্রয়োজন। চারা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে যে জমি নির্বাচন করা হয়, তাকে বীজতলা বলে। বীজতলার জমি পার্শ্ববর্তী জমি থেকে অন্তত ১৫ সেমি উঁচু হওয়া চাই। একটি আদর্শ বীজতলার আকৃতি হবে লম্বায় ৩০০ সেমি, এবং চওড়ায় ১২০ সেমি.। বীজতলায় যাতে অবাধ রোদ পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। প্রতি বীজতলার চারিধারে গভীর জলনিকাশের নালা রাখা প্রয়োজন। বীজতলার মাটি বেশ নরম, উর্বর, ঝুরঝুরে হওয়া দরকার। বীজতলার মাটিকে কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে ঝুরাঝুরা করে নিতে হবে। সার হিসাবে গোবর, কম্পোস্ট সার, খৈল, অ্যামোনিয়াম সালফেট, সুপার ফসফেট ব্যবহার করা হয়। বীজতলা তৈরি হয়ে গেলে মাটি সামান্য আর্দ্র অবস্থায় থাকার সময় পাতলা করে বীজ বপন করতে হবে।

যে জমিতে চারা লাগানো হবে সেখানকার জমি ভালোভাবে কর্ষণ করে এবং প্রয়োজনমতো সার প্রয়োগ করে জমি তৈরি করে রাখতে হবে।
বীজ বপন
ভালো পুষ্ট, রোগহীন বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে। মাটি সামান্য ভিজে অবস্থায় থাকার সময় পাতলা করে বীজ বপন করতে হবে। বীজ বপনের পর প্রত্যহ সকাল-বিকাল ঝাঁঝরি দিয়ে জল দিতে হবে। রোদের সময় বীজতলা খড়, চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
চারা লাগানো
বীজ বপনের ১৫ দিন পর চারাগুলো এক ইঞ্চির মতন লম্বা হলে বীজতলা থেকে চারা তুলে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে। চারা তুলবার আগে বীজতলাকে ভিজিয়ে রাখতে হবে। চারা তুলে লাগানোর উপযুক্ত সময় হল বিকেল। চারা বীজতলা থেকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট সারি ও গাছের দূরত্ব রেখে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি শক্ত করে চেপে দিতে হবে। পরে গোড়ায় সামান্য জল দিতে হবে।
সেচ
চারাগাছ লাগানোর ১০-১৫ দিন পর থেকে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। গাছের গোড়ায় যাতে অতিরিক্ত পানি না জমে তার জন্য নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

সার প্রয়োগ
চারা লাগানোর কিছুদিন পর থেকে গাছের গোড়ার চারপাশে ৩/৩ ইঞ্চি দূরত্বে সার প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে উপযুক্ত পরিমাণে গোবর বা পাতাপচা সার প্রয়োগ করলে মাটি খুব সরস ও সতেজ থাকে।
আগাছা দমন
সবজি গাছের চারপাশের মাটিকে হালকাভাবে কর্ষণ করে আগাছাগুলো বেছে গাছের গোড়ায় মাটি ধরিয়ে দিতে হবে। সবজি খেতে আগাছা থাকলে সবজির বৃদ্ধি কমে যায় এবং উদ্ভিদ দুর্বল হয়ে পড়ে। তার ফলে ফসল সহজেই কাঁটশত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাই জমি ও জমির আশপাশ আগাছামুক্ত রাখা একান্ত দরকার।
কীটনাশক প্রয়োগ
গাছে পোকামাকড়ের উপদ্রব হলে মাঝে মাঝে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। এতে ফলনের হার বৃদ্ধি পায়। এর পরেই নির্দিষ্ট সময়ে ফসল তোলার কাজ করতে হবে।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও পুষ্টি
উদ্ভিদ বৃদ্ধি ও পুষ্টির প্রয়োজনে মাটি, জল ও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও দেহগঠনের জন্য মাটিতে ১৬টি খাদ্য উপাদান প্রয়োজন। এগুলোকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
প্রধান বা মুখ্য খাদ্যোপাদান (Major nutrients): কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম প্রভৃতি উপাদানগুলো গাছ বেশি মাত্রায় গ্রহণ করে বলে এদের প্রধান বা মুখ্য খাদ্যোপাদান বলে। এদের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, জল ও বাতাস থেকে এবং বাকিগুলো উদ্ভিদ মাটি থেকে গ্রহণ করে।
গৌণ খাদ্যোপাদান (Secondary nutrients): ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার— এই উপাদানগুলো উদ্ভিদ কিছুটা কম পরিমাণে গ্রহণ করে। এদের বলা হয় গৌণ খাদ্যোপাদান।
অণুখাদ্য উপাদান (Micro Trace elements): আয়রন, জিংক, বোরন, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, ক্লোরিন- এই উপাদানগুলো অতি সামান্য পরিমাণ উদ্ভিদের প্রয়োজন হয়। এগুলোকে অণুখাদ্য উপাদান বলে।
উদ্ভিদদেহে প্রধান, গৌণ ও অণুখাদ্য সবই অপরিহার্য। কারণ এদের যেকোনও একটির অভাব ঘটলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে। সেজন্য এদের সকলকেই অপরিহার্য উপাদান বলে।
আরও পড়ুন :