তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ – ৭.৪ , ইউনিট-৭

তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ – ৭.৪ , ইউনিট-৭ , তেল ফসল ও এর গুরুত্ব যে সমস্ত মাঠ ফসলের বীজ থেকে ভোজ্য তেল পাওয়া যায় তাদেরকে তেলজাতীয় ফসল  বলা হয়। ভোজ্য তেল আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তেল বা চর্বি দেহে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কর্মশক্তি সরবরাহ করে। এই তেল ভিটামিন অ, উ, ঊ এবং ক পরিশোষণে সহায়তা করে। প্রাণী থেকে প্রাপ্ত তেল ব্যয়বহুল হওয়ায় উদ্ভিদজাত তেলই বাঞ্ছনীয়। উদ্ভিদজাত তেল সহজ পাচ্য এবং এর পুষ্টিমানও প্রাণীজ তেল থেকে বেশি। তেল বীজ থেকে তেল আহরণ করার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে খৈল বলা হয়।

তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ – ৭.৪ , ইউনিট-৭

এই খৈল গবাদি পশু, হাঁস মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় সব ধরনের খৈল জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা হয়। কিছু তেল ফসল যেমন— চীনাবাদাম ও সয়াবীন চাষ করলে তাদের মুলের গুটি (ঘড়ফঁষব) থেকে জমিতে নাইট্রোজেন সার যোগ হয়। সরিষা, সূর্যমুখী, তিল ও গর্জন তিলের ক্ষেতে মৌমাছি পালন করে মধু সংগ্রহ করা যায়। নানা প্রকার তেল বিভিন্ন প্রকার শিল্পজাত সামগ্রী যেমন— মোম, সাবান ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

Capture 79 তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ - ৭.৪ , ইউনিট-৭ Capture 1 12 তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ - ৭.৪ , ইউনিট-৭

সূর্যমুখী চাষ ঃ

এর চাষ পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো  জলবায়ু সূর্যমুখী আলো নিরপেক্ষ ফসল হওয়ায় সারা বছর এর চাষ করা যায়। বীজের অঙ্কুরোদগম ও চারা গজানোর পর কিছুদিন ঠান্ডা আবহাওয়া উত্তম। চারার দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্পায়নের জন্য কিছুটা উষ্ণ আবহাওয়া প্রয়োজন। এ ফসলে তাপমাত্রার প্রভাব অনেকটা কম। দৈহিক বৃদ্ধির সময় হালকা বৃষ্টিপাত হলে ভালো। তবে ভালো ফলনের জন্য বীজ পাকার সময় মেঘমুক্ত আকাশ খুবই উপযোগী। মাটি বা জমি নির্বাচন সূর্যমুখী সাধারণত সব ধরনের মাটিতেই জন্মানো যায়। তবে দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি উত্তম। বৃষ্টি বা সেচের পানি জমে থাকে না এমন জমি সূর্যমুখী চাষের জন্য ভালো।

উঁচু থেকে মাঝারি নিচু জমিতে এ ফসল চাষ করা যায়। মাটিতে আর্দ্রতা বা রসের পরিমাণ বেশি হলে বীজ বুনার পর তা পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে। জাত কিরণী (ডিএস ১), বারি সূর্যমুখী ২ ইত্যাদি। কিরণী জাতটি অন্যান্য জাতের চেয়ে খাটো হয়। তাই ঝড় বা বৃষ্টিতে সহজে হেলে পড়ে না। বপন সময় সব মৌসুমেই সূর্যমুখী চাষ করা যায়। রবি মৌসুমে অগ্রহায়ন মাসে (মধ্য নভেম্বর—মধ্য ডিসেম্বর), খরিফ ১ মৌসুমে বৈশাখ মাসে (মধ্য এপ্রিল—মধ্য মে) এবং খরিফ ২ মৌসুমে ভাদ্র মাসে (মধ্য আগস্ট— মধ্য সেপ্টেম্বর) বীজ বপন করা হয়। জমি তৈরি সূর্যমুখী গভীরমূলী ফসল।

তেলফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ - ৭.৪ , ইউনিট-৭

তাই জমি ভালভাবে চাষ করতে হয়। জমি সাধরণত ৪—৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও উপরিভাগ সমান করতে হয়। চাষকৃত জমি ছোট ছোট প্লটে ভাগ করলে পরবর্তী সময়ে আন্তঃপরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। সার প্রয়োগ সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে সূর্যমূখীর ফলন ভালো হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ১৮০—২০০ কেজি ইউরিয়া, ১৬০—১৮কেজি টিএসপি, ১২০—১৫০ কেজি এমওপি, ১২০—১৫০ কেজি জিপসাম, ৮—১০ কেজি জিংক সালফেট, ১০—১২ কেজি বরিক এসিড ও ৮০—১০০ কেজি ম্যানেসিয়াম সালফেট প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ বাকী সব সার জমি তৈরির শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

বাকী অর্ধেক ইউরিয়া দু’ভাগ করে ১ম ভাগ চারা গাজনোর ২০—২৫ দিন পর এবং ২য় ভাগ ৪০—৪৫ দিন পর বা ফুল আসার আগে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতিবার সেচের পর ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে সারের সঠিক ব্যবহার হয়। বীজ হার প্রতি হেক্টরে ৮—১০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। বীজশোধন মাটি ও বীজবাহিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি কেজি সূর্যমুখী বীজ শোধনের জন্য ৩ গ্রাম ভিটাভেক্স—২০০ বা কাঙ্খিত মাত্রার অন্য কোন বীজশোধক প্রয়োজন।

ঢাকনাযুক্ত বড় একটি প্লাষ্টিকের পাত্রে বীজ নিয়ে মাত্রানুযায়ী বীজশোধক ঔষধ মিশিয়ে পাত্রের মুখ বন্ধ করে ভালোভাবে ঝেঁকে নিয়ে একদিন রেখে দেবার পর বীজ জমিতে বপন করতে হয়। বপন পদ্ধতি সূর্যমুখীর বীজ সারিতে বপন করা হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সে.মি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ সে.মি. রাখা হয়। জাত স্বল্প মেয়াদি ও খাটো হলে সারির দূরত্ব কম রাখা যেতে পারে। প্রতিটি স্থানে ২—৩ টি করে বীজ বপন করা হয়। গজানোর পর একটি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকীগুলো তুলে ফেলতে হয়। বীজ বপন ও শোধনের পূর্বে ৪—৫ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে বীজত্বক নরম করে নিলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। বীজ ২—৩ সে.মি. গভীরতায় বপন করতে হয়।

আন্তঃপরিচর্যা :

আগাছা দমন, পাতলাকরণ ও শুন্যস্থানপূরণ : সূর্যমুখী জমিতে বথুয়া, দূর্বা, চাপড়া, থানকুনি ইত্যাদি জন্মে। চারা গজানোর পর ৬০ দিন পর্যন্ত জমিকে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করার সময় প্রতিটি স্থানে বা গোছায় একটি স্বাস্থ্যবান চারা রেখে বাকী চারা তুলে ফেলতে হয়। এছাড়াও কোন স্থানে বা গোছায় চারা না গজালে বা কোন সুস্থ চারা না থাকলে সেই স্থানে তুলে ফেলা চারাগুলোর মধ্য থেকে সুস্থ চারা নিয়ে তা রোপন করে শুন্যস্থান পূরণ করতে হয়। শুন্যস্থান পূরণের কাজটি বিকেল বেলা করা উত্তম। লাগানো চারার গোড়ায় ৩—৪ দিন পানি দিলে চারাটি ভালোভাবে বেড়ে উঠবে।

 

সূর্যমুখী চাষ 1 তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ - ৭.৪ , ইউনিট-৭

 

সেচ ও নিকাশ : খরিফ মৌসুমে সূর্যমুখী ফসলে সাধারণত কোন সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে রবি মৌসুমে ২—৩ বার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। ১ম সেচ চারা গজানোর ৩০ দিন পর, ২য় সেচ ৫০ দিন পর ও ৩য় সেচ ৭০ দিন পর দিতে হয়। কোন কারণে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।

পোকা দমন: সূর্যমুখী ফসলে পোকার আক্রমণ খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। তবে মাঝে মধ্যে বিছাপোকার আক্রমণ দেখা যায়। প্রথম দিকে ডিম থেকে শুককীট বের হওয়ার পর এরা একসঙ্গে পাতার নিচের দিকে দলবদ্ধভাবে থাকে ও পাতা খেয়ে জালের মত ঝাঝড়া করে ফেলে। এতে সালোকসংশ্লেষণে ব্যাঘাত ঘটায় গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হয়। পরবর্তীতে শুককীটগুলো বড় হয়ে সারা জমিতে বিস্তারলাভ করে। এ সময় এদেরকে দমন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য প্রথম দিকেই শুককীটগুলো দমন করতে হয়। একটি বালতিতে কিছু পানি ও কেরোসিন বা ডিজেল মিশিয়ে আক্রান্ত পাতা বেঁাটাসহ ছিড়ে বালতিতে চুবিয়ে নিলে সব শুককীট মারা যাবে। এছাড়াও অনুমোদিত কীটনাশক ে¯প্র করেও এ পোকা দমন করা যায়।

রোগ দমন : এ ফসলে রোগের আক্রমণ কম হয়। তবে অনেক সময় পাতায় দাগ পড়া, গোড়া পচা ও ঢলে পড়া রোগ দেখা যায়। এ রোগগুলো ছত্রাকের আক্রমণে হয়। ছত্রাকের আক্রমণ বেশি হলে পাতায় দাগ পড়া রোগে গাছের পাতা সম্পূর্ণ কালো হয়ে যায় এবং ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। চারা গাছে গোড়া পচা রোগ হয় এবং আক্রান্ত চারা গাছের গোড়ায় তুলার ন্যায় সাদা অঁাশ ও সরিষার মত বাদামি দানা দেখা যায়। বেশি আক্রান্ত হলে গাছ মরে যায়। পূর্ণবয়স্ক সূর্যমুখী গাছ ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত হলে সম্পূর্ণ গাছ মরে যায়। বীজশোধন করে বপন করলে এ সমস্ত রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

এছাড়াও অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ে¯প্র করেও এ সমস্ত রোগ দমন করা সম্ভব।
গোড়ায় মাটি দেয়া: ইউরিয়া সারের শেষ ভাগ প্রয়োগ করার পর দুই সারির মাঝের মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হয়।

এতে গাছের গোড়া মজবুত হয়। ফলে ঝড় বৃষ্টিতে সহজে গাছ হেলে পড়ে না। পাখি তাড়ানো : সূর্যমুখীর বীজ পুষ্ট হওয়া শুরুর সাথে সাথে টিয়া পাখির উপদ্রব শুরু হয়। খুব সকালে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে পাখির আক্রমণ বেশি হয়। বাঁশের চোঙ বা ঘন্টা বাজিয়ে অথবা জমির মাঝখানে কোরোসিনের টিন উঁচু করে বেঁধে দড়ির সাহায্য দূর থেকে টেনে শব্দ করলে পাখি জমিতে বসতে পারে না। ফসল কর্তন, শুকানো ও মাড়াই পরিপক্ক হলে গাছের পাতা হলদে হয়ে আসে এবং পুষ্পস্তবকসহ গাছের মাথা নুয়ে পড়ে। দানাগুলো পুষ্ট, শক্ত ও কালো রং ধারণ করে। কাস্তের সাহায্যে গাছ থেকে পুষ্পস্তবকগুলো কেটে ২/১ দিন রোদে শুকাতে হয়।

এরপর লাঠির সাহায্যে আঘাত করে বীজগুলো আলাদা করা হয়। কুলার সাহায্যে বীজগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর রোদে এমনভাবে শুকাতে হয় যাতে দানাতে ৮—১০% এর বেশি আর্দ্রতা না থাকে। বীজ ছাড়ানোর পর পুষ্পস্তবকের অবশিষ্ট অংশ গো—খাদ্য ও গাছগুলো জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলন ১.৫—১.৮ টন/হেক্টর।

সূর্যমুখী চাষ 3 তেল ফসল : সূর্যমুখী চাষ , পাঠ - ৭.৪ , ইউনিট-৭

অর্থনৈতিক গুরুত্ব :

সূর্যমুখী ফুল ও তেল উৎপাদনকারী ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এর তেল এখনও খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। সূর্যমুখীর তেল সরিষার তেলের চেয়ে অনেক ভালো। কারণ এর তেলে শরীরের জন্য উপকারী লিনোলিক এসিড রয়েছে। এর বীজে ৪৫—৫০% ভোজ্য তেল আছে। খাদ্যমানের দিক থেকে এর তেল বেশ উন্নততর। বিভিন্ন প্রকার রান্নার কাজে এবং ডালডা তৈরিতে সূর্যমুখী তেল ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এর ব্যাপক চাষ না হলেও নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা ও দিনাজপুর জেলায় কিছু চাষ হচ্ছে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আমন ধান কাটার পর সূর্যমুখী চাষ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এর ব্যাপক চাষ হয়, যেমন— ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, আর্জেন্টিনা।

আরও দেখুন :

Leave a Comment