অণুজীব সার

অণুজীব সার – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি ‘প্রযুক্তি বিষয়ের ইউনিট ৫ এর ৫.১ নং পাঠ।

অণুজীব সার

অণুজীব সার , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.১

অণুজীব সার :

যে সকল ক্ষুদ্র জীব খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায় তাদের অণুজীব বলে। অণুজীব বা জীবাণু ব্যবহার করে যে সার প্রস্তুত করা হয় তাকে অণুজীব সার বলে। উদ্ভিদ জগতের অন্তভূর্ক্ত অণুজীবগুলো হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শেওলা ও এক্টিনোমাইসিটিস। প্রাণিজগতের অণুজীব হলো নেমাটোড, রটিফার ও প্রক্টোজোয়া।

তবে অণুজীব সার কেবলমাত্র উদ্ভিদ জাতের অন্তর্গত অণুজীব দিয়ে তৈরী করা হয়। গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে যে, জীবাণু সার ব্যবহারে চীনাবাদাম, মসুর, মুগ, ছোলা, সয়াবীন প্রভৃতি ফসলে নাইট্রোজেন গুটি বা নডিউলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। এতে করে ফসলের ফলনও বেড়ে যায় ২০—৪০%। জীবানু সার অত্যন্ত কম ব্যয় সাপেক্ষ। এর ব্যবহার পদ্ধতি সহজ এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর নয়।

অণুজীব সার , বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি , ইউনিট-৫ , পাঠ-৫.১

 

অণুজীব সারের প্রকারভেদ :

১। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী অণুজীব সার
২। ফসফরাস দ্রবীভূতকারী অণুজীব সার ও ৩। কম্পোস্ট তৈরীকারী অণুজীব সার।

 

১। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী অণুজীব সার :

এরা বায়ুর নাইট্রোজেন আহরণ ও সংবন্ধন করে। অণুজীব প্রধাণত দুই প্রকারে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।

 

(ক) মুক্তজীবী নাইট্রোজেন সংবন্ধন :

এ শ্রেণীর জীবাণুগুলো মাটিতে মুক্তভাবে বসবাস করে বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্রহণ করে দেহের মধ্যে নাইট্রোজেন যৌগে পরিণত করে। এ শ্রেণীর জীবাণুদের মধ্যে রয়েছে এ্যাজোটোব্যাকটর, ক্লসটিডিয়াম, বেইজার—ইনকিয়া প্রভৃতি। জৈব পদার্থ এ সব জীবাণুকে শক্তি যোগায়। এ জীবাণুরা শিকড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না, শিকড়ের উপরে কাজ করে। এসব জীবাণু মারা যাবার পর মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। ঐ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে ফসল উপকৃত হয়।

এ শ্রেণীর প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ১০—২৫ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে সরবরাহ করতে পারে। নাইট্রোজেন যোগ করা ব্যতীত এই জীবাণু জমিতে হরমোন তৈরী করে যা অঙ্কুরোদগমে সহায়তা করে। অশিম্বী জাতীয় ফসল, যেমন—ধান, গম, ভুট্টা, আখ, পাট, তুলা প্রভৃতি ফসলে জীবাণু সারের মাধ্যমে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব। ১০ কেজি বীজে ২০০ গ্রাম করে ব্যবহার করলে অল্প খরচে নাইট্রোজেন সারের অভাব পূরণ হয়।

অণুজীব সার 1 অণুজীব সার

 

(খ) মিথোজীবী নাইট্রোজেন সংবন্ধন :

সাধারণত গুটি উৎপাদনকারী উদ্ভিদ এবং রাইজোবিয়াম নামক জীবানু মিথোজীবী হিসেবে বাস করে। গাছের শিকড়ে যদি ঠিকভাবে গুটি হয় তবে প্রতি হেক্টরে বার্ষিক ১০০—৩০০ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে জমা হতে পারে এবং ফলন বাড়ে ৫০—১০০ ভাগ। প্রতিটি স্বতন্ত্র গুটি জাতীয় ফসলেরর জন্য আলাদা আলাদাভাবে নির্দিষ্ট জীবাণু সার প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

এ জীবাণুরা শিম জাতীয় উদ্ভিদের মূলে গুটি তৈরী করে এবং সেখানে বসবাস করে বাতাস থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে তাকে উদ্ভিদের গ্রহণোপযোগী নাইট্রোজেনে পরিণত করে। শিম জাতীয় উল্লেখযোগ্য ফসল হলো : সয়াবিন, চিনাবাদাম, মুগ, মসুর, ছোলা, বরবটি, মাসকালাই, শনপাট, ধৈঞ্চা প্রভৃতি। রাইজোবিয়াম জীবাণু সার প্রয়োগ করলে ডালজাতীয় ফসলের শিকড়ে “নডিউল” বা গুটির সংখ্যা তাদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। গুটি তিন রংঙের হয়— গোলাপী—লাল, বাদামী এবং সবুজ এর মধ্যে গোলাপী—লাল রঙের গুটিই সবচেয়ে বেশি নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে পারে।

 

২। ফসফরাস ঘটিত অণুজীব সার :

মাটিস্থ ফসফরাসকে দ্রবীভূত করে গছের জন্য সহজলভ্য করে এরূপ অণুজীব সারকে ফসফরাস অণুজীব সার বলে। মৃত্তিকায় ফসফরাস থাকে সাধারণত ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের হাইড্রোক্সাইড, কার্বনেট বা সিলিকেটের সংগে যুক্ত হয়ে অদ্রবণীয় অবস্থায় এবং সহজে দ্রবণীয় ফসফরাস ঘটিত রাসায়নিক সার মৃত্তিকায় প্রয়োগ করায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তা আবারও গাছের অগ্রহণযোগ্য ও অদ্রবণীয় যৌগে পরিণত হয়। ফলে মৃত্তিকায় মোট ফসফরাসের পরিমাণ যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহন করতে পারে না। ফসফরাস ঘটিত অণুজীব সার মৃত্তিকার এই অদ্রবণীয় ফসফেটকে গাছের গ্রহণযোগ্য দ্রবনে রূপান্তরিত করে এ অণুজীবগুলো বেশ কিছু এনজাইম ও জৈব এসিড উৎপন্ন করে যা অদ্রবনীয় ফসফেটকে দ্রবণীয় ফসফেটে রূপান্তরিত করে।

অণুজীব সার 4 অণুজীব সার

৩। কম্পোস্ট তৈরীকারী’ অনুজীব সার :

কম্পোস্ট তৈরী করতে যে অণুজীব সার ব্যবহার করা হয় তাকে কম্পোস্ট তৈরীকারী অণুজীব’ সার বলে। যেমন: বিভিন্ন ছত্রাক (ট্রাইকোডার্মা, মাইকোরাইজা, এসপারজিলাস), ব্যাকটেরিয়া (ক্লসট্রিডিয়াম, ব্যাসিলাস) ও অ্যাক্টিনোমাইসেটিস জৈব পদার্থসমূহকে দ্রুতগতিতে পঁচাতে সাহায্য করে।

 

অণুজীব সারের গুরুত্ব :

১। ফসলের পুষ্টির চাহিদা পূরণে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অণুজীব’ সার গুরুত্বপূর্ণ ।

২। নাইট্রোজেন অণুজীব সার মাটিতে ও ফসলে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।

৩। মাইকোরাইজা অণুজীব সার মূলের পৃষ্ঠ এলাকা বৃদ্ধি করে। ফলে এর সাহায্যে উদ্ভিদ বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।

৪। জীবাণু সার পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না।

৫। এই সারের উৎপাদন খরচ খুব কম এবং মানুষ ও পশুপাখির কোন ক্ষতি করে না।

৬। জীবাণু সার অত্যন্ত কম ব্যয় সাপেক্ষ।

৭। জীবাণু সারের ব্যবহার পদ্ধতি সহজ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।

৮। ধানক্ষেতে এই সার জৈব পদার্থ সংযোগ করে।

৯। জীবাণু সার যেমন এ্যজোলা আগাছা দমন করে।

১০। জীবাণু সার যেমন ট্রাইকোডামার্ মাটির ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে এবং জৈব বালাইনাশক হিসাবে মাটি শোধনের কাজ করে।

১১। ফসলে ২৫—১৫০ ভাগ আমিষ বাড়ায়

১২। পরিমাণে খুব কম লাগে।

 

সারাংশ :

অনুজীব থেকে উৎপন্ন সারসমূহকে অনুজীব সার বলা যায়। মাটিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মাটির পরিবেশ দূষিত হচ্ছে ফলে ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু অনুজীব সার হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিকারক। জীবানু সার শুধুমাত্র উদ্ভিদ জগতে অন্তর্গত অনুজীবগুলোকে নিয়ে তৈরি করা হয়। অনুজীব সার সহজলভ্যতা ও পরিবেশগতভাবে নিরাপদ হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment