কুল চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা। বাংলাদেশে কুল একটি ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফল। স্বাদ ও পুষ্টিমান বিচারে কুল অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের ফল। বিশেষ করে ভিটামিন সি-এর দিক থেকে আমলকী ও পেয়ারার পরই এর স্থান। কুল শুধু ফল হিসেবেই নয়, এ থেকে আচার, চাটনি ইত্যাদি মুখরোচক খাবারও তৈরি হয়।
Table of Contents
কুল চাষ পদ্ধতি
কুলের বংশবিস্তার :
বীজ এবং কলমের মাধ্য , মে কুলের বংশবিস্তার করা যায়। কলমের চারার বংশগত গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। বীজ থেকে চারা পেতে বীজকে ভেজা গরম বালির ভেতর দেড়-দুই মাস রেখে দিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়। না হলে ৬-৮ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। কলমের চারা পেতে নির্বাচিত স্থানে বীজ বপণ ও চারা তৈরি করে তার ওপর বাডিংয়ের মাধ্যমে কলম করে নেওয়া ভালো।
কুলের জাত পরিচিতি :
বারি কুল-১ :
এটি নারিকেলী জাত নামে পরিচিত। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় চাষাবাদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত জাত। ফল আকারে বড়, ওজন গড়ে ২৩ গ্রাম ও লম্বা।
বারি কুল-২ :
জাতটি উত্তারাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য ভাল হলেও দেশের অন্যত্রও চাষ করা যায়। ফল আকারে বড় ও ডিম্বাকৃতি।
বারি কুল-৩ :
জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। ফল বড়, প্রায় গোল আকারের ও হলুদাভ সবুজ রঙের। ফলন প্রতি হেক্টরে ২২-২৫ টন।
আপেল কুল :
আপেল কুল বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মোফাজ্জল হোসেন কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে অনুমোদিত। আপেল এর মতো রঙ হওয়ার জন্যে কুলটির নাম দেওয়া হয়েছে আপেল কুল। মিষ্টি স্বাদের জন্য অন্য কুলের চেয়ে এটি অনেক ভালো।
বাউকুল-১ :
ফল আকারে অনেক বড় হয় (গড়ে ৯০ গ্রাম)। মিষ্টতার পরিমানও অনেক বেশি। আগাম পরিপক্ক হয়। সারা দেশেই চাষ করা যায়।
কাশ্মীরি আপেল কুল :
কাশ্মীরি আপেল কুল দেখতে অনেকটা মাঝারি সাইজের আপেলের মতো। রং আপেলের মতো সবুজ ও হালকা হলুদের ওপর লাল। স্বাদ হালকা মিষ্টি অনেকটা বাউকুলের মতো। প্রচলিত আপেল কুল ও বাউকুলের থেকে আকারে বেশ বড় এই কাশ্মীরি আপেল কুল।
বল সুন্দরী কুল :
বল সুন্দরী দেখতে ঠিক আপেলের মতো। উপরের অংশে হালকা সিঁদুর রং। খেতে সুস্বাদু। ফলটি রসালো ও মিষ্টি।
কুল চাষের জন্য মাটি :
যেকোনো ধরনের মাটিতেই কুলের সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। কুলগাছ লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। তবে ভারি ও সামান্য ক্ষারযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিতে কুলের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
জমি তৈরি : বাগান আকারে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ভালো। তাছাড়া বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুর পাড়ে বা আঙিনায় পড়ে থাকা অনুর্বর মাটিতেও গর্ত করে চাষ করা যায়।
রোপণ : বাগান আকারে চাষের জন্য বর্গাকার রোপণ প্রণালি অনুসরণীয়। রোপণ দূরত্ব ৬-৭ মিটার। জাত ও স্থানভেদে দূরত্ব কম-বেশি হবে। চারা রোপণের মাসখানেক আগে ১ মি. x১ মি. x১ মি. আকারের গর্ত করতে হবে।
কুল চাষের সময় :
মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-চৈত্র এবং মধ্য-শ্রাবণ থেকে মধ্য-ভাদ্র রোপণ করা যায়।
কুল চাষের সার ব্যবস্থাপনা :
চারা গাছ লাগানোর ১ মাস পর চারা গাছের চারদিকে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার হিসেবে পচা গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্টা পচানো কম্পোস্ট সার, খৈল ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাসায়নিক সার ভিন্ন বয়সের গাছে ভিন্ন অনুপাতে দেওয়া হয়। কুলের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত ও পরিমাণমতো সার দিতে হবে। সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স, আকার ও মাটির উর্বরতার ওপর। নিম্নে বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা দেওয়া হলো-
গাছের বয়স (বছর) | পচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) |
১-২ | ১০ | ২৫০-৩০০ | ২০০-২৫০ | ২০০-২৫০ |
৩-৪ | ২০ | ৩৫০-৫০০ | ৩০০-৪৫০ | ৩০০-৪৫০ |
৫-৬ | ২৫ | ৫৫০-৭৫০ | ৫০০-৭০০ | ৫০০-৭০০ |
৭-৮ | ৩৫ | ৮০০-১০০০ | ৭৫০-৮৫০ | ৭৫০-৮৫০ |
৯ বা তদূর্ধ্ব | ৪০ | ১১৫০-১২৫০ | ৯০০-১০০০ | ৯০০-১০০০ |
সার বছরে ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ফল ধরা, ফল সংগ্রহ ও বর্ষার পর সার প্রয়োগ করা ভালো। সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দেওয়া উচিত।
কুল গাছের পরিচর্যা :
শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত ফুল ও ফল ধরার সময়ে মাসে একবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। চারাগাছ (বীজের বা কলমে) হলে প্রথম বছর গাছটির কাঠামো মজবুত করার জন্য গাছের গোড়া থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার উঁচু পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। এর উপরে শক্ত-সামর্থ কিছু শাখা-প্রশাখা গাছের অবস্থা অনুযায়ী রাখতে হবে। যেন ডালপালা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
কুল গাছের ছাঁটাই :
ছাঁটাইয়ের সময় শক্ত-সামর্থ শাখাগুলোর গোড়া থেকে না কেটে কিছু অংশ রেখে অগ্রভাগ কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া দুর্বল, রোগ ও কীট দৃষ্ট ও ঘনভাবে বিন্যস্ত ডালগুলো গোড়া থেকে কেটে পাতলা করে দিতে হবে। নতুন যে ডালপালা গজাবে সেগুলোও বাছাই করে ভালো ডালগুলো রেখে দুর্বল ডাল কেটে ফেলে দিতে হবে।
কুলের রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ :
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা :
ফল ছিদ্রকারী উইভিল কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুলের উন্নত জাতে এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পোকার সদ্যজাত লার্ভা হালকা হলুদ বর্ণের হয়। এদের পা থাকে না। পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণের হয়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা থেকে পূর্ণ রূপ ধারণ করে।
সদ্য জাত লার্ভা কচি ফলের বীজে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ বীজ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফলের নিচে কাল দাগ পড়ে এবং বীজের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ফল ছোট গোলাকার হয় এবং ফ্যাকাশে ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে বা গাছ শুকিয়ে যায়।
পোকা দমনে করণীয় :
কুল বাগানের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। কুল গাছে অসময়ে আসা ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলতে হবে। গাছ ও মাটিতে পড়ে যাওয়া আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ করে লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে। বেশি আক্রান্ত এলাকায় ফুল ধরার আগেই সব বাগান ও এলাকা অনুমোদিত কার্বারাইল জাতীয় কীটনাশক বা ডাইমেথোয়েট জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু পোকাটি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ফলের ভেতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেজন্য আক্রমণের আগেই পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য পরাগায়নের পর ফল ধরা শুরু হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
জমি সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যেন ডালপালায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় কুল চাষ না করাই উত্তম।
হাত বা শক্ত লাঠি দিয়ে টিউবগুলো নিম্ফসহ ধ্বংস করতে হবে। যেহেতু ফুল ধরার সময় এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় সেজন্য গাছে ফুল আসার সময়ে কা- বা শাখায় টিউব দেখামাত্র সাইপারমেথ্রিন বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
টিউব স্পিটল বাগ :
এ পোকার নিম্ফগুলো সরু, লম্বা চুন যুক্ত টিউবের মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। নিম্ফগুলো টিউবের মধ্যে তাদের তৈরি ফ্লুয়িডে (fluid) নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং টিউবে এদের মাথা নিচে এবং পেট ওপরে রাখে। নিম্ফগুলোর পেটে একটি বর্ধিত প্লেট থাকে যা টিউবের খোলা প্রান্তে দরজা হিসাবে কাজ করে এবং টিউবকে বন্ধ করে দেয়।
পূর্ণ বয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ ফুল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত ফুল সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারণের অনুপযোগী হয়। অধিক আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ রূপে ফল ধারণে ব্যর্থ হয়।
পাউডারি মিলডিউ :
এটি ছত্রাকজনিত একটি রোগ। এর আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়। আক্রান্ত ফুল ও ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে। গাছের পরিত্যক্ত অংশে এবং অন্যান্য উদ্ভিদে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। এটি বাতাসের মাধ্যমে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। উষ্ণ ও ভেজা আবহাওয়ায় বিশেষ করে মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। গাছে ফুল দেখা দেযার পর থিওভিট ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম বা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। পরবর্তী ১৫ দিন পর পর দুইবার স্প্রে করতে হবে।
কুল ফল সংগ্রহ :
জাত অনুসারে মধ্য-পৌষ থেকে মধ্য-চৈত্র মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। ফলের রং হালকা সবুজ বা হলদে হলে সংগ্রহ করতে হয়। গাছপ্রতি ৫০-২০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।