কৃষি জলবায়ু উপযোগী উদ্যান মাঠফসল ও গবাদি পশুপাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ৬ নং ইউনিটের ৬.৩ নং পাঠ।
Table of Contents
কৃষি জলবায়ু উপযোগী উদ্যান মাঠফসল ও গবাদি পশুপাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব
ভূমিকা:
বাংলাদেশের জলবায়ু অনেকটা সমভাবাপন্ন এখানে সারা বৎসরই প্রায় সমপরিমাণ উত্তাপ বিদ্যমান। জমি চাষথেকে শুরু করে শস্যবীজ গুদামজাতকরণ পর্যন্ত প্রায় সব কাজই জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল।
নিচে উদ্যান, মাঠ ফসল, গবাদি পশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করা হলো—
উদ্যান ও মাঠ ফসলের উপর জলবায়ুর প্রভাব:
তাপমাত্রার প্রভাব : তাপমাত্রা শস্যের সার্বিক বৃদ্ধি সাধনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে। এই তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শস্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন বা খরিফ শস্য এবং শীতকালীন বা রবি শস্য। শীতকালীন উদ্যান ফসলের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০ — ৩০ সেলসিয়াস। গ্রীষ্ম ও বষার্কালীন উদ্যান ফসলের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ৩০—৩৫ সেলসিয়াস, পাতা জাতীয় শাক সবজির দৈহিক বৃদ্ধি কম দিবসে ১২—১৭ সেলসিয়াস পছন্দ করে। অধিক তাপে এদের পাতায় সঞ্চিত শর্করার পরিমান কম হয়।
অতিরিক্ত তাপে লেটুস ও পালংশাক দ্রুত ফুল উৎপন্ন করে। গোল আলু, মিষ্টি আলু, গাজর, মূলা, শাল গম ইত্যাদিতে অতিরিক্ত তাপে শর্করার সঞ্চয়ের পরিমান কম হয় বলে ফলন কম হয়।
তাপমাত্রা কম বা বেশী হলে ক্যারোটিন কমে গাজরের রং হালকা হয়। বেশী তাপমাত্রায় ফুলকপি, বাধাকপি, মুলার স্বাদ কম হয়। আউশ ধান, পাট, সয়াবিন, জোয়ার ইত্যাদি গ্রীষ্মকালীন ফসল শস্যের জন্য অধিক তাপমাত্রার প্রয়োজন। গ্রীষ্মকালীন ফসল ২৩.৮৯—২৯.৪৬ সেলসিয়াস মাসিক গড় তাপমাত্রার সর্বাধিক ফলন দেয়। আমন ধান, বোরো ধান, গম, যব, সরিষা, ছোলা, মটর, মসুর, তামাক ইত্যাদি শীতকালীন ফসল। এসব ফসল মাসিক গড় তাপমাত্রা ১৬.৬৭—১৮.৩৩ সেলসিয়াস এ অধিক ফলন দেয়।
কিছু সংখ্যক ফসল যেমন তিল, চীনাবাদাম, তুলা, ভুট্টা প্রভৃতি উভয় মৌসুমেই চাষ করা যায়। আখ, রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমের অন্তর্গত। ফলের উৎপাদন তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। ফুল ও ফল ধারণের সময় উপযোগী তাপমাত্রা না হলে ফুল ও ফল কম ধরে। বেশী তাপমাত্রায় অনেক ফল গাছের ফল ধারণ ব্যাহত হয়। আম, লিচু প্রভৃতি ফল গাছের ফুল বিকাশের জন্য কম তাপামাত্রার প্রয়োজন।
তাপমাত্রা অনেক ফল গাছের ফুল উৎপাদনের সময়কে প্রভাবিত করে। আমের পুষপমঞ্জুরী গঠনের সময় তাপমাত্রা কম থাকলে পুরুষ ফুল বেশি হয়। দেশের একস্থান হতে অন্য স্থানের উষ্ণতার তেমন কোন তারতম্য না থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালীন উষ্ণতার মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। এজন্য প্রায় সব রকম শস্য কম বেশী দেশের সব জায়গায় জন্মানো সম্ভব হলেও শীতকালীন শস্য গ্রীষ্মকালে অথবা গ্রীষ্মকালীন শস্য শীতকালে কতগুলো (উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যতীত) সাফল্যজনক ভাবে জন্মানো যায়না। বৃষ্টিপাত : গাছের সাবলীল বৃদ্ধি এবং অধিক ফলন পরিমিত পানি সরবরাহের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। এই পরিমিত পানির প্রাপ্যতা বিভিন্ন এলাকার এবং বিভিন্ন ঋতুতে শস্য বন্টনে তাপমাত্রার মতই অধিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
শাক সবজি ও ফলের মধ্যে ৬০—৭০ ভাগই পানি। এ পানি গাছ বৃষ্টিপাত ও মাটির নীচ হতে গ্রহন করে। বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের বীজ বৃষ্টিপাত ছাড়া গজায়না। মাঠ ফসলে বীজ গজানো থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত প্রভাব বিস্তার করে। জমি ভালভাবে চাষের জন্য মাটির জো থাকা প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত মাটিকে সে অবস্থায় এনে দেয়। ফসল পাকার পর বৃষ্টিপাত হলে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পুষ্পায়ণের সময় বৃষ্টিপাত হলে পরাগায়ণ ব্যাহত হয়। বৃষ্টিপাত কম বেশি হলে শাকসবজি ও ফলের ফলন ও কম বেশি হয়।
সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড় গুলিতে ও পার্শ্ববতীর্ এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে চা এর উৎপাদন ভাল। আবার তুলা চাষের জন্য মধ্যম বৃষ্টিপাত ও অধিক তাপমাত্রার প্রয়োজন। গ্রীষ্মকালে বোনা আউশ ও পাটের বীজ গজানোর জন্য বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। শীতকালে উত্তর পূর্ব মৌসুমী বায়ু প্রবাহের ফলে বষ্টিপাত হয়না বললেই চলে। এসময় শীতকালীন সবজি লালশাক, পালংশাক, মূলা, শাল গম, ডাল জাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল, ফুলকপি—বাধাকপি জন্মে। কাল বৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে যে বৃষ্টিপাত হয় তা আমাদের কৃষির জন্য অপরিহার্য।
কারণ, এ সময় জমি চাষ ও খরিফ শস্য বোনার সময় শুরু হয়। শিশির মাটিতে কিছুটা পানি যোগ করে যা ফসলের জন্য ভাল। কুয়াশা ও তুষার পাতে ফসল ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কুয়াশা ও তুষারপাত ফসলের জন্য ক্ষতিকর। বেশি কুয়াশার কারণে ডাল জাতীয় ফসল জাবপোকা ও বিভন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
ফসলের উপর আলোর প্রভাব : সূর্যের আলো আবহাওয়া ও জলবায়ুর অন্যতম প্রধান উপাদান। শস্যের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য আলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো উদ্ভিদের সালোক—সংশ্লেষনের জন্য অপরিহার্য। অধিকাংশ ঘাস জতীয় শস্যের বীজের অংকুরোদগমের জন্য আলোর বিশেষ প্রয়োজন। আলো অনেক উদ্ভিদের ফুল ও বীজ উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। উদ্ভিদ জীবনের বিশেষ প্রক্রিয়া, যৌন—বংশ বৃদ্ধির উপর আলোর এরূপ প্রভাব বিস্তারকে ফটো পিরিয়ডিজম বলে।
কিছু উদ্ভিদের শীষ, ফুল ও বীজ উৎপাদনের জন্য ১২ ঘন্টার বেশী আলোর প্রয়োজন। আবার কিছু উদ্ভিদের ফুল, ফল ও বীজ উৎপাদনের জন্য ১২ ঘন্টার কম আলো প্রয়োজন যেমন: পাট। কিছু উদ্ভিদের পুষ্পায়ণে আলোর প্রভাব পড়ে না যেমন: তুলা, ভূট্টা, তিল, চিনাবাদাম ইত্যাদি।
গবাদিপশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব :
গবাদিপশু ও পাখি পালনে মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব লক্ষণীয়। প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট পরিমান তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত প্রয়োজন রয়েছে। গবাদিপশু ও পাখির ক্ষেত্রেও জলবায়ুর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণ। গবাদিপশুর দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা অত্যাধিক কম বা বেশি হলে পশুর দৈহিক বৃদ্ধি খাদ্য গ্রহণ, প্রজনন, দুধ উৎপাদন ব্যাহত হয়। অতি বৃষ্টির কারণে দেশে বন্যার সৃষ্টি হলে গবাদিপশু পালনে যথেষ্ট বাঁধার সৃষ্টি হয়। বন্যার ফলে আবাসস্থল সহ খাদ্য সংকটও দেখা দেয়।
এ সময় গবাদি পশুর নানা ধরনের রোগ বালাই দেখা দেয়। আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়। গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পশু পাখির দেহে পানি শূন্যতা দেখা যায় এবং পশু ভারবাহী কাজ করতে পারে না। শীতকালে তাপমাত্রা অত্যাধিক কমে গেলে গরুর ক্ষুধামন্দাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। যেমন— নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, তড়কা, গলাফুলা ইত্যাদি। আবার বষার্ মৌসুমে পশুর ক্ষুরারোগসহ নানা ধরনের রোগ হয়। গবাদিপশু কৃমি ও বহি: পরজীবীরা আক্রান্ত হতে পারে। তাপমাত্রা গৃহপালিত পাখির উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে।
তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ডিম উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায় এবং ডিম ছোট হয়। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা অত্যাধিক হলে মুরগি হিটস্ট্রোক করে মারা যায়। শীতের সময় বার্ডফু¬, রানীক্ষেত, বসন্ত ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। তাপমাত্রা কমলে বা জলবায়ু পরিবর্তন হলে ডিম উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পায়। আলো ডিম উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।