বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশের উপাদান” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.১ নং পাঠ।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি উন্নয়নে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অবদান অনস্বীকার্য। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সেসব দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুধু শ্রম শক্তির লাঘবই করেনি বরং ফসলের উৎপাদন খরচ কমিয়ে তার ফলন ও গুনাগুণ বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে তুলনায় বাংলাদেশ এখনও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রয়ে গেছে।

অল্প শ্রম, অল্প সময়, অল্প ব্যয় ও অধিক দক্ষতার সাথে খামারে কাজ করতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জনসংখ্যার ক্রম বৃদ্ধির ফলে ফসলের জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। এই ক্রমবর্ধমান বাড়তি মুখের খাবার যোগান দিতে সীমিত জমিতে প্রচলিত শস্য চাষ রীতি পরিবর্তন করে উৎপাদন বর্ধক শস্য চাষ রীতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণসহ উন্নত চাষাবাদ প্রণালী অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

১৯২৮ সন হতে এ উপমহাদেশে আংশিক খামার যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ১৯২৮ সনের “রাজকীয় কৃষি কমিশন”, ১৯৪৫ সনের “দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধানী কমিশন”, ১৯৫১ সনের “পাকিস্তান কৃষি অনুসন্ধানী কমিটি”, ১৯৬০ সনের “খাদ্য ও কৃষি কমিশন” এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা উত্তরকালে “খামার যান্ত্রিকীকরণ কমিটি” দেশে ভূমি কর্ষণ, সেচ ও শস্য সংরক্ষণ এ তিন বিষয়ে বিশেষভাবে যান্ত্রিকীকরণের সুপারিশ করে।

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কী?

কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্র শক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। কৃষিক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজে যন্ত্রশক্তির ব্যবহারকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। এক্ষেত্রে যন্ত্রশক্তি বলতে মেশিন এবং ইঞ্জিন উভয়কে বোঝায়। যান্ত্রিকীকরণ দু’ধরনের হতে পারে পর্ণ এবং আংশিক। কৃষি ক্ষেত্রে সমুদয় কার্যাদি যখন যূ ন্ত্রশক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় তখন তাকে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ বলা হয়। পক্ষান্তরে ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষ কতকগুলো কাজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করলে তাকে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বলে। বাংলাদেশের আবহাওয়া, কৃষকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় বর্তমানে এখানে আংশিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , ইউনিট ৩ , পাঠ-৩.১

 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। সুবিধা, অসুবিধা এবং আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে দেশে কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

 

বীজ উৎপাদন খামারের জন্য

বীজ কৃষির অন্যতম প্রধান উপকরণ। উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় বিবিধ কারণে বীজের মান কমে যেতে পারে। এসব কাজ সাফল্যজনকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামারে অনায়াসে করা যেতে পারে।

 

কৃষি গবেষণাগারের জন্য

বিভিন্ন কৃষি গবেষণাগার এবং কৃষি শিক্ষার বিদ্যাপিঠে অবশ্যই বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ ও ব্যবহার থাকতে হবে। কৃষি উন্নয়নে চাই উপযুক্ত প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের এবং কৃষি শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করে তুলতে গবেষণাগার ও বিদ্যাপিঠে কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

 

কৃষক পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি :

কৃষক পর্যায়ে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার সম্ভব:

 

ক. জমি চাষ

বাংলাদেশে বছরে তিনবার জমি চাষের ব্যস্ত সময় লক্ষ্য করা যায় ।

* মার্চের প্রথম সপ্তাহ হতে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ।

* জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ হতে আগষ্টের তৃতীয় সপ্তাহ।

* নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ হতে মধ্য জানুয়ারী পর্যন্ত ।

দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং বছরের ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। দেশে বর্তমানে চাষের বলদের অভাব শতকরা ৪০ ভাগ এবং উপরোক্ত ব্যস্ত সময়ে এ অভাব দাঁড়ায় ৭০ ভাগে। গরুর ভাল জাত, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, চারণভূমির অভাব এবং বিভিন্ন সময়ের বন্যায় গবাদি পশুর মৃত্যুর ফলে কৃষিক্ষেত্রে পশুশক্তির অভাব বেড়েই চলছে। তাছাড়া যে সকল কৃষকের চাষের বলদ আছে তারা দু’ফসলের মধ্যবর্তী এত কম সময়ে তড়িঘড়ি করে সঠিকভাবে জমি চাষ করতে পারেনা। ফলে ফসলের ফলনও ভাল হয়না। এসব কারণে দেশে পাওয়ার টিলারের চাহিদা বেড়েই চলছে।

পাওয়ার টিলার ব্যবহারের ফলে ব্যস্ত সময়ে জমি চাষ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা বরং অল্প সময়ে কৃষক বেশি গভীরতায় জমি চাষ করে বেশি ফলন পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বীজ বর্ধন খামার ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটে এবং কিছু সংখ্যক ধনী কৃষক তাদের খামারে বিভিন্নঅশ্বশক্তির ট্রাক্টর প্লাউ ব্যবহার করছে এবং দিন দিন এদের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

 

খ. বীজ বপন

বীজ বপন করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট হতে বীজ বপন যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে যা গবেষণাগারে, বীজ বর্ধন খামারে এবং কৃষকের মাঠে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কৃষকেরা এখন বীজ বপন যন্ত্র সরবরাহের জন্য আবেদন জানাচ্ছে।

 

গ.আগাছা দমন

আগাছা দমনের বিভিন্ন নিড়ানী যন্ত্র যেমন জাপানী ধান নিড়ানীযন্ত্র কৃষকেরা এখন নিজেদের ফসলী জমিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। হ্যাম্পর‌্যাক, গার্ডেন র‌্যাক ইত্যাদিও আজকাল আগাছা দমনের জন্য কিচেন গার্ডেনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

ঘ. সেচ প্রয়োগ

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। ফসলের পানির চাহিদা মেটাতে দেশীয় সেচ পদ্ধতি অতিরিক্ত ফসল ফলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তাই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করেছে বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে খাল, বিল, নদী এবং ভূ—গর্ভ হতে পানি তুলে ফসলের জমিতে দেয়া হচ্ছে এবং সেচের আওতায় দিন দিন ফসলী জমির পরিমাণ বাড়ছে।

বিভিন্ন সেচ যন্ত্রপাতি যা এদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো হলো নলকূপ, ট্রেডেল পাম্প, পাওয়ার পাম্প, অগভীর নলকূপ এবং গভীর নলকূপ, ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর বা অগভীর নলকূপ তাদের নির্ধারিত সেচের আওতাভূক্ত জমিতে সেচ দিতে পারছেনা।

এ ক্ষেত্রে পাওয়ার পাম্প দক্ষতার সাথে নদী বা বিল হতে জমিতে সেচ দিতে পারে। সেচের আওতায় জমির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকেরা বেশি পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করছে। ফলে রবি মৌসুমে অন্যান্য ফসল বিশেষ করে ডাল ও মশলা জাতীয় ফসলের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে যদিও ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে কিন্তু অন্য ফসলের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে যার ফলে এসব ফসল বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা মিটাতে হচ্ছে ।

দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হলে বেশি পরিমাণে জমি সেচের আওতায় আনতে হবে। আর তাই সেচ যন্ত্রপাতির চাহিদা এদেশে বাড়তেই থাকবে। ফসল উৎপাদনে সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। অতএব কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এ উপকরণটি বিশেষ করে ফসল উৎপাদনে সেচ যন্ত্রপাতির গুরূত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , ইউনিট ৩ , পাঠ-৩.১

ঙ. ফসল সংরক্ষণ

আগাছা, রোগ ও পোকা—মাকড়ের আক্রমণ হতে জমির ফসল রক্ষার জন্য হস্ত চালিত ও শক্তিচালিত বিভিন্ন স্প্রেয়ার ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে এদের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এসব যন্ত্রপাতি আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। উঁচু গাছে ঔষধ দেবার জন্য উচ্চ চাপের স্প্রেয়ার তৈরি করা হয়েছে যা দেশের উত্তরাঞ্চলের আম বাগানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগ বিস্তীর্ণ এলাকায় কীটনাশক বা আপদনাশক প্রয়োগের জন্য ছোট ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করে থাকে।

 

চ. মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণ

আউশ ও বোরো ধান কাটার পর বৃষ্টি হলে অনেক সময় মাড়াই কাজের বিঘ্ন ঘটে। পদচালিত মাড়াই যন্ত্র (চধফফষব ঃযৎবংযবৎ) এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ মাড়াই যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। যেখানে আগে গরু দিয়ে মাড়াই কাজ করা হতো, গরু কমে যাওয়ায় এসব কাজ এখন পদচালিত মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়। শুধু তাই নয়, গম মাড়াই যন্ত্রের উদ্ভাবনের চেষ্টাও দেশে চল্ছে। ধান, সরিষা ও মশলা যেগুলো ঢেঁকি কিংবা ঘানির সাহায্যে ভাঙ্গানো হতো এখন এসব কাজ মেশিনের সাহায্যে করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখন এসব মিল চালু হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব।

বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , ইউনিট ৩ , পাঠ-৩.১
কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বড় সুবিধা এই যে অল্প সময়ে, কম শ্রমিক দিয়ে, দক্ষতার সাথে, কম খরচে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সম্ভাব্য বেকারত্ব। দেশের অর্ধেকেরও বেশি শ্রমিক কৃষি শিল্পে নিয়োজিত। দেশে কৃষি ক্ষেত্রে পূর্ণ যান্ত্রিকীকরণ হলে অধিকাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলদেশে আংশিক যান্ত্রিকীকরণই শ্রেয়। দেশের পরিবেশের কথা বিবেচনা করে দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি কৃষি ক্ষেত্রে বেশি লাগসই হবে বলে বিবেচিত। তাই কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

শুধু তাই নয় এসব যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ যেন সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই দেশে খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানা করতে হবে নতুবা যেসব কৃষি যš পাতি বিদেশ হতে আমদানি করা হয় তাদের খুচরা যন্ত্রাংশও যেন কৃষক সব সময় হাতের কাছে পায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment