গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো আজ। গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের ১১ নং ইউনিটের, ১১.৩ নম্বর পাঠ। গবাদি প্রাণির মধ্যে গরু প্রধান। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ২—৪ টি গরুপালন করতে দেখা যায়। এমনকি আজকাল শহর ও শহরতলিতেও গরু পালনের গুরুত্ব বেড়েছে।

Table of Contents
গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের গরু পাওয়া যায়। গরুর জাতকে ২টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যথা — ক) উৎপত্তির ভিত্তিতে ও খ) উৎপাদন বা ব্যবহারের ভিত্তিতে।
উৎপত্তির ভিত্তিতে গরুর জাতভেদ:
- দেশি জাতের গরু
- বিদেশি উন্নত জাতের গরু
- উন্নত সংকর জাতের গরু
দেশি জাতের গরু:
কখন, কীভাবে এদেশে গরুর গৃহপালিতকরণ (domestication) হয়েছিল তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় নি। তবে, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকেই সম্ভবত গরুর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে যে গরু পালিত হয়ে আসছে এরা জেবু অর্থাৎ বস ইন্ডিকাস ( Bos indicus) প্রজাতিভুক্ত।
এদেশের আবহাওয়ার সাথে ভালোভাবে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকা এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বস ইন্ডিকাসের অনেকগুলো জাত ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তেমন কোনো গরুর জাত ছিল না। যা ছিল তার সবই দেশী গরু।
১৯৩৭ সালের দিকে ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো বর্তমান বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে বস ইন্ডিকাস প্রজাতির বিশুদ্ধ গরুর জাত, যেমন- হারিয়ানা, সিন্ধি, শাহিওয়াল আনেন (আলী, ১৯৮৫)। বস টরাস ( Bos taurus) প্রজাতির উন্নত জাতের গরু, যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি প্রভৃতি আনা হয় ১৯৭৪ সালে (আলী, ১৯৮৫)।
নিয়মিত কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব জাতের ষাঁড়ের বীজ দেশী গাভীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয় যা এখনও চলছে। এই সংকর জাতের গরুগুলো বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। এর উদ্দেশ্য উৎপাদন বাড়ানো। বর্তমানে বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস ছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ঘন জঙ্গলে মিথুন বা গয়াল অর্থাৎ বস ফ্রন্টালিস ( Bos frontalis) প্রজাতির গরু দেখা যায়। বস ফ্রন্টালিস একটি বন্য প্রজাতির গরু। এদের বংশধরদের এখনও পোষ মানানোর চেষ্টা চলছে।
বাাংলাদেশে আদিকাল থেকে যে জাতের গরু পালন করা হচ্ছে সেগুলোকে দেশি জাতের গরু বলা হয়া। দেশি জাতের গরু মূলত পরিশ্রমী জাত। এ জাতের বলদ কৃষিকাজ ও ভার বহনের কাজে বেশ উপযোগী। তবে চট্টগ্রাম, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর এবং ঢাকার কিছু এলাকায় বেশকিছু দেশি জাতের গরু আছে যেগুলো আকারে কিছুটা বড় হয় এবং এগুলো থেকে বেশি পরিমাণে দুধ পাওয়া যায়। দেশি জাতের গরুর মধ্যে পাবনাইয়া, লাল চাঁটগাঁ, ফরিদপুর দেশি ছোট গরু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের গরুর শ্রেণিবিন্যাস
উৎস অনুসারে বাংলাদেশের গরুকে নিম্নলিখিত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) স্থানীয় – দেশী টাইপ এবং লাল চাঁটগেয়ে।
খ) বিদেশী – হারিয়ানা, শাহিওয়াল, সিদ্ধি, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ও জার্সি।
গ) সংকর – দেশী গাভী X বা টরাস প্রজাতির গরু এবং
দেশী গাভী X মিথুন বা গয়াল
দেশী গরুর প্রথম বাচ্চা প্রসবের গড় বয়সকাল ৪৫ মাস। বর্তমানে মাত্র ২% গাভী কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা গেছে। প্রতিটি গাভী গড়ে ১৩ কেজি দুধ দেয় এবং গড়পড়তা দোহনকাল (lactation period) সময় ৭-৮ মাস (বিবিএস, ১৯৯৪)।
দেশি জাতের বৈশিষ্ট্য:
১. আকারে ছোট, পরিশ্রমী, কুঁজ উচু।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর ওজন গড়ে ২৫০ কেজি।
৩. মাংস বেশ সুস্বাদু।
৪. গাভী হতে দৈনিক ১—৩ লিটার দুধ পাওয়া যায়।
৫. গাভীর গড়পড়তা দোহনকাল ৭—৮ মাস।
নিচে কয়েকটি দেশি জাতের গরুর বিবরণ দেওয়া হল।
লাল চট্টগ্রাম গরু:
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম লাল চাটগেয়ে গরুর আবাসভূমি। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্রই এদের পাওয়া যায়। এদের উৎপত্তি, উৎপাদন এবং দৈহিক বৈশিষ্ট্য প্রায় দেশী গরুর মতো, তবে আকারে বড়। এদের গায়ের রঙ, শিং ও ক্ষুর লাল বলে এরা লাল চাটগেয়ে (Red Chittagong) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের গরুর মধ্যে এরা ভালো জাতের।
এরা আকারে মাঝারি, গায়ের রঙ হালকা লাল, শিং পাতলা এবং ভেতরের দিকে আংশিক বাঁকানো। গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন। মুখমণ্ডল, থুতনি ও পেটের নিম্নাংশ আপেক্ষাকৃত হালকা রঙের। গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ২৫০-৩০০ ও ৩৫০-৪০০ কেজি। দৈনিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২-৫ লিটার। ওলানগ্রন্থি বেশ সুঠাম, তবে বাট আকারে ছোট। বাণিজ্যিক খামারের জন্য এ জাতের গরু মোটেও সুবিধাজনক নয়। তবে, পারিবারিক খামারে পালনের জন্য মোটামুটি ভালো।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রঙ লাল, মুখ খাটো ও চওড়া।
২. গরু দেখতে ছোটখাটো, পেছনের দিক বেশ ভারি।
৩. চামড়া পাতলা, শিং ছোট ও চ্যাপ্টা।
৪. ওলানের শিরা বেশ স্পষ্ট এবং ওলান বেশ বড়।
৫. গাভী দৈনিক ২—৩ লিটার দুধ দেয়।
৬. পূর্ণবয়স্ক ষাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি ও ২৫০—৩০০ কেজি।
৭. লেজ যথেষ্ট লম্বা এবং শেষ প্রান্তের চুলের গুচ্ছ লাল বর্ণের।
৮. গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন।
৯. মাথা ছোট ও পোল উন্নত।
১০. দুধে চর্বির পরিমাণ ৪—৫%।
দেশি ছোট গরু:
এই ধরনের গরু বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায়। এরা আকারে ছোট, গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ হতে পারে। গাভী ও ষাঁড়ের গড় দৈহিক ওজন যথাক্রমে ১৫০-২০০ ও ২২৫-২৫০ কেজি। এদের মাথা ছোট এবং অনেকটা বর্গাকৃতির।
কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা। শিং চোথা এবং সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো। কান ও চুট ছোট এবং উন্নত। গলকম্বল মাঝারি গড়নের। ষাঁড়ের প্রজননতন্ত্রের আবৃত চামড়া বা থলে আকারে ছোট। দেশী গরু খুবই কষ্টসহিষ্ণু এবং এরা প্রধানত শক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। একেকটি গাভী গড়ে ০.৬ লিটার দুধ দেয়। এদেরকে দ্বৈত ব্যবহারোপযোগী পশু বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
১. এরা আকারে ছোট এবং শান্ত প্রকৃতির।
২. গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙ— এর মিশ্রণ হতে পারে।
৩. মাথা ছোট এবং অনেকটা বগার্কৃতির।
৪. কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা।
৫. শিং চোখা ও সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো।
৬. গাভী দৈনিক ০.৫—১ লিটার দুধ দেয়।
৭. দুধে চর্বির পরিমাণ কম।
মাঝারি আকারের দেশী গরু
মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনার শাহজাদপুরে বেশ কিছু উন্নত ধরনের গরু দেখা যায় যাদের উৎপাদন মোটামুটি ভালো। মাঝারি আকারের এ গরুগুলো অন্যান্য অঞ্চলের গরুর চেয়ে বড়। এ অঞ্চলগুলোতে এদেরকে দুধ উৎপাদনের গরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে, এরা কোনো জাত নয়। মূলত এরা দুধ উৎপাদন ও ভারবাহী পশু হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। বৃটিশ আমলে শাহিওয়াল, সিন্ধি ও হারিয়ানা জাতের কিছু ষাঁড় এসব অঞ্চলে আনার ফলেই এ অঞ্চলের গরুর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এ অঞ্চলগুলোতে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায় বলে এদের উৎপাদন ক্ষমতা এখনও টিকে আছে।
বিদেশি উন্নত জাতের গরু:
আমরা জানি, প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের বিভিন্নতা প্রাণীর জাত নির্ধারণ করে। এজন্য বিদেশী উন্নত গরুর জাত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার আগে এদের পূর্ব বংশধরদের কথা জানা উচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানকালের গরুর পূর্বপুরুষ বা টরাস ও বস ইন্ডিকাস প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
ইউরোপের সকল গরু বা টরাসের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির প্রধান শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের কোনো চুট নেই। যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি, আয়ারশায়ার, ব্রাউন সুইস প্রভৃতি জাতের গরু। কা ইন্ডিকাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের চুট আছে এবং কোনো কোনো জাতের ক্ষেত্রে তা বেশ বড়। সিদ্ধি, শাহিওয়াল, হারিয়ানা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ।
বাংলাদেশে যে সকল বিদেশি উন্নত জাতের গরু পাওয়া যায় সেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা— ইউরোপীয় জাতের গরু এবং উপমহাদেশীয় গরু।
ইউরোপীয় জাতের গরুর মধ্যে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান, জার্সি, ব্রাউন সুইস, আয়ারশায়ার উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান এবং জার্সি ষাঁড় প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হয়। এদের কুঁজ নেই।
সারণি ১০ : বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস গরুর মধ্যে পার্থক্য
প্রাণিজগতে গরুর শ্রেণিবিন্যাস
জগৎ (Kingdom)ঃ প্রাণিজগৎ (Animalia)
পর্বঃ মেরুদন্ডী প্রাণী (Cordata)
শ্রেণী (Class): স্তন্যপায়ী প্রাণী (Mammalia) যারা বাচ্চা প্রসব করে ও বাচ্চাকে দুধ পান করায়
বর্গ (Order): জোড় খুরবিশিষ্ট প্রাণী (Artiodactyla)
গোত্র (Family): বভিডি (Bovidae) – রোমন্থক প্রাণী যারা জাবর কাটে।
গন (Genus): বস (Bas) – চতুষ্পদ প্রাণী, বন্য এবং গৃহপালিত, শক্তিশালী দেহ।
প্ৰজাতি (Species)ঃ Bos taurus, Bos indicus, Bos frontalis ইত্যাদি।
গরুর বিভিন্ন জাতকে তিন উপায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-
- উৎপত্তি বা আকার অনুসারে
- ব্যবহার বা কাজ অনুসারে
- জাতির মৌলিকত্ব বা বিশুদ্ধতার পরিমাণ দিয়ে
উপত্তি ও আকার অনুযারী জাতের শ্রেণিবিন্যাস:
- বস প্রমিজেনিয়াস (Bas promigenious) : উদাহরণ- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, আয়ারশায়ার ইত্যাদি।
- বস লঙ্গিফ্রন্স (Bas longifrons) : উদাহরণ- ব্রাউন গুইস, জার্সি, ওয়েরেন্সি ইত্যাদি।
- বস ফ্রন্টালিস (Bos frontalis) : উদাহরণ- সিমেন্টাল।
- বস ব্র্যাকিসেফালাস (Bas brachycephalus) : উদাহরণ- কেরি, সাসেক্স, হারফোর্ড ইত্যাদি।


হলস্টেন ফ্রিজিয়ান গরু:
এই দুধাল জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান হল্যান্ডের ফ্রিজল্যান্ড। বর্তমানে প্রথিবীর প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান দুধাল জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের গরু। গাভীর গড়পড়তা ওজন ৭৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ১১০০ কেজি। শরীর বেশ পুষ্ট, পেছনের অংশ ভারি এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়। পেছনের পা সোজা, লম্বা এবং অপেক্ষাকৃত সরু, মাথা ও শরীর পেশিযুক্ত। গাভী শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি। গো-চারনের অভ্যাস মাঝারি ধরনের। এদের গায়ের রঙ সাদা, কালো মিশ্রিত। উভয় রঙের কোনো একটির প্রাধান্য হতে পারে। জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০-৪৫ কেজি হয়, বয়ঃপ্রাপ্তি দেরিতে ঘটে। এজাতীয় গাভী বছরে ৪৫০০-৯০০০ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। দুধে চর্বির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। দুধ উৎপাদনকারী গাভীর মধ্যে এরা অধিক দুগ্ধদানের জন্য বিখ্যাত।
১. এ জাতের গরুর বর্ণ ছোট—বড় কালো—সাদা রঙে মেশানো হয়।
২. উন্নত জাতের গাভীর মধ্যে এরা আকারে সবচেয়ে বড় হয়।
৩. মাথা লম্বাটো হয়। অন্যান্য জাতের গরুর ন্যায় এদের কুঁজ হয় না।
৪. পূর্ণবয়স্ক ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৮০০—১০০০ কেজি ও গাভীর ওজন প্রায় ৫০০—৬০০ কেজি হয়ে থাকে।
৫. গাভী দিনে প্রায় ৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
৬. এ জাতের বকনা প্রায় দেড় থেকে দুই বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
৭. দুধে চর্বি থাকে ৩.৫% থেকে ৪%।
৮. শরীর বেশ পুষ্ট, পিছনের অংশ ভারী এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়।
৯. গাভী শান্ত প্রকৃতির কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি।
১০. জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০—৪৫ কেজি হয়।
১১. অধিক দুধ দানের জন্য এ জাত বিশ্ববিখ্যাত ।
১২. মাথা ও পেছনের পা বেশ সোজা।
১৩. এ জাতের গাভী পরবতীর্ বাচ্চা দেয়ার আগ পর্যন্ত একটানা দুধ দেয়।
১৪. এরা বছেও ৪৫০০—৯০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।

জার্সি গরু:
ইংল্যান্ডের জার্সি, ওয়েরেন্সি, অ্যালডারনি ও সার্ফ চ্যানেল দ্বীপসমূহে এদের উৎপত্তি। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার পূর্ব ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে এদের বিস্তৃতি রয়েছে।
বিদেশী দুধাল জাতের গাভীর মধ্যে জার্সির আকার সর্বাপেক্ষা ছোট। গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ এবং ষাঁড়ের ওজন ৬০০-৮০০ কেজি। দেহের গঠন সুন্দর ও নিখুঁত, গুলানগ্রন্থি, বেশ বড় এবং সুগঠিত। শিরদাড়া সোজা এবং মাথা ও ঘাড় সামঞ্জস্যপূর্ণ। গায়ের রঙ ফিকে লাল (fawn)। জিহ্বা এবং লেজের রঙ কালো।
গো-চারনে অভ্যস্ত। জার্সির বাচ্চা আকারে ছোট ও দুর্বল হয়। তাই জন্মের পর বাচ্চা লালনপালন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বাচ্চার জন্ম ওজন ২২-৩৩ কেজি পর্যন্ত হয়। অতি অল্প সময়ে জার্সি গাভী কয়প্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুধ উৎপাদনে সক্ষম।
ভালো মান ও অধিক পরিমাণ দুধ উৎপাদনের জন্য জার্সি জাতের গরু বিখ্যাত। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০-৪০০০ লিটার দুধে চর্বির গড় হার ৫%। জার্সি গরু মাংসল হয় না।
বৈশিষ্ট্য:
১. আকার তুলনামূলক ভাবে ছোট।
২. জন্মের সময় বাচ্চা দুর্বল ও ছোট হয়।
৩. গায়ের রঙ ফিকে লাল এবং গাঢ় বাদামি হয়।
৪. মাথা লম্বা, এদের কুঁজ হয় না, ফলে শিরদাড়া সোজা হয়।
৫. শরীরে মেদ কম থাকে, লেজের রঙ কালো।
৬. গাভীর ওলান বেশ বড় হয়, পা গুলো ছোট কিন্তু মজবুত।
৭. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪.—০০—৫০০ কেজি ও ৬০০— ৮০০ কেজি।
৮. একটি গাভী হতে বছরে ৩৫০০—৪৫০০ কেজি দুধ পাওয়া যায়।
৯. গরু স্বল্পসময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘসময় ধরে বাচ্চা ও দুধ দেয়।
১০. শিং পাতলা ও সামনের দিকে কিছুটা বাঁকানো থাকে
১১. দৈনিক ১৫—২০ কেজি দুধ দেয়।
১২. দুধে চর্বিও পরিমাণ ৫% হয়।
২। উপমহাদেশীয় জাতের গরু Ñ এদের কুঁজ হয়।
আয়ারশায়ার গরু (Ayreshire):
আয়ারশায়ারের উৎপত্তি স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম আয়ারশায়ার প্রদেশে। এ জাতের গরু গ্রেট বৃটেন, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য ঃ
আয়ারশায়ার গাভীর ওজন ৫৫০-৭০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৮৫০-১১৫০ কেজি। এদের শিরদাড়া গোজা এবং শিং প্রসারিত ও থাকা। ওলানগ্রন্থি বেশ বড় ও সুগঠিত। গায়ের রঙ লালের মধ্যে সাদা ফোঁটা ফোঁটা। সাধারণত মাথা ও শরীরের সম্মুখভাগে গাঢ় রঙ দেখা যায়। গাভীর রঙ হালকা লাল, তবে ষাঁড়ের রঙ গাঢ় লাল।
গো-চারনে ভালোভাবে অভ্যস্ত। আয়ারশায়ার বয়ঃপ্রাপ্ত হয় ওয়েরেন্সির পরে কিন্তু হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান অপেক্ষা তাড়াতাড়ি। হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের বায়ুরের ন্যায় আয়ারশায়ারের বাছুর জন্মের সময় সতেজ ও সবল হয়। বাছুরের জন্ম ওজন (birth weight) ৩৫-৪০ কেজি। এরা দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ৫০০০ লিটার। দুধে চর্বির হার ৪%।
শাহীওয়াল গরু
আদি বাসস্থান: শাহীওয়াল জাতের গরুর আদি বাসস্থান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টগোমারী জেলা। এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই শাহীওয়াল জাতের গরু পাওয়া যায়। পাকিস্তান থেকে এ জাতের গরু আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে।

বৈশিষ্ট্য:
১. এ জাতের গরু আকারে বেশ বড় হয়।
২. এদের মাথা চওড়া, পা ছোট ্এবং শিং পুরু।
৩. গায়ের রং তামাটে লাল ।
৪. মাথা প্রশস্ত কিন্তু শিং ছোট ও মোট হয়।
৫. নাভীর চার পাশের চামড়া মোটা ও ঢিলা।
৬. ওলান বড় ও ঝুলন্ত।
৭. বলদ অলস প্রকৃতির ও ধীরগতি সম্পন্ন।
৮. গলকম্বল, কান ও নাভী সাধারণত ঝুলানো থাকে।
৯. পূর্ণবয়স্ক গাভীর ওজন প্রায় ৩৫০—৪৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৫০০—৭০০ কেজি হয়ে থাকে।
১০. একটি গাভী দিনে প্রায় ১২—১৫ কেজি দুধ দেয় এবং বছেও ৩০০ দিন পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
১১. শাহীওয়াল ষাঁড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরুর দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভাল।
১২. বকনা তিন থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
১৩. এদের লেজ লম্বা এবং প্রায় মাটি ছুয়ে যায়।
১৪. লেজের মাথায় একগোছা কালো লোম থাকে।
১৫. জন্মের সময় বাছুরের ওজন ২২—২৮ কেজি হয়।

লাল সিন্ধি গরু (Red Sindhi):
পাকিন্তানের সিন্ধু প্রদেশের করাচী, লাসবেলা ও হায়দারাবাদ, এ জাতের গরুর আদি বাসস্থান। এ জাতের গরু লাল বলে এদের লাল সিন্ধু বলা হয়। পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও আফ্রিকাতে এ জাতের গরু পাওয়া যায়।
গাভীর ওজন ৩৫০-৪০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৪২৫-৫০০ কেজি। চুট উন্নত, গলকম্বল ও নাভীর চারদিকের চামড়া বেশ ঢিলা, কপাল বেশ প্রশস্ত ও উন্নত, শিং মাঝারি আকারের এবং কিছুটা ভেতরের দিকে বাঁকানো। কান মাঝারি আকারের, গুলান গ্রন্থি বড়। গায়ের রঙ গাঢ় লাল, কিন্তু কালচে হলুদ থেকে গাঢ় মেটেও হতে পারে।
বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। এরা ভারতীয় উপমহাদেশে দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। গিন্ধি গাভী বছরে গড়ে ২000 লিটার দুধ দেয়। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। এ জাতের গরু আমাদের দেশের আবহাওয়ায় মোটামুটি ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। সিন্ধি বলদ একটু আলসে প্রকৃতির। কিন্তু ষাঁড় ও বাংলাদেশী গাভীর মিলনে সৃষ্ট বলদ হাল-চাষ ও গাড়ি টানার জন্য ভালো। বকনা তিন বছরেই গাভীতে পরিণত হয়। পরিমাণ ৪.৫%। বলদ সাধারণত অলস প্রকৃতির ও মন্থর গতিসম্পন্ন। শাহিওয়াল ধাড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরু দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভালো।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রং গাঢ় লাল হয় এবং নাভী বড় ও ঝুলানো হয়।
২. কপাল প্রশস্ত ও উন্নত কান নিচের দিকে ঝুলানো হয়।
৩. দেহের অনুপাতে মাথা ছোট, নাকের চূড়া চওড়া।
৪. ওলানের বাটগুলো সুগঠিত এবং চার কোণায় সমদূরত্বে সমভাবে বসানো।
৫. শিং ভোতা, যা পাশে ও পিছনের দিকে বাঁকানো।
৬. গাভী দৈনিক ১০ লিটার পর্যন্ত এবং বছরের ৩৫০ দিন দুধ সিন্ধি দেয়।
৭. বকনা ৩ বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
৮. বলদ বা ষাঁড় হালচাষ ও গাড়ি টানার কাজে বেশ উপযোগী।
৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি এবং ৪০০—৫০০ কেজি।
১০. গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০ লিটার।
১১. দুধে চর্বির ভাগ ৫%।

হারিয়ানা গরু:
ভারতের রোহটক, হিসার, গুরগাও, কার্নাল ও দিল্লি হারিয়ানার আদি বাসস্থান। ভারতের সব জায়গায় হারিয়ানা দেখা যায়। তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেজন্য ল্যাটিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনাঞ্চলে এদের সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার সংকর জাতের গরু উৎপাদন করতে দেখা যায়।
গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০-৫০০ ও ৬০০-১১০০ কেজি। উচ্চতা ১৪০-১৪৫ সে.মি। বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। মাথা লম্বা ও অপেক্ষাকৃত গরু। শিং লম্বা, চিকন ও মসৃন। ওলান সুগঠিত ও আটোসাটো, গায়ের রঙ হালকা ধূসর বা সাদাটে। কোনো কোনো ষাঁড়ের খাড়, চুট, বুক প্রভৃতি স্থান গাঢ় ধূসর রঙের। হারিয়ানা অত্যধিক পরিশ্রমী ও শক্তিশালী গরু। এরা দৈত কাজ, যথা- দুধ উৎপাদন ও গাড়ি টানার উপযোগী। বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ কেজি। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। বকনা ৩-৪ বছরের মধ্যে গাভীতে পরিণত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রং সাদা বা হালকা ধূসর।
২. এরা বেশ শক্তিশালী ও পরিশ্রমি হয়।
৩. সুগঠিত ও আঁটিসাঁট ও লাল হয়।
৪. শিং লম্বা, চিকন এবং মসৃণ হয়।
৫. মাথা লম্বা ও অপেক্ষকৃত সরু।
৬. নাভী শরীরের সাথে লাগানো।
৭. গাভী প্রায় ৩০০ দিন দুধ দেয় এবং বছরে ৩০০০—৩৫০০ কেজি দুধ দেয়।
৮. তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০—৫০০ কেজি ও ৮০০—১০০০ কেজি।
১০. বকনার প্রথম বাচ্চা প্রসব করতে ৪ বছর সময় লেগে যায়।
১১. দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
ধারপারকার গরু (Tharparkar )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ধারপারকার জেলায় এদের উৎপত্তি। সিন্ধু প্রদেশের সর্বত্র এবং পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে এদের পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
থারপারকার বেশ শক্তিশালী গরু। গায়ের রঙ সাদা। এরা মধ্যম আকৃতির ও হারিয়ানার চেয়ে কম উচ্চতাসম্পন্ন। শিং ও চুট মধ্যম আকারের। গলকম্বল বর্ধিত কিন্তু শাহিওয়াল ও সিদ্ধির চেয়ে ছোট। দেহ সুঠাম ও সুন্দর। ধারপারকার হারিয়ানার ন্যায় দৈত উদ্দেশ্যে অর্থাৎ দুধ ও মাংস উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ লিটার। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
অমৃত মহল (Amrit Mahal )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এ জাতের গরুর উৎপত্তি ভারতের কর্ণাটক প্রদেশে। তবে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের খামারেও এদের দেখতে পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য ঃ
দেহ সুগঠিত, পিঠ সোজা এবং পা দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুখাকৃতি লম্বা ও কপাল উন্নত। শিং লম্বা ও প্রশস্ত, গলকম্বল ও চুট উন্নত এবং বড়। চামড়া বেশ আটোসাটো, লেজ মাঝারি লম্বা এবং লেজের গুচ্ছ কালো। গায়ের রঙ ধূসর, তবে মাথা, গলা, চুট ও পা কালো লোমে আবৃত। ভারতের শক্তি উৎপাদনশীল গরুর মধ্যে এরা উৎকৃষ্ট জাত। এরা অত্যন্ত কর্মক্ষম, তবে গাভীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম৷
ব্রাহ্মণ গরু (Brahman)
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এই জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান ভারত। তবে, বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই পাওয়া যায়। ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গরুর সাথে ইউরোপ ও আমেরিকায় উন্নত টাইপের গরুর দীর্ঘ সংকরায়নের ফলে এই জাতের সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাহ্মাণ সম্প্রদায়ের নামের সাথে মিল রেখেই এই জাতের গরুর নাম দেয়া হয়েছে ব্রাহ্মণ।
জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ
গায়ের রঙ ধূসর অথবা লাল। তবে, বাদামি, কালো, সাদা ও ফুটফুটে রঙেরও দেখা মেলে৷ মুখাকৃতি লম্বা, কান ঝুলন্ত, ছুট উঁচু, গলকম্বল পুরু ও মোটা চামড়ায় আবৃত। এরা মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।
অ্যাঙ্গাস গরু (Angus )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এদের আদি বাসস্থান স্কটল্যান্ড, অ্যাবারডিন, অ্যাঙ্গাস, ঝিংকারডিন ও ফরফার-এর উত্তর পূর্বাঞ্চল।
জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ
এদের গায়ের রঙ কালো। কোনো শিং নেই। গায়ের চামড়া ও লোম মসৃণ। দেহ লম্বাকৃতির। এরা উন্নত এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।
উন্নত জাতের সংকর গরু:
উন্নত জাতের ষাড়ের সঙ্গে দেশী গাভীর মিশ্রণে যে জাতের গরু উৎপাদন করা হয় তাকে সংকর জাতের গরু বলে। সংকর জাত আসলে মিশ্রজাত। সংকর জাত সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াকে সংকরায়ন বলে। আমাদের দেশে দেশী অনুন্নত গাভীকে বিদেশী উন্নত জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে সংকরায়ন করে তার থেকে উন্নত সংকর বাছুর উৎপাদন করা হচ্ছে।
সংকরায়নের জন্য আগে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ধাড় আমদানি করা হতো। কিন্তু দেশের চাহিদার তুলনায় এত বেশি ষাড় আমদানি করা বায়বহুল। এজন্য কমসংখ্যক গাড় দিয়ে বেশিসংখ্যক গাভীকে প্রজনন করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অর্থাৎ কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা দেশে চালু হয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থায় উন্নত জাতের ধাড় থেকে সংগ্রহ করা বীর্য বা বীজ গাভীর জনন অঙ্গে সংস্থাপন করে ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। আমাদের দেশে এই পদ্ধতি খুব ধীরে ধীরে চালু হয়েছে। বর্তমানে গ্রাম ও শহর সর্বত্রই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বহু সংকর বাছুর উৎপাদিত হচ্ছে।

সংকর গরু সৃষ্টির উদ্দেশ্য
সংকর জাতের গরু সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য অনুন্নত জাতের গরুকে উন্নত করে অধিক হারে দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদন করা। দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত গরুর জাতগুলো বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। যেমন- দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত জাতের গরু হলস্টেইন- ফ্রিজিয়ান ও জার্সির আদি বাস ইউরোপে।
শক্তি ও মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু অমৃত মহল, কৃষ্ণ ভেলি, হারিয়ানা, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি ভারতে পাওয়া যায়। মাংস উৎপাদনকারী জাত, যেমন- ব্রাহ্মণ, অ্যাঙ্গাস, হারফোর্ড প্রভৃতি আমেরিকায় পাওয়া যায়। এসব জাতের গরু অন্য দেশের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। লালনপালনে অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। তারপরও অনেক সময় বাচানো কঠিন হয়।একদেশ থেকে অন্যদেশে এসব জাতের গরু স্থানান্তর করা ব্যয়বহুল।
ফলে গরুর ব্যবসায় লাভবান হওয়া যায় না। এসব অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে খুব সীমিত সংখ্যায় এ জাতের ষাড় বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর নিজ দেশের গাভীর সঙ্গে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাতের গাভী ও ষাড় উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বাংলাদেশের কথা বলা যায়। সরকার বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাড় এনে সরকারী খামারে লালনপালন করেন। উক্ত ষাঁড় থেকে কৃত্রিম উপায়ে বীজ সংগ্রহ করে সারাদেশে বিভিন্ন কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উক্ত বীজ দিয়ে দেশী গাভীর প্রজনন করানো হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ দেশী গাভী থেকে সংকরায়নের মাধ্যমে সংকর গাভী সৃষ্টি করতে পারছে।
সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য
নিম্নে সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো-
- দুধ, মাংস কিংবা শক্তির জন্য সৃষ্ট সংকর গরুর উৎপাদন দেশী গরুর থেকে বেশি হয়।
- সংকরায়নের ফলে জিনের (gene) সংমিশ্রণ ঘটে বলে পরবর্তী প্রজন্মের রোগপ্রতিরোধ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- দু’টি ভিন্ন জাতের গাভী ও ষাঁড়ের মধ্যে সংকরায়নের ফলে যে বাছুর উৎপন্ন হয় সে তার মাতা-পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বৈশিষ্ট্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। চিত্র ২৯-এ নিয়মটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
একটি দেশী গাভীকে একটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে প্রজনন করানো হলে যে বাচ্চা জন্ম নেয় তার দেহে ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের রক্ত থাকে। এই বাছুর বরুনা হলে বড় হওয়ার পর হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড় দিয়ে তাকে প্রজনন করানো হলে বাচ্চার দেহের আদি দেশী মা গাভীর রক্ত আরও অর্ধেক কমে ২৫% হয়ে যাবে।
অর্থাৎ এটি ৭৫% উন্নত জাতের বৈশিষ্ট্য পাবে। এভাবে সংকর গাভী থেকে গাত পুরুষে তাত্ত্বিকভাবে ১০০% খাটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান আনা যায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম বংশের গাভী বা ধাড়ই ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান রক্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
অনুশীলন (Activity) :
ধরুন, আপনার বাড়িতে একটি অনুন্নত দেশী গাভী আছে। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে একে প্রজনন করালেন। উক্ত গাভীর পঞ্চম বংশধরের ক্ষেত্রে দেশী ও উন্নত ষাঁড়ের রক্তের শতকরা হার যথাক্রমে কত হবে?
সংকর গরুর উৎস
উন্নত জাতের গরু সংকর গরুর উৎস বা পূর্বপুরুষ। আমাদের দেশে দুধ উৎপাদন করার লক্ষ্যে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের সাথে দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। অনেকে শাহিওয়াল ষাঁড়ের সঙ্গেও দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন করে থাকেন। তবে বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশী গাভীকে প্রজনন করিয়ে যে বাচ্চা পাওয়া যায় তা এদেশের আবহাওয়ায় বেশি উৎপাদন দিতে সক্ষম। শক্তি ও মাংসের জন্য বাংলাদেশ এখনও সংকর গাভী উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। আমাদের দেশে মাংস ও শক্তির চাহিদা যথেষ্ট। এই চাহিদা মেটানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
উৎপাদন ব্যবহারের ভিত্তি করে গরুর শ্রেণীবিভাগ:
দুধ ও মাংস উৎপাদন এবং কার্যকারিতর উপর ভিত্তি করে গরুর জাতকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যেমন—
দুধাল জাত:
এ শ্রেণীর গাভীগুলো সাধারণত অধিক পরিমাণে দুধ দিয়ে থাকে। যেমন—হলস্টেইনফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, জার্সি, লাল সিন্ধি, ব্রাউন সুইস, আয়ার শায়ার, গুয়ারেন্সি ইত্যাদি।
মাংসল জাত:
মাংস উৎপাদনের জন্য এ জাতগুলো বেশি পরিচিত। যেমন— অ্যাঙ্গাস, বিফ মাষ্টার, ব্রাহ্মণ, ডেবন, সর্টহর্ন, হালিকার ইত্যাদি।
দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাত:
এ শ্রেণীর গাভী মোটামুটি ভাল দুধ দেয় এবং এদেরকে কৃষিকাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন— হারিয়ানা, থাষ্টার্কার, রেডপোল,কাংক্রেজ,মিল্কিং সর্টহর্ন ইত্যাদি।
শ্রম বা ভারবাহী জাত :
এ জাতের বলদ গরুগুলো কৃষিকাজ এবং ভার বহনে বেশি উপযোগী। যেমন— অমৃত মহল, মালভি, হরিয়ানা, ধান্নি, কৃষ্ণভেলি, ভাগনারি ইত্যাদি।
দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন:
দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন – পাঠটি বাউবি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ইউনিট – ১৪ , পাঠ – ১৪.১। ভূমিকা আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধিতে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও দারিদ্র দূরীকরণে দুগ্ধ খামারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুগ্ধ খামার স্থাপনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই একই সুতোয় গাঁথা। খামার স্থাপনের পূর্বে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করে কাজ করতে হয় ঠিক তেমনি খামার স্থাপনের পর খামারের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়। দুগ্ধ খামারের মূল উৎপাদিত দ্রব্য হচ্ছে দুধ। তাই দুধ বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। খামার স্থাপনের উদ্দেশ্যই হলো তা থেকে মুনাফা অর্জন করা। সুতরাং দুগ্ধ খামারের আয় ব্যয়ের হিসেব সম্পর্কেও জানা আবশ্যক।
এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে দুগ্ধবতী গাভী ও মহিষের জাত নির্বাচন, গর্ভকালীন ও প্রসবকালিন গাভীর যত্ন, দুগ্ধবতী গাভীর যত্ন ও খাদ্য, নবজাত বাছুরের যত্ন, দুধ উৎপাদনে প্রভাবক বিষয়বসমূহ। বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদন ও দুধ পরীক্ষা, দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্ম পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরি, গর্ভবতী গাভী শনাক্তকরন নিয়ে তাত্বিক ও ব্যাবহারিকভাবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
উন্নত জাতের গাভীর লক্ষণ (Sign of Hybrid Cow) একটি উন্নত জাতের দুধালো গাভীর লক্ষণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১. উন্নত জাতের গাভী সামঞ্জস্যপূর্ণ নিখুঁত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হবে ২. পিছনের অংশ বেশি চওড়া এবং দাঁড়ানো অবস্থায় পিছনের পা দুটি বেশি ফাঁক থাকে।
৩. দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
৪. ভালজাতের গাভীর পাঁজরগুলো আলাদা এবং স্ফীত দেখায় ।
৫. দেহ বেশ বড় এবং দেহের আকার সামনের দিকে সরু এবং পিছনের দিকে ভারী হয়।
৬. চামড়া পাতলা ও মসৃণ প্রকৃতির হয়।
৭. ভালজাতের গাভীর শরীর ঢিলেঢালা ও নাদুশ-নুদুশ হয়।
৮. ওলান সুগঠিত নরম, আকারে বড়, চওড়া এবং ওলান শক্তভাবে শরীরের সাথে আটকানো থাকে ।
৯. ওলানের বাট চারটি সমান আকৃতির ও সমান দূরত্বে অবস্থিত হবে।
১০. দুধ দোহনের আগে ওলান শক্ত থাকে এবং দোহনের পর চুপসে যায়।
১১. ওলানের সামনে নাভীর দিকে সুস্পষ্ট ও উন্নত দুগ্ধশিরা স্পষ্ট দেখা যায়।
১২. উন্নত জাতের গাভীর নাকের ছিদ্র বড় ও খোলা হয়।
১৩. একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যবান গাভীর স্বভাব অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির হয়।
সারসংক্ষেপ:
দেশী গাভী সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভীর উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুষম খাদ্য প্রদান ও স্বাস্থ্যসম্মত পালন ব্যাবস্থার মাধ্যমে একটি সংকর বা উন্নত জাতের গাভী হতে দৈনিক ২৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। উন্নত জাতের গাভী সাধারনত ত্রিকোনাকৃতির হয়। এদের দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
গরুর জাতের ফটো গ্যালারী: