গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

আজকে আমরা গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয় সম্পর্কে জানবো। এটি কৃত্রিম প্রজনন ও খামার স্থাপন এর গাভীর জাত উন্নয়ন ইউনিটের অন্তর্গত।

 

গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

 

গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

গর্ভধারণ বা গর্ভাবস্থা বলতে কোনো গাভীর জরায়ু বা ইউটেরাসে বর্ধনশীল বাচ্চার উপস্থিতিকেই বোঝায়। গাভীকে পাল দেওয়া থেকে বাচ্চা প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে গর্ভধারণকাল বলে । গাভীর গর্ভধারণকাল ২৮০ + ১০ দিন ।
গর্ভধারণ নির্ণয় একটি জটিল বিষয়। অথচ সাফল্যজনক খামার ব্যবস্থাপনায় পাল দেওয়ার পর গাভী গর্ভবতী হয়েছে কিনা এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। সাধারণত পাল দেওয়ার ৬-১২ সপ্তাহ পর গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা হয়ে থাকে ।

গর্ভাবস্থা বা গর্ভধারণ নির্ণয়ের উদ্দেশ্য (Objectives of pregnancy diagnosis)

  • যে সমস্ত গাভী অনুর্বরতা (Infertility) বা বন্ধ্যাত্বের (Sterility) কারণে বাচ্চা ধারণ করতে পারে না তাদেরকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা করানো অথবা খামার থেকে ছাঁটাই করা ।
  • গর্ভবতী গাভীকে চিহ্নিত করে শুরু থেকেই তার জন্য পৃথক খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ।
  • অনেক গাভী গর্ভধারণ না করেও এমন কতকগুলো লক্ষণ প্রকাশ করে যাতে মনে হয় গাভীটি গর্ভবতী । গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের মাধ্যমে এধরনের গাভী চিহ্নিত করে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় রোধ করা যায় অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভজনক হওয়া যায় ।

 

গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

 

গর্ভাবস্থা বা গর্ভধারণ নির্ণয়ের পদ্ধতি (Methods of pregnancy diagnosis)

গর্ভাবস্থা বা গর্ভধারণ নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলো হলো –
  • বাহ্যিক লক্ষণ দেখে (Sign of pregnancy)
  • রেকটাল পালপেশন পদ্ধতি (Rectal palpation method)
  • ল্যাবরেটরী পরীক্ষার মাধ্যমে (Laboratory tests)

গর্ভাবস্থার বাহ্যিক লক্ষণ (Sign of pregnancy)

গাভী গর্ভার্ধারণ করলে যে সমস্ত বাহ্যিক লক্ষণ প্রকাশ পায় সেগুলো হলো –

  • ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়া— গর্ভধারণের প্রাথমিক চিহ্নই হলো গাভীর ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়া । পাল দেওয়ার পর ঋতুচক্র বন্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই গাভীটি গর্ভবতী হয়েছে বলে মনে করা হয় । অবশ্য অনেক সময় পাল দেওয়ার পর গাভী গর্ভবতী না হলেও বিভিন্ন কারণে ঋতুচক্র বন্ধ হতে পারে । আবার গাভী গর্ভবতী হলেও ঋতুচক্র বা গরম হওয়ার লক্ষণ প্রদর্শন করে থাকে ।
  • গাভী নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে ।
  • গাভীর দেহে চর্বি জমতে শুরু করে ।
  • ভ্রুনের বৃদ্ধি এবং ওলান ও জরায়ু স্ফীত হওয়ার কারণে গর্ভাবস্থার মাঝামাঝি সময় থেকে গাভীর দৈহিক ওজন বাড়তে থাকে ।
  • গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গাভীর তলপেটের (Abdomen) আয়তন বেড়ে যায় ।
  • গাভীর ওলান দৃঢ়, চকচকে এবং আকারে বড় হয় । আর বাঁটগুলো তৈলাক্ত মনে হয় ।

রেকটাল পালপেশন পদ্ধতি (Rectal palpation method)

গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের জন্য এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজ । এই পদ্ধতিতে খুব কম খরচে অল্প সময়ে প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা যায় । রেকটাল পালপেশন পদ্ধতিতে গাভী গর্ভবতী হয়েছে কিনা শুধুমাত্র এটাই নির্ণয় করা হয় না, গাভী কতদিনের গর্ভবতী তাও নির্ণয় করা হয় । এই পদ্ধতিতে যদিও কোনো যন্ত্রপাতি বা রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু পরীক্ষককে (যিনি গর্ভাবস্থা নির্ণয় করবেন) যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হয় ।
রেকটাল পালপেশন পদ্ধতিতে গর্ভবস্থা নির্ণয়ের জন্য যা করতে হবে-
  • গাভীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সুবিধাজনক জায়গায় আটকাতে হবে ।
  •  যিনি গর্ভাবস্থা নির্ণয় করবেন তাঁকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
  • গায়ে এ্যাপ্রোন, পায়ে গামবুট এবং সম্ভব হলে বাম হাতে গ্লাভস পড়ে নিতে হবে ।
  • গাভীর যোনি ও মলদ্বার অল্প গরম পানি দিয়ে ধুয়ে তুলো দিয়ে মুছে নিতে হবে এবং ভালো পিচ্ছিলকারক পদার্থ যেমন ভেসিলিন দিয়ে পিচ্ছিল করে নিতে হবে। যিনি গর্ভাবস্থা নির্ণয় করবেন তার হাতও পিচ্ছিল করে নিতে হবে ।
  • গাভীর ডান পাশে দাঁড়িয়ে ডান হাত দিয়ে গাভীর লেজ তুলে ধরতে হবে এবং বাম হাত মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে ।
  • হাতের কব্জি ঢুকে গেলে মলদ্বারের প্রাচীরের উপর থেকে গাভীর জননতন্ত্রের অংশগুলোর অবস্থা অনুভব করতে হবে ।

 

গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

 

গাভীর গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রকম অনুভূতি অনুভব করা যাবে ।

গাভী গর্ভবতী না হলে

ভালভা থেকে ৬ হতে ১০ ইঞ্চি পরই সার্ভিক্স অনুভূত হবে । জরায়ুর দুটো শাখাই সমান থাকবে । জরায়ুর শাখা দুটোর মাঝখানে ঢালু থাকবে । বকনা গাভীর ক্ষেত্রে সার্ভিক্স, জরায়ুর শাখা এবং ডিম্বাশয় হাতের তালু দিয়ে ধরা যাবে । ডিম্বাশয়ে করপাস লিউটিয়াম থাকবে না ।

গাভী ১ মাসের গর্ভবতী হলে

জরায়ুর যে শাখায় (সাধারণত ডান শাখায়) ভ্রুণ থাকবে তা অন্য শাখা অপেক্ষা কিছুটা মোটা হবে । ভ্রুণ ধারণকারী শাখার ডিম্বাশয়ে করপাস লিউটিয়াম উপস্থিত থাকবে । সার্ভিক্সের বাইরের মুখে ঘন অর্ধকঠিন মিউকাস থাকবে । জরায়ু পাতলা ও হালকা মনে হবে এবং এর ভেতরে তরল পদার্থ রয়েছে বলে অনুভূত হবে । ভ্রুণ আনুমানিক ১/২ ইঞ্চি লম্বা হবে এবং এর চার পাশে তরল পদার্থ বেষ্টিত রয়েছে বলে মনে হবে ।

গাভী ২ মাসের গর্ভবতী হলে

ভ্রুণ ধারণকারী জরায়ুর শাখাটি আরো মোটা হবে এবং সহজেই অনুভব করা যাবে । জরায়ুর শাখাটি পিচ্ছিল হবে । ভ্রুণ আকারে ৫ সপ্তাহে মার্বেলের মতো এবং ৭ সপ্তাহে মুরগির মতো মনে হবে ।

গাভী ৩ মাসের গর্ভবতী হলে

ভ্রুণ ধারণকারী জরায়ুর শাখাটি আরো মোটা হবে এবং এর চারপাশের তরল পদার্থের পরিমাণ ও বাড়বে । জরায়ুর শাখার ধমনী হাত দিয়ে বোঝা যাবে । জরায়ুর স্থান পরিবর্তিত হয়ে তলপেটে যাবে । ভ্রুণ প্রায় ১০ ইঞ্চি লম্বা হবে এবং ভ্রুণের হৃৎপিন্ডের স্পন্দন অনুভব করা যাবে ।

গাভী ৪ মাসের গর্ভবতী হলে

কটিলিডনের উপস্থিতি অনুভব করা যায় এবং তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে । ভ্রুণের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ ইঞ্চির মতো হয় । ভ্রুণের মাথা মাঝারি আকারের পেয়ারার মতো হবে । মাথার এই আকার দিয়েই গর্ভধারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হওয়া যায় । মলদ্বার দিয়ে হাত প্রবেশ করালে প্রথমেই মাথা উপস্থিতি অনুভব করা যায় ।

গাভী ৫ মাসের গর্ভবতী হলে

বাচ্চাসহ জরায়ু হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে । তবে অনেক সময় বাচ্চার সামনের পা বা বাচ্চা হাতে লাগতেও পারে ।
৫ মাসের পর থেকে বাহ্যিক লক্ষণ দেখেই বোঝা যাবে যে, গাভী অন্তঃসত্ত্বা ।
গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয়

ল্যাবরেটরী পরীক্ষা (Laboratory tests)

বেরিয়াম ক্লোরাইড পরীক্ষা :

৫-৬ ফোঁটা ১% বেরিয়াম ক্লোরাইড ৫ মি.লি. পরিমাণ মূত্রের সাথে মেশালে যদি মূত্রের রঙ অপরিবর্তিত থাকে তাহলে বুঝতে হবে ঐ গাভীটি গর্ভবতী । কিন্তু যদি মূত্রের রং পরিবর্তিত হয়ে সাদা রঙয়ের অধঃক্ষেপ পড়ে তাহলে বুঝতে হবে গাভীটি গর্ভবতী নয় । তবে এই পরীক্ষাটি ১০০% নির্ভরযোগ্য নয় ।

স্ক্যানিং ঃ

‘OVISCAN’ নামক যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা যায় ।
রক্তরসে গামা-গ্লোবিউলিনের উপস্থিতি পরীক্ষার মাধ্যমেও গর্ভাবস্থা নির্ণয় করা যায় ।

সারমর্ম

গাভীর গর্ভাবস্থা নির্ণয় একটি জটিল বিষয় । গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন গর্ভবতী গাভীর জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা নেওয়া যায় অন্যদিকে তেমনি খামারকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করা যায় । বাহ্যিক লক্ষণ, রেকটাল পালপেশন ও ল্যাবরেটরী পরীক্ষা— এই তিনভাবে গর্ভাবস্থা নির্ণয় | করা যায় । তবে গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের জন্য রেকটাল পালপেশন সবচেয়ে সঠিক ও উপযুক্ত পদ্ধতি ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

১। সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন ।
ক. বেরিয়াম ক্লোরাইড পরীক্ষায় কতো ফোঁটা বেরিয়াম ক্লোরাইড মূত্রের সাথে মেশাতে হয় ?
i. ৫-৬ ফোঁটা
ii. ৮-১০ ফোঁটা
iii. ৩-৪ ফোঁটা
iv. ৬-৭ ফোঁটা
খ. ১ মাসের গর্ভবতী গাভীর ভ্রুণ কতটুকু লম্বা হয় ?
i. ১ ইঞ্চি
ii. ১/২ ইঞ্চি
iii. ৩ ইঞ্চি
iv. ১১%, ইঞ্চি
২। সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন ।
ক. গাভী গর্ভবর্তী হলে ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যায় ।
খ. গর্ভবতী গাভীর বাঁটগুলো খসখসে হয়ে যায় ।
৩। শূণ্যস্থান পুরণ করুন ।
ক. গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের সবচেয়ে সঠিক ও উপযুক্ত পদ্ধতি হলো
খ. গর্ভাবস্থা নির্ণয়ে . মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে ।
৪। এক কথায় বা বাক্যে উত্তর দিন ।
ক. স্ক্যানিং এর জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রের নাম কী?

খ. গর্ভবতী গাভীতে কটিলিডনের উপস্থিতি অনুভব করা যায় কত মাস বয়সে ?

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment