ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি  “পানি সেচ ও নিষ্কাশন” বিষয়ক ইউনিট ৩ এর ৩.৩ নম্বর পাঠ।

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

ধানের ফসল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। ঝজও পদ্ধতিতে চাষ করার কৌশল সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালের দিকে মাদাগাস্কারে উদ্ভাবিত হয়। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন, রোপন, সেচ, সার, কীটনাশক কম লাগে। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা করতে হয় এবং ফলন বেশি হয়।

 

ঝজও পদ্ধতিতে ধান চাষের মূলনীতি/বৈশিষ্ট্য:

১. এ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে ৮—১২ দিন বয়সের চারা একটি করে রোপন করতে হয়।

২. বীজতলা থেকে চারা তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে চারা ভেঙ্গে না যায়; চারা তোলার পর পরই রোপন করতে হবে।

৩. চারা বর্গাকারে ২৫—৪০ সে.মি দূরত্বে লাগাতে হবে; অথার্ৎ সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব সমান। বর্গাকারে লাগানো গাছ পর্যাপ্ত আলো—বাতাস পাবে এবং আগাছা দমন সহজ হবে।

৪. জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সারও প্রয়োগ করতে হবে।

৫. মাটি পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো (অডউ) পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে। এতে মূলের বৃদ্ধি ভালো হবে ও মাটির অনুজীবের কার্যাবলী বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও মিথেন গ্যাস উৎপাদন কম হবে।

৬. ধানের থোড় অবস্থা থেকে ফসল পাকার ১৫ দিন আগ পর্যন্ত ধানের জমিতে ১—২ সে.মি. এর একটি পানির স্তর রাখতে হবে।

 

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা , পানি সেচ ও নিষ্কাশন , ইউনিট ৩ , পাঠ - ৩.৩

 

ঝজও পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন কৌশল :

ঝজও পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন কৌশলগুলো নিচে ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো—

 

১. চারার বয়স :

ঝজও পদ্ধতিতে খুব কম বয়সের (৮—১২ দিনের) চারা রোপন করা হয়। প্রতি গুছিতে একটি করে চারা রোপন করা হয়। কম বয়সের চারা শক্ত থাকে বলে মারা যায় না এবং আগাম থোড় বের হয় না। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ১০—১৫ দিন আগে ধান পরিপক্ক হয়।

 

২. রোপন দূরত্ব :

এ পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫—৪০ সে.মি. করে বর্গাকারে চারা রোপন করা হয়। এতে গাছ আলো বাতাস বেশি পায়, কুশি বেশি হয় এবং ফলনও বেশি হয়।

 

৩. সার প্রয়োগ :

এ পদ্ধতিতে প্রচুর জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সার স্বল্প পরিমানে প্রয়োগ করা হয়। জৈব সার প্রয়োগের ফলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয় এবং মাটির উর্বরতা বাড়ে।

 

৪. আগাছা দমন :

এ পদ্ধতিতে রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় যা পচে জৈব সার তৈরি করে। চারা রোপনের ১০—১২ দিন পর আগাছা দমন শুরু করতে হয়।

 

৫. সেচ ব্যবস্থাপনা :

পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ দিতে হয়। ঝজও পদ্ধতিতে যখন গাছের প্রয়োজন হয় তখনই পরিমানমত সেচ দেয়া হয়।

 

৬. শস্য সংগ্রহ :

ফসল পরিপক্ক হবার সাথে সাথে সংগ্রহ করতে হবে। ধান কাটার ১৫ দিন পূর্বে থেকে জমি শুকিয়ে ফেলতে হবে।

 

ধান চাষ ১ ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

 

ঝজও পদ্ধতির সুবিধা:

১. কৃষি উপকরণ কম লাগে।

২. একটি করে চারা রোপন করা হয় বলে বীজ হার কম; ৬—৭ কেজি/হেক্টর। সাধারন পদ্ধতির চেয়ে ৭০—৮০% বীজ কম লাগে।

৩. সেচের পানি কম লাগে।

৪. সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থায় থাকে না বলে মিথেন গ্যাস কম তৈরি হয়।

৫. জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানোর ফলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় এবং গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

৬. অধিক জৈব সার ব্যবহার করা হয় ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

৭. রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়।

৮. ধানের জীবনকাল ১—২ সপ্তাহ কমে যায়।

৯. ফলন বৃদ্ধি পায়।

 

ঝজও পদ্ধতির অসুবিধা:

১. ঝজও পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।

২. এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হয় যা বড় খামার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া কৃষকরা রাসায়নিক সারের উপর বেশি বিশ্বাসী।

৩. চারা রোপনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় কারন চারা অনেক ছোট থাকে যা তোলা থেকে শুরু করে লাগানো সব ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকতে হয়।

Capture 45 ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

 

ধান চাষে পর্যায়ক্রমে জমি ভেজানো ও শুকানো সেচ পদ্ধতি:

(Alternate Wetting and Drying (AWD) Method of Irrigation) ভড়ৎ জরপব ঈঁষঃরাধঃরড়হ ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। স¤প্রতি বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সেচ নির্ভর বোরো ধানের অবদান সবচেয়ে বেশি। বোরো ধান উৎপাদনে জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে ধানের জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। এজন্য ধানের জমিতে অডউ পদ্ধতি ব্যবহার করে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সেচ প্রদান করলে পানির অপচয় রোধ হয় এবং উৎপাদন খরচ কমে যায়।

অডউ বা পযার্য়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি হলো ধান ক্ষেতে সময়মতো ও প্রয়োজনমত সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশ বা প্লাস্টিকের পাইপ বসিয়ে মাটির ভেতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে সেচ দেয়া হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে ধান গাছ তার শিকড়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পানি নিতে পারে। পর্যবেক্ষণ পাইপে মাটির পানির পরিমান নির্ণয় করে প্রয়োজনমত সেচ প্রদান করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অডউ ২০—২৫ ভাগ পানি সাশ্রয়ী।

অডউ পদ্ধতিতে সেচের জন্য ৭—১৫ সে.মি. ব্যাস ও ৩০ সে.মি. দীর্ঘ প্লাস্টিক বা বাঁশের পাইপ প্রয়োজন। পাইপের উপরের ১০ সে.মি. ছিদ্রহীন এবং নিচের ২০ সে.মি. ছিদ্রযুক্ত। ৫ সে.মি. পর পর ৩ মি.মি. ব্যাসের ছিদ্র করতে হবে। পাইপটি ধানক্ষেতে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে উপরের ১০ সে.মি. মাটির উপরে থাকে যাতে সেচের পানির মাধ্যমে আবর্জনা বা খড়কুটা পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। নিচের ছিদ্রযুক্ত ২০ সে.মি মাটির নীচে থাকলে যাতে মাটির ভেতরের পানি ছিদ্র দিয়ে সহজেই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে বা বের হয়ে যেতে পারে।

 

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা 3 ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

 

অডউ পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের ধাপসমূহ :

১. এ পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের জন্য জমি খুব ভালভাবে সমতল করে নিয়ে চারা রোপন করতে হয়। এরপর একই সমতলে অবস্থিত এক একর পরিমান ধানের জমির জন্য ২—৩টি জায়গায় গর্ত করে পর্যবেক্ষণ পাইপ খাড়াভাবে বসাতে হবে।

২. রোপনের ১০—১৫ দিন পর্যন্ত জমিতে ২—৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এরপর অডউ পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে।

৩. প্রতিবার সেচ প্রদানের সময় এমন পরিমান পানি প্রয়োগ করতে হবে যাতে জমিতে ৫ সে.মি. গভীরতায় পানি থাকে। এরপর পানি কমতে কমতে যখন পানির স্তর পাইপের ভেতরে ২০ সে.মি. এর নিচে নেমে যাবে অথার্ৎ পাইপের তলার মাটি দেখা যাবে তখন আবার সেচ দিতে হবে। এ অবস্থায় আসতে মাটি ভেদে ৪—৮ দিন সময় লাগে। ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।

৪. ধানের ফুল আসার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত জমিতে সব সময় ২—৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এ সময়ে কোন অবস্থাতেই মাটিতে আদ্রতার ঘাটতি রাখা যাবে না।

৫. ধান কাটার ২ সপ্তাহ আগে সেচ বন্ধ করতে হবে।

 

অডউ পদ্ধতির সুবিধা :

১. ধান চাষ চলাকালীন সময়ে ৪—৫ টি সেচ সাশ্রয় করে।

২. এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে।

৩. জ্বালানী সাশ্রয় হয় প্রায় ৩০%।

৪. এ প্রযুক্তিতে মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং জমির জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয়।

৫. ফলন বৃদ্ধি পায় প্রায় ০.৫ টন/হেক্টর।

৬. এটি পরিবেশ বান্ধব কারণ ভূ—গর্ভস্থ পানি উত্তোলন কম হয় এবং মশা—মাছির উপদ্রব কম হয়। অডউ পদ্ধতির অসুবিধা :

১. জমি সমতল এবং পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।

২. পর্যবেক্ষণ পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

৩. অনেক সময় আগাছার উপদ্রব বেশি হয়।

 

সারাংশ

ঝজও পদ্ধতিতে পানি সেচ ব্যবস্থাপনা ধান চাষের একটি এমন কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যা ধানের ফলন বৃদ্ধি করে। এ পদ্ধিতে সেচ কম লাগে। জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও এ পদ্ধিতে সেচ কম লাগে। জমি পর্যায় ক্রমে ভেজানোও শুকানোর ফলে বায়ু চলাচল সুগম হয়। এপদ্ধতি কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ধান চাষে পর্যায়ক্রমিক ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিগুলো ধান ক্ষেতে প্রয়োজনমতো ও সময়মতো সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে। তবে জমি সমতল ও পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞান ও পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment