নাইলোটিকার চাষ পদ্ধতি বা নাইলোটিকা মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। নাইলোটিকার চাষ পদ্ধতি পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র এর ইউনিট-১ এর ১.৪ নম্বর পাঠ।
Table of Contents
নাইলোটিকার চাষ পদ্ধতি
নাইলোটিকা মাছ পরিচিতি:
আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল ছিল নীল তেলাপিয়া মাছের আদি নিবাস। সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই এ মাছ পাওয়া যায়। মাছটি চাষের উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড হতে আমাদের দেশে প্রথম আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে মাছটিকে নাইলোটিকা নামে ডাকা হয়। এটি আসলে নীল তেলাপিয়া এবং এই নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত যদিও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।এটি একটি শক্ত প্রকৃতির দ্রুত বর্ধনশীল মাছ। নদী, হ্রদ, পয়ঃনিষ্কাশন নালা, সেচ নালাসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাদুপানির জলাশয়ে মাছটি স্বাচ্ছন্দে বাড়তে পারে। মাছটি প্রায় সব ধরনের খাদ্য খায়।
কিশোর অবস্থায় এরা সর্বভূক; ফাইটোপ্ল্যাংকটন, জুপ্ল্যাংকটন ও পঁচনশীল জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় এরা ফাইটোপ্ল্যাংকটন এবং জুপ্ল্যাংকটন প্রধান খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে।
সম্পূরক খাদ্য দিয়েও মাছটি চাষ করা যায়। মাছটি ৮—৪২০ঈ তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে। নাইলোটিকা মাছ তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে ৩—৬ মাসে প্রজননক্ষম হয় বাচ্চা ফোটায় এবং কুসুমথলি মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বাচ্চাগুলো এরা মুখেই রাখে। উল্লেখ্য, স্ত্রী মাছ ২০০টি পর্যন্ত ডিম মুখে রাখতে পারে। মাছটি দেখতে ধূসর নীলাভ থেকে সাদা লালচে। পুরুষ মাছের গলার অংশের বর্ণ লালচে এবং স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে বর্ণ লালচে হলুদাভ। পৃষ্ঠ পাখনা কৃষ্ণবর্ণের মার্জিনযুক্ত এবং পুচ্ছ পাখনা সাদা বর্ণের সরু ও লম্বা দাগযুক্ত।
নাইলোটিকা মাছের বৈশিষ্ট্য ও চাষের সুবিধা:
(১) নাইলোটিকা মাছ বেশ শক্ত গড়নের হওয়ায় রোগবালাই তেমন হয় না।
(২) মাছটি সুস্বাদু এবং দেখতে আকর্ষনীয় হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
(৩) অধিক ফলনশীল হওয়ায় মাছটি চাষে অধিক লাভ হয়।
(৪) সর্বভূক বিধায় মাছ চাষে উৎপাদন খরচ অনেক কম।
(৫) প্রকৃতির বিরূপ পরিবেশে (যেমন— কম অক্সিজেন, বিরূপ তাপমাত্রা) সহনীয় ক্ষমতা বেশি।
(৬) জৈবিক ও কৃষিজ বর্জ্যকে উন্নত আমিষে রূপান্তরকরণে সক্ষম।
(৭) এ মাছের পোনা সহজেই পাওয়া যায়।
(৮) বেশি ঘনত্বে চাষাবাদ করা যায়।
(৯) স্বাদু ও লবণাক্ত পানি ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের জলাশয়ে চাষাবাদ করা যায়।
(১০) বিভিন্ন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। যেমন—একক, মিশ্র, সমম্বিত, খাঁচায় ও পেন পদ্ধতি ইত্যাদি।
নাইলোটিকা মাছের একক চাষ পদ্ধতি:
নাইলোটিকা মাছ চাষ করতে হলে নিচের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
১। নাইলোটিকা চাষের জন্য মজুদ পুকুর ব্যবস্থাপনা:
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি : বছরে ৬ মাস পানি থাকে এমন যে কোনো জলাশয়ে সফলভাবে নাইলোটিকা চাষ করা যায়। পুকুরের পানির গভীরতা ১.৫ মিটার থাকলে ভাল হয়। উল্লেখ্য, ৫ শতাংশ বা তার নিচের আকারের জলাশয়েও নাইলোটিকা মাছ চাষ করা যায়। নির্বাচিত পুকুরের পাড় ভাঙ্গা থাকলে তা মেরামত করতে হবে।
তলায় ৩০ সে.মি. এর বেশি কাদা থাকলে তা অপসরণ করতে হবে এবং তলা সমান করতে হবে যাতে জাল টানতে সুবিধা হয়। তাছাড়া তলার পঁচা কাদা অপসারণ করলে পানিতে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয় না। পুকুরে ভাসমান অথবা শিকড়যুক্ত সব ধরনের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
রাক্ষুসে মাছ দমন : টাকি, শোল, বোয়াল, চিতল, গজার প্রভৃতি হলো রাক্ষুসে মাছ। এরা চাষকৃত মাছের পোনা ও ডিম খেয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। তাই পুকুরে পোনা মজুদের আগে এসব রাক্ষুসে মাছ দমন করতে হবে। দুইভাবে কাজটি করা যেতে পারে। জাল টেনে অথবা ঔষধ প্রয়োগ করে। পুকুরে ঘন ঘন জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ দমন করা যেতে পারে। সম্পূর্ণভাবে দমন করা না গেলে পুকুর শুকিয়ে নেওয়া উত্তম। তবে ঔষধ প্রয়োগ করে কাজটি সহজেই করা যায়। এক্ষেত্রে ফসটক্সিন ও রোটেনন ব্যবহার করা যেতে পারে।
চুন ও সার প্রয়োগ: চুনের বাফার হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা আছে। পানির ঢ়ঐ পরীক্ষা করে চুন (ঈধঈড়৩) প্রয়োগ করা উচিত। উল্লেখ্য, কিছুটা ক্ষারীয় ঢ়ঐ মাছ চাষের জন্য উপযোগী। বাংলাদেশে অধিকাংশ পুকুরের পানির ঢ়ঐ ৯ থেকে ৯.৫ এর ভিতরে থাকায় তা মাছ চাষের জন্য বেশ সহায়ক। তবে ঢ়ঐ এর মাত্রা কোনো কারণে অম্লীয় হলে চুন ব্যবহার করতে হবে।
চুন প্রয়োগ করলে পানি পরিষ্কার হয় এবং রোগ জীবাণু ধ্বংস হয়। পুকুরে চুন দিলে সার তাড়াতাড়ি কাজ করে চুনের ডোজ শতাংশে ১ কেজি। বাজারে সচরাচর প্রাপ্ত পাথুরে চুন ব্যবহার করা হয়। চুন প্রয়োগের ৩ থেকে ৪ দিন পর শতাংশে ৩—৪ কেজি গোবর + ২ কেজি মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগ করতে হবে। এর এক সপ্তাহ পর শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া+ ৫০ গ্রাম ঞঝচ পানিতে গুলে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত ইউরিয়ার অর্ধেক পরিমাণে ঞঝচ সার দিতে হয়। সার প্রয়োগের ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে পানির রং সবুজাভ হলে পোনা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
২। নাইলোটিকা চাষের জন্য পোনা সংগ্রহ ও মজুদকরণ :
নির্ভরযোগ্য কোনো হ্যাচারি থেকে একটু বড় আকারের (৫—৭ সে.মি.) পোনা সংগ্রহ করতে হবে। উল্লেখ্য, বড় আকারের পোনার মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম। আধুনিক পদ্ধতিতে অক্সিজেন দিয়ে পোনা সংগ্রহ করতে হবে যাতে করে পোনার ওপর পরিবহনজনিত চাপ (ংঃৎবংং) না পড়ে। সংগৃহিত পোনা প্রতি শতাংশে ৬০ থেকে ৮০ টি করে মজুদ করতে হবে। পোনা মজুদের পূর্বে অবশ্যই পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করে নিতে হবে। পোনা মজুদের কাজটি সকালে করা ভাল। সকালের দিকে তাপমাত্রা কম থাকায় পোনার উপর তাপমাত্রাজনিত বিরূপ প্রভাব পড়ে না।
৩। নাইলোটিকা মজুদ পরবর্তি ব্যবস্থাপনা :
(ক) নাইলোটিকার পোনার পরিচর্যা :
নাইলোটিকা মাছ পুকুরের সব স্তরে বাস করে এবং সব ধরনের খাদ্য খায়। মজুদ মাছের মোট দৈহিক ওজনের শতকরা ৪—৬ ভাগ হারে চাউলের কঁুড়া, গমের ভূষি ও সরিষার খৈলের মিশ্রণ সকাল ও বিকালে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে। সরিষার খৈল পুকুরে প্রয়োগ করার অন্তত: ১২ ঘন্টা পূর্বে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
পুকুরের নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে পোনা ছাড়ার ৮ থেকে ১০ দিন পর থেকে সব ধরনের খাবার পুকুরে দেওয়া যায়। বাজার থেকে কেনা পিলেট খাবারও ব্যবহার করা যায় এক্ষেত্রে মাছ চাষের খরচ তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। খাদ্য হিসেবে রান্নাঘরের উচ্ছিষ্টও দেওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং মাছের গড় ওজনের সাথে মিলিয়ে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
(খ) নাইলোটিকার অতিরিক্ত পোনা সরানো :
নাইলোটিকা মাছ পুকুরের বদ্ধ পানিতে বাচ্চা দেয় এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর থেকে বছরে একাধিক বার বাচ্চা দেয়। সঙ্গত কারণেই পুকুর অতিরিক্ত পোনায় ভরে যায়। এর ফলে অধিক ঘনত্বে মাছ আশানুরূপ বড় হতে পারে না এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তাই জাল টেনে পোনার ঘনত্ব কমিয়ে ফেলতে হবে।
(গ) নাইলোটিকার অন্যান্য পরিচর্যা :
নাইলোটিকা মাছ খাবার ঠিকমত খাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি দেখা যায় সকালের দিকে মাছ পানির ওপরে হা করে শ্বাস নিচ্ছে তখন বুঝতে হবে পানিতে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় পুকুরে খাবার ও সার দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। এ সময় লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করে, ঘনঘন জাল টেনে অথবা পুকুরে নেমে সাঁতার কেটে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ্যারেটর ব্যবহার করেও কাজটি করা যেতে পারে।
(ঘ) নাইলোটিকা মাছ আহরন ও বাজারজাতকরণ :
নাইলোটিকা মাছ ৫ থেকে ৬ মাসে ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায়। এমন ওজনের মাছ টানা বেড় জাল দিয়ে বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে। আংশিক আহরণ পদ্ধতিতে শুধুমাত্র বড় মাছ গুলো ধরে জীবিত অবস্থায় বাজারে নিলে ভাল দাম পাওয়া যাবে। একবারের চাষে নাইলোটিকা মাছের উৎপাদন দাঁড়ায় বিঘা প্রতি ২৫০—৩০০ কেজি। তবে ব্যবস্থাপনা উন্নত করে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব।
নাইলোটিকা মাছের রোগ ব্যবস্থাপনা :
নাইলোটিকা মাছ অত্যন্ত শক্ত গড়নের হওয়ায় এর রোগবালাই তেমন একটা দেখা যায় না। তবে প্রতিকূল পরিবেশে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পেতে পারে। শীতের শুরুতে নাইলোটিকা মাছ লেজ ও পাখনা পঁচা, আঁইস খসে পড়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। তাই শীত শুরুর আগে শতাংশে ১ কেজি চুন পানিতে গুলে পুকুরে দিলে উপকার পাওয়া যায়। শীত মৌসুমের আগেই মাছ আহরণ করে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য ব্যবস্থাপনা রাজপঁুটি মাছের অনুরূপ।
সূত্র:
- নাইলোটিকার চাষ পদ্ধতি | ইউনিট ১ , পাঠ -১.৪ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র