পরিবেশ কৃষি ও খামার ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা সংরক্ষণ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পরিবেশ কৃষি ও খামার ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা সংরক্ষণ

পরিবেশ কৃষি ও খামার ব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা সংরক্ষণ

 

 

পরিবেশ কৃষি (Environmental agriculture)

কৃষি কর্মকান্ড একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে সংঘটিত হয়। পরিবেশ কৃষি হচ্ছে জীব পরিবেশ, ভৌত পরিবেশ, মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতা সংর ণ করে (বা কম তি করে) কৃষি উৎপাদনের প্রযুক্তি/ কৌশল/প্রক্রিয়া গ্রহণ ও উৎপাদনের উপকরণ (খাদ্য উপাদান, পানি, জৈব পদার্থ) সংগ্রহকরণ। অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা ও সামগ্রিক পরিবেশকে র । করে কৃষি উৎপাদন কৌশল গ্রহণ হলো পরিবেশ কৃষি ।

পরিবেশ কৃষির নীতিমালা

পরিবেশ কৃষির েত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কতগুলো নীতিমালা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে—

১। পরিবেশ দূষণে শূন্য বা কম প্রভাব

২। শূন্য বা খুব কম রাসায়নিক দ্রব্য (সার/কীটনাশক/ঔষধ) ব্যবহার

৩। কম বহি:সম্পদ ব্যবহার: সকল স্থানীয় সম্পদ (উদ্ভিদ, স্থলজ ও জলজ প্রাণী) ব্যবহার

৪ । বিভিন্ন জৈব ও সবুজ সার এবং বর্জ্য পুন:ব্যবহার।

পরিবেশ কৃষির প্রয়োজনীয়তা ( Rationale of environmental agriculture)

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক বৃষ্টি নির্ভর চাষাবাদ করেন যা অনিশ্চিত। জমির হ্রাসমান উর্বরতা ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতা কৃষি উৎপাদনে ঝুঁকি বাড়ায়। কৃষকের পুঁজিও খুব কম। কৃষির ফলনও আশানুরূপ হচ্ছে না। কৃষক ও কৃষির এ পরিবেশকে এক কথায় প্রান্তিক পরিবেশ (Marginal environment) বলা যায়।

তদুপরি অধিক রাসায়নিক দ্রব্য (সার/কীটনাশক) ব্যবহার করার ফলে জাপান ও আমেরিকার খাদ্যদ্রব্যে কীটনাশকের অবস্থিতি (Residue) সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। এ দেশের খাদ্য উৎপাদন ও সংরণের প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক দ্রব্য অবস্থিতি বিদ্যমান।

প্রান্তিক পরিবেশে ঘন বসতিপূর্ণ দেশে কৃষক দারিদ্র্যের দুর্বিসহ চক্রে আবদ্ধ। দারিদ্র্য হতে মুক্তি লাভ, কৃষির উৎপাদনশীলতা এবং মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য সংরণের জন্য পরিবেশ কৃষি অবশ্য প্রয়োজনীয়। কারণ একমাত্র এ কৌশল গ্রহণেই আমরা কৃষি পরিবেশকেও সংরণ করতে পারবো।

বিভিন্ন প্রকার পরিবেশ কৃষি

কৃষি পরিবেশের কম তি করে ও কৃষির উৎপাদনশীলতা বজায় রেখে বিগত দু’দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক গবেষণা প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন কৃষি কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

  • জৈব কৃষি (Organic farming)
  • জীব পরিবেশিক কৃষি (Ecological agriculture)
  • দীর্ঘস্থায়ী কৃষি (Substainable agriculture)
  • পুন:উৎপাদনশীল কৃষি (Regenerative agriculture)
  • বিকল্প কৃষি (Alternative agriculture)
জৈব কৃষি

এক ধরনের কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি যেখানে স্বাস্থ্যপ্রদ মাটি ও ফসল সংর ণ উৎসাহিত করা হয়। এজন্য জৈব পদার্থের খাদ্য উপাদান পুনঃচক্রায়ন, ফসল আবর্তন, সঠিক চাষাবাদ গ্রহণ এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করা হয়।

জীব-পরিবেশিক কৃষি

কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা যা কৃষি পরিবেশকে উন্নয়ন করে বা তিগ্রস্ত করে না। যেখানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার খুবই কম হবে, তবে বন্ধ হবে না।

দীর্ঘস্থায়ী কৃষি

স্থানীয় উপকরণ ভিত্তিক জীব-পরিবেশিক কৃষি যেখানে ফলনশীলতা সংরণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োগ করা হয়।

পুন:উৎপাদনশীল কৃষি

কৃষি উৎপাদন কৌশল যাতে স্থানীয় পুন:উৎপাদনশীল উপকরণ ব্যবহার ও পরিবেশ সংর ণকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

খামার উৎপাদনশীলতা সংরকখ

কৃষির বৈশিষ্ট্য

সহজ কথায় খামার উৎপাদনশীলতা সংর ণ অর্থ হচ্ছে খামারে দীর্ঘদিন উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা। ইতোমধ্যেই এ কথাটি পরিবেশ কৃষির আলোচনায় একটি উদ্দেশ্য রূপে এসেছে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীগণ বলেন, “কৃষি উন্নয়ন প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে যদি কৃষিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি বা সবগুলো বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে।” নির্দিষ্ট ছয়টি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিম্নরূপ-

  • কম খরচ (Inexpensive)
  • বিপণন যোগ্য (Marketable)
  • স্থায়ী (Permanent)
  • গ্রহণযোগ্য (Acceptable) সংর ণ প্রভাব (Conservation effect )
  • প্রযুক্তি উপযোগী (Technology response)

উপরের বৈশিষ্ট্যগুলোর ইংরেজি প্রতি শব্দের প্রতিটির প্রথম অ র দিয়ে IMPACT শব্দটি পাওয়া যায়। যার অর্থও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব।

কৃষি প্রযুক্তির

বৈশিষ্ট্য উপযুক্ত প্রযুক্তি গ্রহণ ছাড়া যুগ উপযোগী কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘস্থায়ী কৃষি উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী প্রযুক্তি (Sustainable technology) গ্রহণ অবশ্য প্রয়োজনীয়। কৃষি প্রযুক্তিতে নিম্নলিখিত ছয়টি গুণাবলী থাকলে তা দীর্ঘস্থায়ী প্রযুক্তি হবে। এগুলো হলো-

  • ঝুঁকি সহনশীল (Buffered against risks)
  • সময়ের প্রে ूিতে স্থায়ী (Stabilized against time)
  • জলবায়ুতে সমলয় (Synchronized with climate)
  • পরিবেশে স্বচ্ছন্দ (Harmonized with environment)
  • ভূমি য়িষ্ণুতায় সংবেদনশীল (Sensitive to soil degradation)
  • পরিবর্তনে উপযোগী (Responsive to change)

এখন বুঝা যাচ্ছে যে, দীর্ঘস্থায়ী কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী কৃষি উন্নয়ন অর্থাৎ খামার উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা সম্ভব। আর পরিবেশ কৃষির উদ্দেশ্য খামার উৎপাদনশীলতা বজায় রাখাসহ খামার পরিবেশের সকল অঙ্গ/উপাদান সংর ণ।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা

এবার সং েপে কী কী ব্যবস্থা/ প্রক্রিয়া / প্রযুক্তি ব্যবহার করে খামার উৎপাদনশীলতা এবং খামার পরিবেশ সংর ণ করা যায় তা আলোচনা করা হলো।

 

মাটি ব্যবস্থাপনা

কৃষিতে মানুষের পরেই মাটির স্থান। এ মাটির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির য়, দূষণ ও অনুর্বর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত পদপে গ্রহণ করা যেতে পারে ।

  • মাটির উপর উপযুক্ত ঘাস, গাছ, ফসল বা বৃ ের আচ্ছাদন র ণ ।
  • অযৌক্তিক মাটি কর্ষণ, ফসল উচ্ছিষ্ট পোড়ানো, অত্যধিক গোচারণ, বন উজাড়করণ ও অপরিকল্পিত মাটি কাটা পরিহারকরণ।
  • ঢালু মাটিতে বা পাহাড়ের ঢালের আড়াআড়ি বৃ, ফসল, গাছ ইত্যাদি লাগানো।
  • হাওড় বা অতি নিাঞ্চলে বসতবাড়ির ভূমি য় রোধ প্রযুক্তি গ্রহণ ।
  • ফসলী জমি হতে মাটি য় রোধ করণে মালচিং ও জৈব পদার্থ প্রয়োগ বৃদ্ধিকরণ।

পানি ব্যবস্থাপনা

পানি ছাড়া কোন উদ্ভিদ বা প্রাণীর বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি অসম্ভব। তাই প্রকৃতি হতে প্রাপ্ত পানির বিচ প ব্যবহার ও দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য নিম্নলিখিত পদপে নেয়া যেতে পারে-

  • ভূ-পৃষ্ঠের পানির আধারের সংখ্যা, আয়তন ও গভীরতা বৃদ্ধি করে প্রচুর বৃষ্টির পানি সংর ণ। এজন্য সামাজিকভাবে (গ্রাম / এলাকা ভিত্তিক) ভরাট প্রায় জলাশয়, বিল, খাল, ছোট নদী পুন:খনন করা উচিত।
  • ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে শুষ্ক মৌসুমে পানির তীব্র অভাব হচ্ছে। এ সময়ে যথাসম্ভব কম পানি লাগবে এরূপ ফসল আবাদকরণ। তাছাড়া মাটিতে পানি অধিক দিন ধরে রাখতে রবি শস্য বপন ও আচ্ছাদন ফসল জন্মানো ।
  • কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি, মাত্রা, সময় ইত্যাদি কঠোরভাবে মেনে চলা। েেতর পানি আটকে সার বা কীটনাশক প্রয়োগ।
  • পানিতে মল-মূত্র ও বর্জ্য বিসর্জন বন্ধকরণ।

অজৈব সার ব্যবস্থাপনা

সার ব্যবহার মাত্রা সুষম ও যৌক্তি হতে হবে যেন তা অব্যবহৃত থেকে বা চুইয়ে বা গ্যাস হয়ে পরিবেশ দূষণ করতে না পারে। এজন্য-

  • ইউরিয়া সার এক সাথে বেশি ব্যবহার না করে কয়েক বারে মাটির নিচে প্রয়োগ করতে হবে।
  • বেলে বা বেলে দো-আঁশ মাটিতে মিউরেট অব পটাশ (এমপি) সারও ইউরিয়ার ন্যায় প্রয়োগ করতে হবে। ফসফেটসহ অন্যান্য সার চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • মাটিতে সার প্রয়োগের অন্তত সাত দিন পর ফসল/বীজ/চারা বপন/রোপণ করতে হবে।
  • সার প্রয়োগের পর তের পানি অন্তত ১০ দিন আটকে রাখতে হবে।

ফসল ব্যবস্থাপনা

দেশের কৃষি কাজের বৃহৎ অংশই হলো নানাবিধ ফসল উৎপাদন। তাই ফসল নির্বাচন, উৎপাদন ও সংরণ কাজে সচেতন হওয়া প্রয়োজন যাতে পরিবেশ ও উৎপাদনশীলতা সংরতি হয়। এজন্য-

  • শুধু ধান উৎপাদনকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্য প্রয়োজনীয় ফসল নির্বাচন করে ফসল বৈচিত্রতা। আনয়নকরণ। এজন্য মিশ্র ফসল, আন্তঃফসল, রিলে ফসল, সাথী ফসল চাষ প্রভৃতি কৌশল গ্রহণ।
  • মাটির য়িষ্ণু উর্বরতা সংর ণের জন্য বর্ষ ফসলক্রমে ধানের পাশাপাশি পাট, ডাল, তৈলবীজ, সীম ফসল অন্তর্ভুক্তকরণ।
  • বোরো ধান আবাদে অতিরিক্ত দাঁড়ানো পানি না রেখে ছিপছিপে পানি রাখা উচিত। এতে পানি সংরণ করে মশক বৃদ্ধি হ্রাস করা যাবে।
  • ফসলে সবুজ সার এবং ধান, ডাল ও তৈলবীজ ফসলে জীবাণু সার (Biofertilizer) ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ ।
  • শুষ্ক মৌসুমে জমিতে অধিক দিন পানি ধরে রাখার কৌশল (মালচিং, আচ্ছাদন ফসল, সারিবদ্ধ ফসল, মিশ্র ফসল, বেড়া ফসল) অবলম্বনকরণ।
  • কম পানি দিয়ে ফসল চাষ কৌশল নিতে হবে।
  • স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ফল আবাদের সাথে মিশ্র ফসল ও ধৈঞ্চা আবাদ করে মাটির পানি ও উর্বরতা সংর ণ।
  • স্থানীয় জাতের বিভিন্ন ফসল আবাদ ধরে রাখা।

জৈব ব্যবস্থাপনা

জৈব বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। এগুলোর পরিকল্পিত সংগ্রহ, সংর ণ ও পচন কৃষি উৎপাদনের বিভিন্ন েেত্র বিপ্লব বয়ে আনবে। এজন্য-

  • সকল বর্জ্য বিজ্ঞানসম্মত নিয়মে সংরণ করে কম্পোস্ট উৎপাদন ও ব্যবহারকরণ। গোবর, ছাগল ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা সংরণ করে জৈব সার রূপে ব্যবহার।
  • অনেক বর্জ্য সরাসরি পশুপাখি বা মাছের খাদ্য রূপে ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
  • ফসলের অবশিষ্টাংশ ( তে রেখে সেখানেই মাটিতে মিশানো। জ্বালানির জন্য বিভিন্ন দ্রুত বর্ধনশীল বৃ বা ধৈঞ্চা বা পাট চাষ করা উচিত। ফসলের তের চারপাশে বা মাঝে মাঝে এগুলো লাগানো হয় ।
  • সমন্বিত কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি গ্রহণ করলে অনেক বর্জ্য সরাসরি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। যেমন— হাঁস-মুরগি ও মাছ চাষ, হাঁস-মাছ-ধান চাষ ইত্যাদি।
  • বিভিন্ন চাউল কলে প্রচুর ছাই পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন কচু, আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ আবাদে যথাযথ ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৷

 

 

  • পৌর এলাকা ও শিল্প এলাকার কঠিন বর্জ্যগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় পঁচিয়ে পুনরায় ফসলের জমিতে ব্যবহারকরণ পদপে গ্রহণ।
  • বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে জ্বালানি ও জৈব সার দুটোই একসাথে লাভ করা সম্ভব ।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version