পানি দূষণ

পানি দূষণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ২ নং ইউনিটের ২.৩ নং পাঠ।

 

পানি দূষণ

পানি দূষণ

জীবনের অপর নাম পানি। ধারণা করা হয় পানি থেকেই জীবনের উৎপত্তি। সুতরাং মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ অর্থাৎ জীবকূলের সকলের জন্যই পানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে সাগর মহাসাগরের ন্যায় বিশাল জলরাশি। আরও রয়েছে নদী, খাল, বিল, হ্রদ, ডোবা, পুকুর ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস। পানির এ সকল উৎস থেকেই মানুষ তার কল্যাণের জন্য পানিকে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও আজ এ কথা সত্য যে, মানুষ তার অপরিণামদর্শী ক্রিয়া—কর্ম দ্বারা পানির সকল উৎসকেই কলুষিত করে ফেলছে। আর এ দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে নানা প্রকার জটিল আন্ত্রিক রোগ দেখা দিচ্ছে।

পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা সংযুক্তিক বা বাহ্যিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে পানীয় বা অন্যান্য ব্যবহারিক কাজের অযোগ্য হলে বা ব্যবহারে ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সেই পানিকে দূষিত পানি বলে।যে কোন জলাশয়েরই নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সীমিত পরিমাপের বর্জ্য বা আবর্জনা পূণঃপ্রক্রিয়াজাতের (জবপুপষরহম) ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু যদি বর্জ্য ধারণক্ষমতা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় এবং পানি তার রং, বর্ণ কিংবা স্বাদ ইত্যাদি হারিয়ে ফেলে বা তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয় তবে তাকে পানি দূষণ বলে। অন্য কথায় পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা সংযুক্তিক বা বাহ্যিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে পানীয় বা অন্যান্য ব্যবহারিক কাজের অযোগ্য হলে বা ব্যবহারে ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সেই পানিকে দূষিত পানি বলে।

পানি দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ ,

 

পানি দূষণের উৎস :

পানি দূষণের বহুবিধ উপকরণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে নর্দমা বা পয়ঃপ্রণালী বাহিত আবর্জনা, জৈবিক ও অজৈবিক রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ক্ষতিকারক অণুজীব, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক, তৈল জাতীয় পদার্থ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

১। নর্দমা বা পয়ঃপ্রণালীর আবর্জনা :

শহর বা নগরাঞ্চলে পয়ঃপ্রণালীর ময়লা বা আবর্জনা আংশিক পরিশোধিত বা অপরিশোধিত অবস্থায় নদ—নদী, খাল—বিল, হ্রদ, সমুদ্র ও অন্যান্য জলাশয়ে অজৈব পদার্থে রূপান্তরিত হয় এবং পানিকে দূষিত করে।
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ৪৯০০০ কি. গ্রাম এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন ৪৫০০০ কিলোগ্রাম শিল্প কারখানা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর ফলে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী নদীতে অতিমাত্রায় দস্তা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডিয়াম এবং আরসেনিকের মতো ভারি ধাতুর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী ও তৎসংলগ্ন সাগরে পানিতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে।

 

২। শিল্প কারখানার আবর্জনা  :

বিভিন্ন শিল্প কারখানা, যেমনঃ বস্ত, কাগজ ও কাগজের মন্ড, রং, চিনি, সার, লৌহ জাতীয় ধাতব শিল্প, চামড়া ইত্যাদি থেকে নির্গত অপরিশোধিত আবর্জনা নদী, খাল ও অন্যান্য জলাশয়ে নিপতিত হয়ে পানির দষণ ঘটায়। এর ূ সাথে আরও যোগ হয় পেট্টো—কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, তেল শোধনাগার, ঔষধ কারখানা, রেয়ন কারখানা ও প্লাষ্টিক কারখানার আবর্জনাসমূহ। এসব আবর্জনায় সায়ানাইড, ফেনল, এ্যামোনিয়া প্রভৃতি বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য বিদ্যমান থাকে। এক সমীক্ষায় প্রকাশ ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ৪৯০০০ কি. গ্রাম এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন ৪৫০০০ কিলোগ্রাম শিল্প কারখানা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর ফলে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী নদীতেঅতিমাত্রায় দস্তা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডিয়াম এবং আরসেনিকের মতো ভারি ধাতুর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী ও তৎসংলগ্ন সাগরে পানিতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে।

 

৩। কৃষি কাজে ব্যবহৃত ঔষধ ও সার :

কৃষি ক্ষেত্রে ফলন বাড়াতে, ঘরবাড়ী ও শিল্প কারখানা থেকে পোকার আক্রমণ কমাতে অত্যধিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ও আগাছা দমনকারী ঔষধ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ব্যবহৃত এ সকল ঔষধ বৃষ্টি ও অন্যান্য পানির সাথে মিশে নদী বা সাগরের পানিকে দূষিত করছে। এসকল যৌগিক রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে উউঞ অত্যন্ত শক্তিশালী, স্থায়ী এবং ক্ষতিকর। কারণ উউঞ নিজস্ব কিংবা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙ্গে যায়না বা বিনষ্ট হয় না। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে এর প্রতিক্রিয়া বজায় থাকে।

 

৪। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য :

তেজস্ক্রিয় মৌল ব্যবহারজনিত শিল্প ও পারমাণবিক চূল্লী শীতল রাখার জন্য সর্বদা ঠান্ডা পানির প্রবাহ নিশ্চিত রাখা হয়। ব্যবহারান্তে এই পানি উত্তপ্ত অবস্থায় নদী বা অন্য কোনো জলাশয়ে পড়লে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।

 

৫। তেল জাতীয় দূষণ :

তেলের ট্যাঙ্কার, কলকারখানা থেকে বেড়িয়ে আসা তেল বা অন্য যে কোনো কারণে তেল নিঃসৃত হয়ে পানিতে পড়লে তা দূষিত হয়।

 

৬। ডিটারজেণ্ট :

বর্তমান যুগে কাপড় ধোয়ার পাউডার সামগ্রী যা ডিটারজেণ্ট নামে পরিচিত, জলজ পরিবেশে মিশ্রিত হয়ে দূষণ ঘটায়।

 

৭। জলজ উদ্ভিদ :

অনেক সময় জলজ উদ্ভিদ সমূহ পানি দূষণের জন্য দায়ী। এরা পুকুর বা জলাশয়ের ব্যবহার উপযোগিতা কমায়। ফলে অনেক সময় নাব্যতা, মাছ ধরা ও অন্যান্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

 

পানি দূষণের প্রভাব :

কীটনাশক দ্রব্য খাদ্য—শিকলে প্রবেশ করে মানবদেহে ক্যান্সার,স্নায়ুদ র্বলতা,লিকোমি য়া প্রভৃতি রোগের জন্ম দেয়। অনেক কীটনাশক বিশেষ করে  উঞর প্রভাবে ফাইটোপ্ল্যাংটনের সালোকসংশে­ষণ ক্ষমতা লোপ পায়।

 

১। নালা:

নর্দমার দূষিত পানি ব্যবহারে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় ম্যালেরিয়া প্রভৃতি রোগের সৃষ্টি করে। এই পানিতে জৈবিক দ্রব্যের জারণের ফলে প্রচুর H2 ব্যয়িত হয় এবং CO2 এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে পানিতে শৈবাল, অণুজীব ও ফাইটোপ্ল্যাংটনের আধিক্য ঘটে। পানিতে দ্রবীভূত ঙ২ এর স্বল্পতা মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও অনেক উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর।

 

২। কল কারখানার আবর্জনা:

কল কারখানার আবর্জনায় সায়ানাইড, ফেনল, এ্যামোনিয়া প্রভৃতি বিষাক্ত দ্রব্য থাকায় তা পানির অণুজীব ও অন্যান্য জীবের জন্য ক্ষতিকর। তদুপরি এগুলো খাদ্য—শিকলে প্রবেশ করেজীব দেহে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করে। ইলেকট্রোপ্লেটিং কারখানা হতে নির্গত ভারি ধাতু ও সায়ানাইড পানির ক্ষারত্ব ও অম্লত্ব বৃদ্ধি করে। কষ্টিক সোডা ও ক্লোরিন ফ্যাক্টরি হতে নির্গত আবর্জনায় পারদ জাতীয় দ্রব্যের প্রাচুর্য থাকে যা স্থলজ ও জলজ প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ।

পানি দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ ,

 

৩। কীটনাশক দ্রব্য খাদ্য :

শিকলে প্রবেশ করে মানবদেহে ক্যান্সার,স্নায়ু দূর্বলতা, লিউকামিয়া প্রভৃতি রোগের জন্ম দেয়। অনেক কীটনাশক বিশেষ করে উউঞর প্রভাবে ফাইটোপ্ল্যাংটনের সালোকসংশে­ষণ ক্ষমতা লোপ পায়। বহু জলজ প্রাণীর শুককীট ধ্বংস হয়। এনজাইম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবার কারণে পাখির গোনাড বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। ফলে ডিম্বস্ফুরণে বিলম্ব ঘটে। ডিমের ক্যালসিয়াম আবরণ ক্রমশ পাতলা হয়ে এক সময় ভ্রƒণের বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে পৃথিবী থেকে বহু প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে।

 

৪। পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বর্জ্য:

পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বর্জ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই তেজস্ক্রিয়তাজনিত বিপদ সৃষ্টি করে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের অনুপ্রবেশের ফলে শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে অনেক মাছের ডিম ফুটে পোনা বের হলেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও খাদ্যাভাবে মারা যায়। মাছের প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায়।

 

৫। তেল জাতীয় দুষণ:

তেল জাতীয় দুষণের ফলে পানির উপরে তেলের আস্তরণ পরে। আস্তরণের পুরুত্ব অবশ্য নিঃসৃত তেলের মাত্রার উপর নির্ভরশীল। কুয়েত ও ইরাকের যুদ্ধে প্রচুর তেল উপসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রচুর পাখি, মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এসময়ে ইরাকে বহু বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হয়েছে বলেও প্রকাশ।

 

৬। পানিতে ডিটারজেণ্টের উপস্থিতি:

পানিতে ডিটারজেণ্টের উপস্থিতি অণুজীবের বৃদ্ধি ঘটায় এবং ইউট্রফিকেশন প্রক্রিয়া তরান্বিত করে। পানি দূষণের প্রতিকার

যতদুর সম্ভব সমম্বিত পোকা—মাকড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গ্যাস ও জৈবিকসার  এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।

১। স্বাস্থ্য সম্মত পয়ঃপ্রণালী ব্যবহার করতে হবে। জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নর্দমা ও পয়ঃপ্রণালীর আবর্জনাকে জৈবিক সারে রূপান্তর করতে হবে।

২। পানি বিশুদ্ধ রাখতে হলে শিল্প কারখানার আবর্জনাকে যত্রতত্র ফেলা বন্ধ করতে হবে। এগুলো নিজস্ব প্রক্রিয়ায় জৈব নিধনযোগ্য উপাদান অথবা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত— করণের (জবপুপষরহম) ব্যবস্থা করতে হবে।

পানি দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ ,

৩। স্থায়ী/ অক্ষয়ী রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার যা খাদ্য—শিকলে প্রবেশ করে, নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যতদ র সম্ভব সমন্বিত পোকামাকড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা  অনুসরণ করতে হবে। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে গ্যাস ও জৈবিকসার এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।

৪। সতর্কতার সাথে তেজস্ক্রিয় পদার্থের অপসারণ করতে হবে এবং এজন্য উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৫। এছাড়া অনেক উদ্ভিদ নিজেরা দূষিত পদার্থ গ্রহণ করে পানিতে দূষণের মাত্রা কমাতে সক্ষম। যেমন ঃ কচুরী পানা পানিতে দ্রবীভূত ধাতুসহ বহু বিষাক্ত পদার্থ নিমূর্ল করতে সক্ষম।

 

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment