পানি সেচ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা , ইউনিট – ৩ , পাঠ – ৩.২ , পানি গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য উপাদন যা গাছের বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত। জমির প্রকৃতি, মাটির ধরন, আবহাওয়াগত কারণ এবং পানির প্রাপ্যতার উপর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ফসল জন্মায়। পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব। পানি ব্যবস্থাপনার মূল বিষয় হচ্ছে, সেচের পানির অপচয় না করে গাছের প্রয়োজনের সময় পরিমিত পরিমান পানি সঠিক পদ্ধতিতে গাছের মূলাঞ্চলে সরবরাহ করা এবং পানির অপচয় রোধ করা।
Table of Contents
পানি সেচ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা
সেচ পদ্ধতি :
ফসলের জমিতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়। এটি নির্ভর করে মাটির প্রকার, ভূ—প্রকৃতি, পানির উৎস, ফসল, মজুরি খরচ ইত্যাদির উপর। পানি সেচ পদ্ধতিকে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
১. ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি
২. ভূ—নিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি
৩. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতি
৪. ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি
১। ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি :
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় এই পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পানি উপর থেকে ঢালু নালা দিয়ে আবাদী জমিতে নেয়া হয়। ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
ক) প্লাবন সেচ পদ্ধতি
খ) নালা সেচ পদ্ধতি
গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি
ঘ) বাঁধ এবং নালা সেচ পদ্ধতি
ঙ) বৃত্তাকার বেসিন সেচ পদ্ধতি
ক) পাবন স্ন সেচ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে জমির চারপাশে আইল বেঁধে প্রধান নালার সাহায্যে ঢালুর দিকে পানি প্রবাহিত করা হয়। সাধারণত: ছিটিয়ে বোনা ফসল এবং গোখাদ্য ফসলে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। যেখানে অতি সহজে প্রচুর পানি পাওয়া যায় সেখানে এ পদ্ধতি উপযোগী।
সুবিধা
১. জমিতে সেচ দেয়া সহজ এবং দক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় না।
২. নালার জন্য জমির অপচয় কম হয়।
৩. এ পদ্ধতিতে পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।
৪. পানির প্রাপ্যতা সহজ হলে এ পদ্ধতি উপযুক্ত।
৫. ছিটিয়ে বোনা ফসলের জন্য এ পদ্ধতি বেশি উপযোগী।
অসুবিধা
১. পানির অপচয় বেশি হয়।
২. নিচু জায়গায় বেশি পানি জমা হয় এবং উঁচু জায়গা শুকনো থাকে।
৩. জমি সমান করতে খরচ বেশি হয় এবং ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা বেশি।
৪. পানির প্রতি সংবেদনশীল ফসলগুলো ঢালুর দিকে অতিরিক্ত পানির জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
খ) নালা সেচ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে সারিতে বপন বা রোপন করা ফসলে দুই সারির মধ্যবতীর্ নালায় পানি সরবরাহ করে সেচ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে দুই সারির মাঝখানে নালা তৈরি করা হয় যাতে উভয় পাশের ফসল পানি দিতে পারে। এ পদ্ধতিতে প্রধান নালা থেকে শাখা নালায় পানি সরবরাহ করা হয়। নালা পদ্ধতির মাধ্যমে সারিতে লাগানো ফসল যেমন আলু, আখ, বাদাম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ইত্যাদি এবং ফলগাছে সেচ দেয়া হয়।
সুবিধা
১. প্লাবন পদ্ধতির চেয়ে পানির অপচয় কম হয়।
২. পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না।
৩. সমস্ত জমি সমানভাবে সিক্ত হয়।
৪. জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না এবং ভূমি ক্ষয়ের সম্ভাবনা কম।
৫. অধিক পানির প্রতি সংবেদনশীল ফসলের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী।
অসুবিধা
১. জমি সমতল করা এবং নালা তৈরির জন্য প্রচুর অর্থ ও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
২. নালা তৈরির জন্য জমির অপচয় বেশি হয়।
৩. নালার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
৪. সকল ফসলের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী নয়।
গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে জমি প্রথমে সমতল করে নিয়ে চারপাশে উঁচু আইল তৈরি করা হয়। এরপর পার্শ্ববতীর্ প্রধান নালা থেকে
জমিতে সেচ দেয়া হয়। জমির আকার বড় হলে ঢাল অনুসারে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করা হয়। এরপর প্রতিটি খন্ডে
আলাদাভাবে সেচ প্রদান করা হয়। সুবিধা
১. এ পদ্ধতিতে পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।
২. পানির প্রাপ্যতা সহজ হলে এ পদ্ধতি উপযুক্ত।
৩. ছিটিয়ে বোনা এবং সারিতে লাগানো ফসলে সেচ দেয়া যায়।
অসুবিধা
১. পানির অপচয় বেশি হয়।
২. জমি সমান করতে খরচ বেশি হয়।
৩. আইল তৈরির জন্য জমির অপচয় হয়।
ঘ) বাঁধ ও নালা পদ্ধতি
জমি ঢালু হলে জমির ঢালের আড়াআড়িভাবে নালা কাটা হয়। এরপর সবচেয়ে উঁচু জায়গায় নালায় পানি ছেড়ে দিয়ে পযার্য়ক্রমিকভাবে সবগুলো নালায় পানি সরবরাহ করা হয়।
সুবিধা
১. পানির অপচয় কম হয়।
২. ঢালু জমিতে সেচ দেয়া যায়।
৩. সমস্ত জমিতে সমানভাবে সেচ দেয়া যায়।
৪. পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা নেই।
অসুবিধা
১. খরচ বেশি হয়।
২. নালা তৈরির জন্য জমির অপচয় হয়।
৩. সকল ফসলের জন্য উপযোগী নয়।
ঙ) বৃত্তাকার বা বেসিন সেচ পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ জমিতে সেচ না দিয়ে শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় পানি দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের গোড়ার চারিদিকে বৃত্তাকারে নালা কাটা হয়। প্রথমে প্রধান নালায় পানি সরবরাহ করা হয়। পরপর প্রধান নালা থেকে পানি শাখা নালার মাধ্যমে বৃত্তাকার নালায় প্রবেশ করে। সাধারণত বহুবর্ষজীবী বৃক্ষজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়।
সুবিধা
১। জমি ও পানির অপচয় কম হয়।
২। অসমতল ও ঢালু জমিতে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়।
৩। পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।
৪। মূলে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
অসুবিধা
১. অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিক প্রয়োজন।
২. নালা তৈরির জন্য প্রাথমিক খরচ বেশি।
৩. মাঠ ফসলের জন্য উপযোগী নয়।
২। ভূ—নিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি
মাটির নিচে বিশেষ ধরনের পাইপ বসিয়ে বা নালা কেটে গাছের শিকড়ে পানি সরবরাহ করার পদ্ধতিকে ভূ—নিম্নস্থ পানি সেচ পদ্ধতি বলে। ছিদ্রযুক্ত পাইপের পানি চুঁইয়ে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলকে ভিজিয়ে দেয়। সুবিধা
১. পানির অপচয় কম হয়।
২. মাটির শক্ত স্তর তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না।
৩. ভূমি ক্ষয় হয় না।
৪. জলাবদ্ধতার আশংকা কম।
অসুবিধা
১. নল বা পাইপ বসানোর জন্য প্রাথমিক খরচ বেশি।
২. শ্রমিক বেশি লাগে।
৩. মাঝে মাঝে পাইপ তুলে পরিস্কার করতে হয়।
৩. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতি:
যে পদ্ধতিতে পানি পাম্পের সাহায্যে উচ্চ চাপে নলের মধ্যে দিয়ে সরবরাহ করে বৃষ্টির আকারে জমিতে পড়ে তাকে ফোয়ারা বা বর্ষন সেচ পদ্ধতি বলে। নলের মুখে নজল লাগানো থাকে তাই পানি ফোয়ারার মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঢালু, খাড়া, পাহাড়ী, বেলে মাটিতে এবং অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
সুবিধা
১. যেখানে পানির প্রাপ্যতা কম সেখানে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়।
২. পাহাড়ী বা অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি উপযোগী।
৩. পানির অপচয় কম হয়।
৪. জমির অপচয় কম হয়।
৫. ভূমিক্ষয় হয় না জমি সমতল করার প্রয়োজন নেই।
অসুবিধা
১. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতিতে খরচ বেশি হয়।
২. অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের দরকার।
৩. কান্ড ও পাতা ভিজে যায় বলে উদ্ভিদের রোগের প্রকোপ হতে পারে।
৪. অপরিস্কার পানি নজলের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলে নজল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৪. ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি :
এ পদ্ধতিতে গাছের শিকড় অঞ্চলে ফেঁাটা ফেঁাটা করে পানি সরবরাহ করা হয়। এটি সেচের আধুনিকতম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের নলের সাহায্যে পানির অপচয় ছাড়াই ফেঁাটায় ফেঁাটায় গাছের গোড়ায় পানি সরবরাহ করা হয়। জমি সব সময় সিক্ত থাকে বলে গাছে কখনও পানির অভাব হয় না। যে সমস্ত অঞ্চলে পানির অভাব যেমন মরুভূমি, পাহাড়ী এলাকা এবং মাটি লবনাক্ত সে সমস্ত অঞ্চলে এ সেচ পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এ পদ্ধতিতে ফলগাছ এবং শাকসবজিতে সেচ দেয়া হয়।
সুবিধা
১. পানির অপচয় কম হয়।
২. সেচের পানির সাথে সারও প্রয়োগ করা যায়।
৩. পানির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়।
৪. শিকড় অঞ্চলের লবনের ঘনমাত্রা হ্রাস পায়।
৫. অসমতল বা ঢালু যে কোন জমিতেই সেচ দেয়া যায়।
অসুবিধা
১. প্রাথমিক খরচ বেশি।
২. মাঠ ফসলের জন্য উপযোগী নয়।
৩. দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
সেচের পানির কার্যকারিতা বৃদ্ধির উপায় ঃ
১. পানির অপচয় রোধ করে পরিমিত পরিমান সেচ দিতে হবে।
২. বিভিন্ন ফসলের বিভিন্ন সময়ে পানির প্রয়োজন। তাই ফসলের সেচ প্রদানের উপযুক্ত সময়ে সেচ দিলে সেচের পানির কার্যকারিতা বেশি হয়।
৩. জমির চারিদিকে ভালভাবে আইল দিয়ে সেচ দিতে হবে যাতে পানি বের না হয়ে যায়।
৪. সঠিকভাবে পানির উৎস হতে জমি পর্যন্ত সেচ নালার ঢাল দিতে হবে। অথার্ৎ সেচ নালা জমির দিকে ঢালু করে তৈরি করতে হবে।
৫. যথা সম্ভব পাকা নালা তৈরি করতে হবে।
৬. জৈব পদার্থ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমান জৈব পদার্থ যেমন পঁচা গোবর, কম্পোষ্ট ও সবুজ সার প্রয়োগ করতে হবে।
৭. সারিবদ্ধ ফসলে নালায় সেচ দিলে পানির অপচয় কম হয়।
৮. পানির বাস্পীভবন কমানোর জন্য বিকেল বা সন্ধ্যা বেলা সেচ দিতে হবে।
৯. ফসলের প্রকৃতি, জমির ঢাল, মাটির বুনট, পানির প্রাপ্যতা, লবনাক্ততা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে।
১০. স¯প্রতি সেচের পানির সরবরাহজনিত অপচয় রোধের জন্য পলিথিন নির্মিত ফিতা পাইপ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। কাঁচা নালার তুলনায় এটি ৫০—৬০ ভাগ পানির অপচয় রোধ করে।
সারাংশ:
পানি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি সমভাবে শিকড় এলাকায় সরবরাহ করা। সেচ পদ্ধতি মাটির প্রকার ও ভূমির ঢাল, ফসলের প্রকৃতি, পানির উৎস কৃষকের আর্থিক সংগতি এসব বিবেচনা করা হয়। সেচ পদ্ধতি প্রধানত: চারভাগে ভাগ করা হয়; (১) ভূপৃষ্ঠের সেচ পদ্ধতি, (২) ভূনিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি, (৩) ফোয়ারা পদ্ধতি, (৪) ড্রিপ বা ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি। আবার ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে (ক) প্লাবন পদ্ধতি, (খ) নালা পদ্ধতি, (গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি, (ঘ) বাঁধ ও নালা পদ্ধতি, (ঙ) করোগেশন সেচ পদ্ধতি, (চ) বৃত্তাকার সেচ পদ্ধতি।