পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা

পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ৬ নং ইউনিটের ৬.১ নং পাঠ। পোল্ট্রি যে কোন গৃহপালিত পাখিকে ডিম ও মাংস উৎপাদন এবং অর্থ উপার্জনের উদ্দশ্যে পরিকল্পিতভাবে পালন করা হলে তাকেপোল্ট্রি বলে। যেমন— মুরগি, হাঁস, টার্কি, কবুতর ইত্যাদি। এরা মানুষের তত্ত্বাবধানে মুক্তভাবে বংশবিস্তার করে থাকে।পোল্ট্রি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে নিম্নোক্ত কয়েকটি পরিভাষার (ঞবৎসরহড়ষড়মু) সঙ্গে পরিচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক।

পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা | ইউনিট-৬ , পাঠ -৬.১ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

১. পোল্ট্রির জাত :

পোল্ট্রির কোন একটি দলের মধ্যে একই ধরনের আকার, ওজন ও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে জাত বলে।পোল্ট্রির একই শ্রেণিতে দৈহিক আকৃতি বা পৃথক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে জাত ভাগ করা হয়েছে।

২. পোল্ট্রির উপজাত :

পোল্ট্রির একই শ্রেণির মধ্যে পালকের রং, ঝুঁটি ও অন্যান্য দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে উপজাতে ভাগ করা হয়েছে।

৩. বেবি চিক (ইধনু পযরপশ):

মুরগির নবজাতক ছানা বা একদিন বয়সের বাচ্চাকে বেবি চিক বলে।

৪. পুলেট :

এক বছরের কম বয়সি মুরগিকে পুলেট বলে। এ বয়সে পুলেট ডিম দেয়া আরম্ভ করবে অথবা প্রথমবারের মতো ডিম দেয়া শুরু করেছে। আমাদের দেশে এই বয়সের মুরগিকে অনেক অঞ্চলে ডেকি মুরগি বলে।

৫. মোরগ:

এক বছর বা ততোধিক বয়সের পুরুষ মুরগি যারা যৌন প্রজননে সক্ষম তাদেরকে মোরগ বলে।

৬. ব্রয়লার :

অল্প সময়ে নরম ও সুস্বাদু মাংস উৎপাদনের জন্য দুটি মাংসল জাতের মোরগ মুরগির মিশ্রণে বিশেষভাবে সৃষ্ট মুরগিকেই ব্রয়লার বলে। ব্রয়লার মুরগি সাধারণত ৪—৫ সপ্তাহ পালনের পর বাজারজাত করা যায়।

৭. লেয়ার :

বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত মুরগিকেই লেয়ার বলে। লেয়ার খামারে মোরগ পোষার প্রয়োজন হয় না। একেকটি উন্নত জাত/উপজাত/স্ট্রেইনের লেয়ার বছরে ২৫০—৩৩০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে সক্ষম।

৮. ব্রিডার :

লেয়ার, ব্রয়লার ও শোভবর্ধনকারীপোল্ট্রির বাচ্চা ফোটানোর লক্ষ্যে ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত বাছাই করা প্রজননে সক্ষম স্ত্রী ও পুরুষপোল্ট্রিকে ব্রিডার বলে।

পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা ,ইউনিট-৬ , পাঠ -৬.১

পোল্ট্রির গুরুত্ব :

দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা নিরসনকল্পেপোল্ট্রি, বিশেষ করে হাঁস—মুরগি, শুধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই পালন করে না বরং এরা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।পোল্ট্রি পালন ও উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম, দ্রুত ডিম ও মাংস পাওয়ার নিশ্চয়তা, দ্রুততার সাথে ব্যবসায়িক ফল লাভ, মাংসে সীমিত চর্বির উপস্থিতি, হজমে সুবিধা, সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমভাবে সমাদৃত বলেইপোল্ট্রি মানুষের পুষ্টি যোগানোর জন্য আদর্শ এবং মানসম্পন্ন উপাদান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।পোল্ট্রির গুরুত্ব নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো:

১. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেপোল্ট্রি পালনের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের সাধারণ জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

২.পোল্ট্রি শিল্প স্থাপনে প্রাথমিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

৩. অন্যান্য শিল্পের তুলনায়পোল্ট্রি খামার স্থাপনে প্রাথমিকভাবে স্বল্প মূলধনের প্রয়োজন হয় ।

৪.পোল্ট্রি পালনের জন্য তেমন কোন জমির প্রয়োজন হয় না, কাজেই ইচ্ছে থাকলে বসতবাড়িতে, এমনকি ঘরের উঠানে, বারান্দা বা ঘরের ছাদ এবং পুকুরের উপরে পালন করা যায়।

৫.পোল্ট্রির খামার থেকে স্বল্পতম সময়ে অর্থ বিনিয়োগ থেকে অর্থ প্রাপ্তি সম্ভব। কারণ হলো হাঁস—মুরগি ৫—৬ মাস বয়স হলেই ডিম দেওয়া শুরু করে এবং ব্রয়লার মুরগি ৪—৫ সপ্তাহ বয়সেই মাংসের জন্য বিক্রয় উপযোগী হয়।

৬. মুরগির ডিম ও মাংসে পুষ্টি উপাদান গরুর দুধের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। মাত্র একটি ডিম থেকে দুই গ্লাস দুধের সমান পুষ্টি পাওয়া যায়।পোল্ট্রি

শিল্পের বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি ছোট উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর মানচিত্রে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। এই দেশের ২১.৮% লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। এ দেশের প্রায় ১১.০% মানুষ তীব্র পুষ্টিহীনতার মধ্য দিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে। খাদ্য হিসেবে মাথাপিছু প্রতিদিনের প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা কমপক্ষে হওয়া প্রয়োজন ৬২ গ্রাম।পোল্ট্রি পালন মূলত শুরু হয় প্রাচীনকাল থেকেই। মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ফলে এদের সম্পর্কে সহজেই পরিচিত হতে পেরেছে।

এদেশে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাণিজ্যিকভিত্তিতেপোল্ট্রি পালন শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে গত ২০ বছর পূর্বেও সরকারি কিছুপোল্ট্রি খামার ছাড়া বেসরকারিভাবে তেমন কোন ধরনেরপোল্ট্রি খামার ছিল না, তবে প্রতিটি বাড়িতে ১০—১২টি মোরগমুরগি এবং হাঁস পালন করা হতো ডিম ও মাংসের জন্য।

কিন্তু বিগত ২০ বছরে এ অবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।পোল্ট্রি আর সেই গুটিকয়েক মুরগি বা হাঁসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এদেশে হাজার হাজার মানুষ বর্তমানে শহর, গ্রাম এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেওপোল্ট্রি খামার গড়ে তুলেছে। বর্তমান সময়ে হাঁস—মুরগি বাপোল্ট্রি শিল্প জনগনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং এ শিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে।পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় পেশা হওয়ায় অন্যতম প্রধান কারণ হলো এ শিল্পে স্বল্প পুঁজি ও অতি অল্প সময়ে লাভ করা যায়।

পোল্ট্রি ১ 1 পোল্ট্রির ধারণা, বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা

পোল্ট্রি শিল্পের সমস্যা :

বর্তমানেপোল্ট্রি শিল্প আলোর পথে হাটলেও এর পিছনে কিছু অন্ধকার এখনও রয়েছে।পোল্ট্রি শিল্পের সমস্যাগুলো নিচে তালিকাভুক্ত করা হলো।

১.পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে সঠিক গুণগত মানের বাচ্চা না পাওয়া।

২. বেবি চিক—এর অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি। হ্যাচারি মালিকগণ অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য প্রায়শঃই বাচ্চার দাম বৃদ্ধি করেন যা সাধারণ খামারিদের জন্য অস্বস্তিকর।

৩. খাদ্য সংকট এবং এর অধিক মূল্যবৃদ্ধি। বর্তমানেপোল্ট্রি খাদ্যের ঘাটতি সারা বিশ^জুড়ে। বাংলাদেশেওপোল্ট্রি খাবারের ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া কিছু ব্যবসায়ী তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে খাবারের দাম বৃদ্ধি করেন।

৪. অপর্যাপ্ত টিকাদান কর্মসূচিপোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম অন্তরায়।

৫. অপর্যাপ্ত প্রাণি চিকিৎসক এবং দক্ষ পালনকারী এই শিল্পের বাধা হয় কখনও কখনও।

৬. মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাও এই শিল্পের বাজারজাতকরণের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

৭. অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এই শিল্পকে বাধাগ্রস্থ করছে নিয়মিতভাবে। বেকার যুবক—যুবমহিলাদের যদি সঠিকভাবেপোল্ট্রি পালন এবং বাজারজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে এই শিল্প উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করবে।

 

পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনা :

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এই দেশে বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষিত যুবক—যুবমহিলা বেকার। স্বল্পসংখ্যক সরকারি চাকুরির পিছনে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার মেধা, শ্রম এবং অর্থ অপচয় করে আসছে। কখনও কখনও তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে হারাচ্ছে সহায় সম্বল সবকিছু। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠির জন্যপোল্ট্রি শিল্প হয়ে উঠতে পারে একটি আদর্শ আত্মœকর্মসংস্থানের জায়গা। বর্তমানে অনেক গ্রামাঞ্চলে, শহরে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠছে ব্রয়লার ও লেয়ার খামার। এসব খামার গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে পযার্প্ত পরিমাণ ডিম ও মাংসের চাহিদা।

একজন সুস্থ্য মানুষের প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংস এবং সপ্তাহে কমপক্ষে ২টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে এত খামার হওয়ার পরেও আমরা এই বিশাল জনগোষ্ঠির পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে পারছি না। তবে আশার কথা হলো এই যে, পূর্বের তুলনায় বর্তমানে পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশে নিশ্চিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

মুরগি ছাড়াওপোল্ট্রির অন্যান্য প্রজাতি, যেমন— টার্কি, হাঁস, কোয়েল ইত্যাদির মাংসল জাত উদ্ভাবনে বিজ্ঞানিরা নিরলশ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বর্তমানে শিক্ষিত যুবকেরা এই শিল্পে আগ্রহী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নোক্ত কয়েকটি উল্লেখ করা হলো—

 

পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করার পুঁজি:

ব্যবসা শুরু করার জন্য তুলনামূলক ভাবে অল্প পুঁজির প্রয়োজন হয়। এই শিল্পের জন্য অধিক জায়গার দরকার হয় না। একটি ঘর তুললেই হয় বা কখনও কখনও একাধিক ঘরের প্রয়োজন হতে পারে। অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় এতে মুনাফা তুলনামূলক বেশি হয়। মূলধনসহ মুনাফা অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় এখানে তাড়াতাড়ি উঠে আসে। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বেবি চিক—এর সহজলভ্যতা এই শিল্পের একটি আকর্ষণীয় দিক যদিও মাঝে মাঝে অধিক দাম দিতে হয়। জৈব নিরাপত্তায় আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন যে কারণে রোগ বালাই কম হয়।

 

Leave a Comment