আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা। এটি কৃত্রিম প্রজনন ও খামার স্থাপন এর গাভীর জাত উন্নয়ন ইউনিটের অন্তর্গত।
Table of Contents
গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা
গাভী থেকে সুস্থ সবল বাছুর পেতে হলে পাল দেওয়ার পর থেকে শুরু করে বাচ্চা প্রসবের পর পর্যন্ত সময়টুকুতে সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হয় । সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে গাভী ও বাছুরের মাকে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে । ফলে গাভী পালন লাভজনক না হয়ে লোকসানে পর্যবসিত হতে পারে ।
গর্ভকালীন গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা (Care and management of cow during pregnancy)
গাভীর গর্ভধারণকাল গড়ে ২৮০ দিন । প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেভাবেই পাল দেওয়া হোক না কেনো কখন পাল দেওয়া হয়েছে সেই সময়টি মনে রাখতে হবে এবং প্রতিটি গাভীর স্বাস্থ্যরেকর্ড পরীক্ষার মাধ্যমে গাভী গর্ভধারণ করেছে কিনা এই বিষয়টিও নিশ্চিত হতে হবে। দুগ্ধবতী গাভীর ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ৬ মাস পর্যন্ত যত্ন, পরিচর্যা, খাদ্য সরবরাহ ও দুধ দোহন স্বাভাবিকভাবেই চলবে । ছয় মাসের উর্ধ্বে গর্ভবতী গাভীকে দৈনিক খাদ্যের অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য দিতে হবে ।
গাভীর ওজন ২০০-৩০০ কেজি হলে ০.৫-১.০ কেজি, ৩০০-৪০০ কেজি হলে ১.০-১.৫ কেজি এবং ৪০০-৫০০ কেজি হলে ১.৫-২.৭৫ কেজি দানাদার মিশ্রণ দিতে হবে । বয়সভেদে অতিরিক্ত এই খাদ্য চাহিদাকে প্রেগনেন্সি এ্যালাউন্স (Pregnancy allowance) বলে ।
গর্ভবতী গাভীকে এই বয়সে খাদ্য প্রদানে যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে তা হলো— (ক) গাভীর কোনভাবেই চর্বি জমতে দেওয়া যাবে না এবং (খ) দানাদার মিশ্রণের সাথে প্রয়োজন মোতাবেক ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । তবে বকনা বাছুরের ক্ষেত্রে পাল দেওয়ার পর থেকেই সুষম খাদ্য সঠিক পরিমাণে সরবরাহ করা উচিত । কারণ এই সময় গর্ভের বাচ্চা ও বকনা বাছুরের শরীরের বৃদ্ধি একই সাথে ঘটে থাকে ।
গর্ভবতী বকনা বা গাভীকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা উচিত । গর্ভাবস্থায় বকনা বা গাভী যেনো প্রচুর পরিমাণ পরিষ্কার পানি খেতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে । সারণি ১.২-এ ৬ মাসের অধিক গর্ভবতী গাভীর খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো ।
সারণিঃ৬ মাসের অধিক গর্ভবতী গাভীর ওজন ও দুধ উৎপাদনের ভিত্তিতে দৈনিক খাদ্য চাহিদা
দৈনিক খাদ্য চাহিদা (কেজি) | |||||
গাভীর ওজন (কেজি) | দুধ উৎপাদন (কেজি) | আঁশ জাতীয় খাদ্য (কাঁচা ঘাস/খড়) | দানাদার খাদ্য | ||
গর্ভবতী নয় | গর্ভবতী ৬ মাসের অধিক | গর্ভবতী নয় | গর্ভবতী ৬ মাসের অধিক | ||
৩০০ | ২.০ | ৩৬.০/৯০ | ৩০.০/৭.৫০ | ১.০০ | ১.৫০ |
৪০০ | ২.০ | ৪০.০/১০.০ | ৩৬.০/৯.০ | ২.০০ | ৩.৫০ |
কাঁচা ঘাস এবং শুকনো খড়ের মিশ্রণ আনুপাতিক হারে সরবরাহ করতে হবে । সাধারণত চার কেজি কাঁচা ঘাস মোটামুটিভাবে এক কেজি শুকনো খড়ের সমতূল্য ।
দানাদার মিশ্রণ সব সময় সহজ লভ্য ও সস্তা খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করতে হবে । তবে এ জন্য পুষ্টি মাত্রার ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না । দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ তৈরির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপকরণের ব্যবহারিক মাত্রার একটি হিসাব নিচে দেয়া হলো ।
খাদ্যের নাম | গঠন (শতকরা হার) |
ক. দানাদার খাদ্য (গম/ভূট্টা/খেসারি ভাংগা) | ১৫-২৫ |
খ. ভূষি ও কুড়া (গম/চাল/খেসারি) | ৪৫-৫৫ |
গ. খৈল (তিল/নারিকেল/তুলা বীজ) | ১৫-২০ |
ঘ. মাছের গুড়া/সয়াবিন মিল | ৪ – ৫ |
ঙ. খনিজ ও লবণ (লবণ ১.০% এবং হাড়ের গুড়া/লাইম স্টোন পাউডার/ঝিনুকের পাউডার/ডিমের খোসার পাউডার ইত্যাদি ৩-৪%) | ৪ – ৫ |
প্রসবের প্রায় দু’সপ্তাহ পূর্ব থেকে বকনা বা গাভীকে একটু বড় ধরনের ঘরে পৃথকভাবে খোলা অবস্থায় রাখতে হবে । প্রতিদিন হাঁটাচলার ব্যবস্থা করতে হবে । পরিষ্কার নরম বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে । খেয়াল রাখতে হবে গর্ভাবস্থায় যেন কোনোভাবেই বকনা বা গাভী উত্তেজিত না হয় বা আঘাত না পায় । গরম হওয়া গাভী বা ষাঁড় যেন গর্ভবতী বকনা বা গাভীর উপর লাফ না দেয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে । এই সময় বকনা বা গাভীর খাদ্যের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে হবে । পায়খানা পরিষ্কার ও শরীর ঠান্ডা থাকে এ জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
প্রসবকালীন গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা (Care and management of cow during parturition)
প্রসবের কিছু সময় পূর্ব থেকেই গাভীতে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে যেমন— ওলান ফুলে যায়, ভালভা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৬ গুণ বেশি ফুলে যায় এবং লেজের গোড়ার দিকে রস বের হতে থাকে । এই সময় গাভীকে প্রসূতি ঘরে নেওয়া উচিত । প্রসূতি ঘর পরিষ্কার ও জীবাণুমক্ত হতে হবে এবং আলো-বাতাস চলাচলের ও ভালো বিছানার ব্যবস্থা থাকতে হবে । আবার বর্ষাকাল এবং শীতকাল ব্যাতিত অন্য সময়ে খামারের কাছাকাছি পরিষ্কার, ছায়াযুক্ত এবং ঘাস আছে এমন স্থানেও নেওয়া যেতে পারে । প্রসবের সময় গাভীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে ।
সাধারণত প্রসবের লক্ষণ প্রকাশ পাবার ১ থেকে ২ ঘন্টার মধ্যেই বাচ্চা প্রসব হয়ে থাকে । কিন্তু যদি প্রসব ব্যাথা শুরু হওয়ার ৪ ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা প্রসব না হয় তবে পশু চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত । স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে সাহায্য ছাড়াই গাভী সাধারণত বাচ্চা প্রসব করে থাকে । তবে অনেক সময় হাত দিয়ে সামান্য সাহায্য করতে হয় । প্রসবের শুরুতেই বাচ্চার সমনের পা বেরিয়ে আসে, এরপর আসে নাক ( চিত্র ) । যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই জরুরী ভিত্তিতে পশু চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত ।
প্রসবোত্তর গাভীর যত্ন ও পরিচর্যা (Care and management of cow after parturition)
- বাচ্চা প্রসবের পরপরই নিমপাতা বা পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এর কিছু দানা সহযোগে পানি গরম করে গাভীর জননতন্ত্রের বাইরের অংশ, ফ্লাংক (Flank) এবং লেজ পরিষ্কার করতে হবে ।
- গাভীর যাতে ঠান্ডা না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
- বাচ্চা প্রসবের পরপরই গাভীকে হালকা গরম পানি বা এধরনের পানি দিয়ে গুড়ের সরবত তৈরি করে খাওয়ানো ভালো ।
- গাভী যাতে নবজাতক বাছুরকে চাটতে পারে এজন্য বাছুরকে গাভীর কাছে যেতে দিতে হবে ।
- প্রসবের পরপরই গাভীকে আংশিকভাবে দোহন করতে হবে ।
- সাধারণত প্রসবের ২-৪ ঘন্টার মধ্যেই গর্ভফুল (Placenta) বের হয়ে যায় । যদি ৮-১২ ঘন্টার মধ্যেও গর্ভফুল বের না হয় তবে গাভীকে আরগট মিশ্রণ (Ergot mixture) খাওয়ানো যেতে পারে । ১২ ঘন্টার পরেও গর্ভফুল বের না হলে পশুচিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত।
- গর্ভফুল বের হওয়ার সাথে সাথে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে । গাভী যেনো গর্ভফুল না খেয়ে ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত ।
- দুধজ্বর ও ম্যাস্টাইটিস রোগের সম্ভাবনা কমাবার জন্য বাচ্চা প্রসবের পর ১-২ দিন পর্যন্ত গাভীকে সম্পূর্ণভাবে দোহন না করাই ভালো । বাছুরকে কাচলা দুধ বা কলস্ট্রাম খাওয়ানোর জন্য ওলানের বাট চুষতে দিতে হবে ।
- গাভীকে প্রথমত হালকা গরম পানিতে গমের ভূষি ভিজিয়ে খেতে দিতে হবে। একইসাথে অল্পপরিমাণ কাঁচা ঘাসও খাওয়ানো যেতে পারে। বাচ্চা প্রসবের ২ দিন পর থেকে গাভীকে দানাদার খাদ্য খাওয়ানো শুরু করতে হবে ।
- দানাদার খাদ্যের পরিমাণ এমনভাবে বাড়াতে হবে যাতে বাচ্চা প্রসবের ১৫ দিন পর থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা যায় ।
সারমর্ম
সুস্থ-সবল বাচ্চা পেতে এবং গাভীকে রোগমুক্ত ও অধিক উৎপাদনশীল রাখতে হলে গর্ভাবস্থায় প্রসবের সময় এবং প্রসবের পর বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় গাভীকে | আরামদায়ক বাসস্থান ও উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে । প্রসবের সময় গাভীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে পশুচিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে । প্রসবের পর গাভীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও গরম রাখতে হবে। গর্ভফুল বের হওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । নিয়মমাফিক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১। সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন ।
ক.সাধারণত প্রসবের কতো ঘন্টার মধ্যে গর্ভফুল বের হয়ে আসে?
i. ৫-৬ ঘন্টা
ii. ২-৪ ঘন্টা
iii. ৭-৮ ঘন্টা
iv. ৮-১২ ঘন্টা
খ. প্রসবের সময় বাচ্চার শরীরের কোন্ অংশ প্রথম বের হয়ে আসে?
i. মাথা
ii. পেছনের পা
iii. সামনের পা
iv. নাক
২। সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন ।
ক. গর্ভবর্তী বকনা বা গাভীকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস জাতীয় খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ কম পরিমাণে সরবরাহ করা উচিত ।
খ. প্রসবের দুসপ্তাহ পূর্ব থেকে বকনা বা গাভীকে পৃথকভাবে রাখা উচিত ।
৩। শূণ্যস্থান পূরণ করুন।
ক. প্রসবের কিছুসময় পূর্বে গাভীর ভালভা —— যায়।
খ. গর্ভাবস্থায় গাভীকে প্রচুর পরিমাণ পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ ——— খাওয়াতে হবে ।
৪। এক কথায় বা বাক্যে উত্তর দিন ।
ক. ৮-১২ ঘন্টার মধ্যেও গর্ভফুল বের না হলে গাভীকে কী খাওয়ানো উচিত?
খ. গর্ভাবস্থার কোন্ পর্যায় থেকে গাভীর দুধ দোহন বন্ধ করে দিতে হবে?