ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

 

ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

 

ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

সব ফসলের ফলন বা উৎপাদিত পণ্য যেমন একরকম নয়, তেমনি এদের পরিপক্কতার ধরনও ভিন্ন। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দ্বারা এদের পরিপক্কতা নিরূপিত হয়। গাছের বিভিন্ন অংশ ফলন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে যেমন- বীজ, আঁশ, কান্ড, পাতা, রূপান্তরিত কান্ড, ফল ইত্যাদি। ভাল ফলন পেতে হলে সময়মত ফসল সংগ্রহ করা উচিত। তা না করা হলে ফসলের গুণগত মান এবং ফলন উভয়ই তিগ্রস্থ হয়।

ফসলের পরিপক্কতা দু’রকমের হতে পারে- দেহতাত্ত্বিক পরিপক্কতা ও ব্যবহারোপযোগী পরিপক্কতা। একটি পাট গাছের ফল না পাকা পর্যন্ত তার দেহতাত্ত্বিক পরিপক্কতা এসেছে বলে গণ্য করা যাবে না। পাটের আঁশ যেখানে মুখ্য ফলন সেেেত্র তার ব্যবহারোপযোগী পরিপক্কতা অনেক আগেই – অর্থাৎ ফুল ধরা অবস্থায়ই চলে আসে।

অন্য দিকে আলু বা পিয়াজ গাছ পরিণত বয়সে শুকিয়ে যেতে শুরু করলে ধরা যেতে পারে এদের দেহতাত্ত্বিক পরিপক্কতা এসে গেছে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত এসব গাছ মরে পুরোপুরি শুকিয়ে না যায় বা মাটির আর্দ্রতা ভীষণভাবে না কমে আসে ততদিন এদের ব্যবহারোপযোগী পরিপক্কতা এসেছে বলে ধরা ঠিক হবে না। কারণ এদেরকে আগেই সংগ্রহ করা হলে এদের সংর ণ গুণাবলী অনেকাংশে কমে যায়।

ফসল সংগ্রহ (Harvesting)

সংজ্ঞা : ব্যবহারোপযোগী অবস্থায় ফসলের ফলন বা উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াকে ফসল সংগ্রহ বলে।
ফসল সংগ্রহের সময় যে উদ্দেশ্যেই ফসল উৎপাদন করা হোক না কেন উপযুক্ত সময়ের আগে বা পরে ফসল সংগ্রহ করলে বিভিন্নভাবে ফলন তিগ্রস্থ হয়।

অতি মাত্রায় পরিপক্কতার জন্য ধান বা গমের শীষ ভেঙ্গে পড়ে অথবা বীজ ঝরে পড়ে। খেসারী, মসুর, ছোলা, সরিষা, তিল, তিসি, ইত্যাদির বেলায় ফল (পড) ফেটে যায় এবং বীজ ঝরে পড়ে। তাছাড়া অতিপরিপক্ক ফসল মাঠে বেশি দিন থাকার জন্য পাখি এবং চোরের উপদ্রবও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কম পরিপক্ক বা অপরিপক্কতার জন্য ফসলের ফলন এবং গুণগত মান খারাপ হয়, ফসলের বীজ পুষ্ট হয় না, গাছের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে না।

এছাড়া বীজ ওজনে হালকা হয়, অংকুরোদগম মতা হ্রাস পায়, রোগ বালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণের প্রতিরোধ মতা কমে আসে, গুদামজাত করে রাখা যায় না। ডালজাতীয় ফসলের বেলায় আমিষের পরিমাণ কম হয়, তেলজাতীয় ফসলে তেলের পরিমাণ কমে যায়। শস্যের উদ্দেশ্যভেদে অনেক েত্রে ফসল সংগ্রহের সময়ের তারতম্য পরিলতি হয়।

যেমন আগেই বলা হয়েছে, আঁশের জন্য পাট চাষ করলে ফুল ধরার সময় ফসল সংগ্রহ করতে হয়, তা না হলে আঁশের গুণগত মান (দৃঢ়তা, ঔজ্জ্বল্য) খারাপ হয়ে যায়। একই পাট যদি বীজের জন্য চাষ করা হয় তাহলে পূর্ণ পরিপক্কতা অর্থাৎ বীজ না পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাতে আঁশের ফলন কিছুটা বাড়ে কিন্তু আঁশের গুণগত মান খারাপ হয়।

ফসল সংগ্রহ পদ্ধতি

ফসলের প্রকৃতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহ করা হয়। যেমন :

গাছের গোড়া কেটে সংগ্রহ

পরিপক্কতার লণ দেখা দিলে দা, কাঁচি বা কোদাল দিয়ে গাছের গোড়া কেটে সংগ্রহ করা হয়। ধান, গম, পাট, আখ ইত্যাদি ফসলের বেলায় এ পদ্ধতি উপযোগী। ধান, গম ইত্যাদি তন্ডুল ফসলের বেলায় গোড়া মাটির কিছু ওপরে কাটলেও তির সম্ভাবনা থাকে না।

তবে পাট বা আখ ফসলের বেলায় অর্থাৎ যাদের কান্ড ফলন সহায়ক সে সব ফসলের েত্রে কান্ড মাটির খুব কাছাকাছি কাটা উচিত। কেননা মাটিতে থেকে যাওয়া গোড়ার দিকের কান্ডের অংশ থেকে পাটের আঁশ, পাটকাঠি অথবা আখের রস না পাওয়ায় ফলন হ্রাস পায় ।

গাছ মূলোৎপাটন করে/উপড়িয়ে সংগ্রহ

ডালজাতীয় ফসল যেমন খেসারী, মসুর, ছোলা ইত্যাদি এবং তৈলবীজ ফসল যেমন- সরিষা, তিসি, তিল ইত্যাদির গাছ মূলোৎপাটন করে ফসল সংগ্রহ করা হয়। এখানে উলে- য্য যে, ডালজাতীয় গাছের মূলে নাইট্রোজেন আটককারী গুটি থাকায় সেগুলো উপড়িয়ে বা মূলোৎপাটন না করে গোড়ায় কেটে সংগ্রহ করা উচিত।কারণ তাতে নাইট্রোজেন আটককারী গুটি মাটিতে থেকে গিয়ে সেখানে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে থাকে।

মাটি খুড়ে ফসল সংগ্রহ

আলু, মিষ্টি আলু, চীনাবাদাম ইত্যাদি যেসব ফসল মাটির নিচে হয় সেগুলো লাঙ্গল বা কোদাল বা অন্য কোন যন্ত্র দিয়ে মাটি খুড়ে সংগ্রহ করা হয়।

চয়ন করে সংগ্রহ

যেসব ফসল একসঙ্গে পরিপক্ক না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পরিপক্ক হয় সেসব েত্রে এ পদ্ধতি অত্যন্ত উপযোগী, তবে কিছুটা ব্যয়বহুল। যেমন- তামাকের পাতা সবগুলো একসঙ্গে পরিপক্ক না হওয়ায় ধাপে ধাপে প্রত্যেক গাছ থেকে ৫/৬ টি করে পাতা নিচের দিক থেকে সংগ্রহ করা হয় ( একে প্রাইমিং বলে)। তাছাড়া তুলা, ভূট্টা, চা পাতা, অড়হর, মটরশুটি, মুগকলাই ইত্যাদি ফসলের বেলায় এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় ।

পাট

দেশী পাটের বেলায় শতকরা ৫০ ভাগ গাছে ফুল আসলে এবং তোষা পাটে শতকরা ৫০ ভাগ গাছে ফল ধরলে আঁশের জন্য পরিপক্ক বলে ধরা হয়। বীজের বেলায় ফলের রং কাল হয়ে বীজের নিজস্ব রং না ধরা পর্যন্ত পরিপক্কতা আসে না।

ডাল জাতীয় ফসল, সরিষা, তিল, তিসি

গাছে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ফলের বীজ পুষ্ট ও শক্ত হওয়া এবং নিজস্ব জাতের রং ধারণ করা পরিপক্কতার ল ণ। এর বেশি সময় জমিতে থাকলে ফল ফেটে বীজ ঝরে পড়ে।

চীনাবাদাম

কিছুদিন পর পর গাছ উঠিয়ে যদি দেখা যায় যে, চীনাবাদাম গাছের ফলের (চীনাবাদামের) শতকরা ৭০-৮০ ভাগের মত পুষ্ট হয়েছে তবে পরিপক্ক হয়েছে বলে ধরতে হবে। তাছাড়া চীনাবাদাম গাছে থাকা অবস্থায়ই কিছু কিছু চীনাবাদাম থেকে চারা উঠতে দেখা যাবে। চীনাবাদামের বীজ পুষ্ট হবে, বীজের খোসার বাইরের দিকের শিরা-উপশিরা স্পষ্ট হবে এবং ভেতরের দিকে লালচে বা লালচে- বাদামী রং ধরবে।

চীনাবাদাম বীজের আবরণীতেও জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের রং দেখা দিবে। চীনাবাদাম বীজ দ্বারা খোসার ভেতরের জায়গা ঠাসাঠাসি করে পূর্ণ থাকবে এবং কোন স্পঞ্জী কলা (Spongy tissue) থাকবে না। বীজে চাপ প্রয়োগ করলে ভেঙ্গে গিয়ে তেলের উপস্থিতি বোঝা যাবে ।

 

আখ

আখ পরিপক্ক হলো গাছের বৃদ্ধি কমে গিয়ে পাতার সবুজ রং ফ্যাকাশে হতে শুরু করবে। কান্ডে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করলে ধাতব শব্দ হবে। মোচড় দিলে কান্ড গিড়ার (পর্বের) মধ্যে সহজে ভেঙ্গে যাবে। কান্ডের নিচের দিকের গিড়ার চোখ (Eye) বেশ বড় হয়ে বাইরের দিকে বেড়িয়ে আসবে এবং গিড়ার নিচে অস্থানিক মূলের বৃদ্ধি শুরু হবে।

অনেক সময় চামড়ায় ফাটল ধরে। রসের মিষ্টত্ব (Sweetness) বেশ বাড়বে। কান্ডের সব অংশেই (নিচের, মধ্যের এবং ওপরের) মিষ্টি সমান মনে হবে। তখন ব্রিক্স রিডিং (Brix reading) এর মান ১৮-২২ এর মধ্যে হয়। Brix হলো পরিপক্ক আখের মধ্যস্থিত কঠিন পদার্থ।

তামাক

পরিপক্ক অবস্থায় পাতা হলে দাভ বর্ণ ধারণ করবে। পাতার অগ্রভাগ নিচের দিকে কিছুটা ঝুলে পড়বে এবং পাতায় কিছুটা আঠালোভাব দেখা দিবে। পাতা ভাঁজ করলে ভেঙ্গে যাবে। উল্লেখ্য যে, তামাকের সব পাতা একত্রে পরিপক্ক হয়না।

তুলা

গাছ শুকাতে শুরু করবে এবং পাতা ঝরে পড়তে থাকবে। প্রাকৃতিকভাবেই তুলার বল (Boll) ফেটে তুলা বেরিয়ে আসবে ও দিনে দিনে আকারে বৃদ্ধি পাবে। তুলা গাছ ও বল কাল রং ধারণ করবে।

গো-খাদ্য ফসল

গোখাদ্য ফসলের পরিপক্কতার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে গাছে ফুল ধরা বা ফল ধরা পর্যন্ত (ভূট্টা, জোয়ার) যে কোন অবস্থায়ই ফসল সংগ্রহ করা যায়। ছোলা জাতীয় ফসলে ফল পাকা পর্যন্ত এবং পারা, নেপিয়ার ঘাস ৩০-৪০ দিন পর পর কাটা যায়।

জোয়ারের কচি গাছে (৬০ দিনের কম বয়সের) ডুরিন নামক একটি গ্লুকোসাইড উৎপন্ন হয় যা গরুবাছুরের পাকস্থলীতে গিয়ে মারাত্বক বিষাক্ত হাইড্রোসায়নিক এসিডে পরিণত হয়। ফলে গবাদিপশু মারা যায়। দু’মাসের বেশি বয়সের জোয়ার গাছে এ বিষ নষ্ট হয়ে যায়। তাই জোয়ারের পরিপক্কতা ৬০ দিনের বেশি বয়সে গণ্য করা উচিত।

সবুজ সার ফসল

এর কোন নির্দিষ্ট সংগ্রহ সময় নাই। যে কোন বয়সে এদেরকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া গেলেও ফুলফল ধরার পূর্বেই পরিপক্কতা ধরা ঠিক হবে। কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছ শক্ত হয়ে যায় এবং পচনে বিলম্ব ঘটে।

মাড়াই (Threshing)

ফসলের ফলন বা উৎপাদিত পণ্য ফসল গাছ থেকে পৃথক করণের প্রক্রিয়াকে মাড়াই বলে। ফসল সংগ্রহ করার পর যত শীঘ্র সম্ভব মাড়াই করে ফেলা উচিত। কারণ সঙ্গে সঙ্গে মাড়াই না করলে বিভিন্ন ভাবে ফলনের বা পণ্যের তি হয়। ফসল ভেদে তির পরিমাণ কমবেশি হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় দেখা যায় একই ফসলেও পরিবেশগত কারণে তির পরিমাণের তারতম্য হয়।

যেমন- আউশ ধান সংগ্রহের সময় (জুলাই-আগষ্ট) প্রচুর বৃষ্টিপাত ও গরম থাকার জন্য তাৎ নিকভাবে মাড়াই না করলে ধানবীজ এবং খড় উভয়ই পচে যায় বা বীজের অঙ্কুরোদগম শুরু হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বোরো ধান বা রোপা আমন ধান সংগ্রহের বেলায় শুকনা আবহাওয়া থাকায় মাড়াই দেরী করে করাতেও তেমন তির কারণ হয় না।

তবে মাড়াই করার আগে কাটা ধানগাছকে পালা করে ২/৪ দিন রেখে দিয়ে অথবা ভাল করে শুকিয়ে নিলে মাড়াই প্রক্রিয়া সহজতর হয় এবং অল্প সময়ে অধিক পরিমাণে ধান মাড়ানো যায়। ডালাজাতীয় শস্য বা সরিষার বেলায় ফসল সংগ্রহের পর গাছকে রোদে ভাল করে শুকিয়ে না নিলে মাড়াই কার্যে অসুবিধা হয়।

ঝাড়াই (Winnowing)

ফসল মাড়াইয়ের পর ফলন বা উৎপাদিত পণ্যকে খড়কুটা, উপজাত দ্রব্য এবং ময়লা বা আবর্জনা থেকে আলাদা করে আনার প্রক্রিয়াকে ঝাড়াই বলে। ঝাড়াই বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। অপোকৃত বড় ধরনের খড়কুটোকে হাত দিয়ে পরিষ্কার করে নেবার পর ছোটখাট খড়কুটা ময়লা বা আবর্জনা কুলা দিয়ে ঝেড়ে বা বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

শুকানো (Drying)

বীজ পরিষ্কার করে উঠানে বা মাড়াইখোলায় (Threshing floor) রোদে ছড়িয়ে দিয়ে শুকানো হয়। ছড়ানোর পর বীজকে বারবার পা দিয়ে অথবা পাওয়াটি (কাঠের তৈরি বীজ সংগ্রহের যন্ত্র বিশেষ) দিয়ে নাড়াচাড়া করে দিলে তাড়াতাড়ি শুকায়। প্রত্যহ কয়েক ঘন্টা করে বীজ রোদে শুকাতে হয় ।

 

ফসল সংগ্রহ – সংগ্রহের সময়, সংগ্রহ পদ্ধতি, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও গুদামজাতকরণ

 

বীজের জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে ১০-১২ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত শুকানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বীজ ঠিকমত শুকানো হলো কি না জানার জন্য এক কেজি বীজ ভালভাবে মেপে নিয়ে। একপাশে আলাদা পাত্রে রোদে ছড়িয়ে দিয়ে প্রত্যেক দিন মাপ নিতে হবে।

Leave a Comment