বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা – পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের, পরিবেশ বিভাগের ৩ নং ইউনিটের পাঠ ৩.৫ নং পাঠের অংশ।

বায়োগ্যাস কী?

গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ বায়ুর অনুপস্থিতিতে জৈব বিজারণের ফলে মিথেন  গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে যে সকল প্রাণী জাবর কাটে (যেমনঃ গো—মহিষ, ছাগল) তাদের অন্ত্রে এবং অক্সিজেন বিবর্জিত ইকোলজীক্যাল এলাকা যেমনঃ জলাবদ্ধ ভূমি, সঁ্যাতসঁ্যাতে ভেজা জায়গা, ময়লাযুক্ত পানির আধার প্রভৃতি স্থান থেকেও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস রংবিহীন এবং খুব সহজেই দাহ্য। জৈব উৎস থেকে উৎপন্ন বলে এই গ্যাসকে বায়োগ্যাস বলা হয়।

বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

 

বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সুবিধা

১। বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসেবে সব ধরনের রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের ফলে হাড়ি—পাতিল, বাড়ি—ঘর ও কাপড়—চোপড়ে ময়লা পড়ে না।

২। এই গ্যাস দিয়ে রাতে ম্যান্টল জ্বেলে হ্যাজাক লাইটের মতো আলো পাওয়া যায়। কেরোসিনের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেও বায়োগ্যাস ব্যবহৃত হয়।

৩। রসায়নাগারে কোলগ্যাস, এ্যারোজেন গ্যাস বা পেট্রোল গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কম খরচে এই গ্যাস ব্যবহারযোগ্য।

৪। গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে বায়োগ্যাস উপরি হিসেবে পাওয়া যায়। এর পরে úারী হিসেবে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই উন্নতমানের জৈব সার। জৈব—দহন প্রক্রিয়ার কারণে সকল আগাছার বীজ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে এই সার ব্যবহারে জমিতে আগাছার পরিমাণও হ্রাস পায়।

৫। বায়ুরোধী অবস্থায় পচন ক্রিয়া স¤žন্ন হয় বলে কোন দুর্গন্ধ ছড়ায় না এবং মশামাছির উপদ্রবও  গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে বায়োগ্যাস উপরি হিসেবে পাওয়া যায়। এর পরে úারী হিসেবে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই উন্নতমানের জৈব সার। থাকে না।

৬। এই গ্যাস পারিবারিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে উদ্ভিদ জ্বালানির উপর চাপ কমে যায়।

৭। একটি বায়োগ্যাস প্লাণ্ট স্বল্প পরিসর স্থানে এমনকি জনবহুল এলাকাতেও তৈরি করা সম্ভব। এর প্রস্তুত প্রণালী ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং খরচও কম।

 

বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ কৌশল

একটি বায়োগ্যাস প্লাণ্টের প্রধান অংশ হচ্ছে ডাইজেস্টার বা ফারমেণ্টেশন ট্যাঙ্ক এবং গ্যাস হোল্ডার। এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে ইনলেট ট্যাঙ্ক বা খাদকনালী , নিগর্মন নালী ও আউটলেট কূপ এবং গ্যাস সরবরাহ লাইন। একটি বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্টের বিভিন্ন অংশের আকার আকৃতি নির্ভর করে গ্যাসের চাহিদা, ব্যবহৃত কাঁচামালের পরিমাণ, ধরণ ইত্যাদির উপর।

এখানে ৪—৫ টি গরু/মহিষ আছে এমন বাড়ীতে ৬/৭ জন পারিবারিক সদস্যের জ্বালানি চাহিদা মেটানো উপযোগী একটি বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্টের বর্ণনা দেয়া হলো। প্রথমে ৮ ফিট গভীর ও ৭ ফিট ব্যাসের একটি কূপ খনন করতে হবে। খননকৃত কূপের তলায় ৩ আর.সি.সি ঢালাই দিতে হবে।

এই ঢালাইয়ের উপরে ৬ ফুট অভ্যন্তরীণ ব্যাস ও ৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৫ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনী দিয়ে একটি গোলাকার নিশ্ছিদ্র কূপ তৈরি করতে হবে। দেয়ালের ৫ ফুট উচ্চতায় ভেতরে ও বাইরে ৩ ইঞ্চি ইটের একটি বর্ধিত গাঁথুনী চতুর্দিকে দিতে হবে। খালি অবস্থায় গ্যাস হোল্ডারটি এর উপরে অবস্থান করবে। বর্ধিত গাঁথুনীর ঠিক নিচ দিয়ে ৪—৬ ফুট ব্যাসের ৮—১০ ফুট লম্বা একটি আর.সি.সি পাইপ এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে এর নিম্নাংশ কূপের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে তলদেশ থেকে ১ ফুট উপরে অবস্থান করে। অপর অংশ ২২২ মাপের ইটের তৈরি ইনলেট বা ফিডিং ট্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত থাকবে।

Capture 5 বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ডাইজেস্টারের উপরের দিকে দেয়ালের গায়ে সুবিধা মতো স্থানে একটি ছিদ্র করে তার সাথে ৪— ৬ ব্যাসের ৩— ৪ দীর্ঘ একটি আর.সি.সি পাইপ জুড়ে দিয়ে নির্গমন কূপের সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে। এই পথেই গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবার পর úারী (পানি মিশ্রিত গোবর) ডাইজেস্টারের বাইরে চলে আসবে। ডাইজেস্টারের তলায় ঠিক কেন্দ্র বিন্দুতে ১  ১  ১ ঢালাই এর মাধ্যমে ৮ ফুট লম্বা ২ ব্যাসের একটি রড খাড়া ভাবে বসাতে হবে। এই রডের উপরেই গ্যাস হোল্ডার বসানো থাকে।

 

গ্যাস হোল্ডার

গ্যাস হোল্ডারের ব্যাস অবশ্যই ডাইজেস্টারের ব্যাস অপেক্ষা সামান্য (প্রায় ৩) কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় এটি সহজে ডাইজেস্টারের কূপের ভেতরে ঘুরানো বা উঠানামা করানো যাবে না। প্রায় ১০০ ঘন ফুট গ্যাস ধারণক্ষম একটি ডাইজেস্টারের জন্য ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি বাসের (৩.৫— ২ নং চিত্র অনুযায়ী) একটি গ্যাস হোল্ডার প্রয়োজন। এটি ১৬ থেকে ২৪ গজী এম, এস সিট ওয়েল্ডিং করে তৈরি করা যায়। গ্যাস হোল্ডারের অভ্যন্তরে আড়াআড়িভাবে দু’টো রড এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে গ্যাস হোল্ডারটি সহজে উপরে নিচে উঠা নামা করতে পারে এবং চারদিকে ঘুরতে পারে। গ্যাস হোল্ডারের এক মুখ খোলা এবং অপর মুখ বন্ধ থাকবে।

বন্ধ মুখের কেন্দ্রস্থল থেকে খোলা মুখের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা একটি জি,আই পাইপ সোজাভাবে আড়াআড়ি রডের সাথে ওয়েল্ডিং করে লাগাতে হবে। ডাইজেস্টারের কেন্দ্রে অবস্থিত রডটি জি, আই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে গ্যাস হোল্ডারটি ডাইজেস্টারের উপরে স্থাপন করতে হবে। গ্যাস হোল্ডারের উপরে ভালভ্সহ ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটি গ্যাস ট্যাপের সংযোজন দিতে হবে। এই সংযোগস্থল থেকে জি,আই পাইপের সাহায্যে ব্যবহারস্থলে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্ট চালুকরণ নির্মাণ শেষে এ ধরনের গ্যাস প্ল্যাণ্ট প্রথম চালু করার জন্য ৪০/৫০ মণ গোবর প্রয়োজন। গোবর ও পানি ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে úারী (গোবরের দ্রবণ) তৈরি করে ফিডিং ট্যাঙ্কের মধ্যে ঢেলে দিলেই তা দ্রুত ডাইজেস্টারে পৌঁছবে। ফিডিং এর সময় গ্যাস হোল্ডার বায়ু শূন্য করার জন্য গ্যাস লাইন খোলা রাখতে হয়। ডাইজেস্টার ট্যাঙ্ক ভর্তি হবার পর হুইল কর্ক বন্ধ করে গ্যাস লাইনের সংযোগ দিতে হয়।

বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ , ইউনিট ৩ , পাঠ-৩.৫

কয়েক দিনের মধ্যেই গ্যাস জমা হয়ে গ্যাস হোল্ডার উপরের দিকে উঠে যাবে। প্রথম দিকে গ্যাস হোল্ডারে কিছু কার্বন ডাই—অক্সাইড জমা হবার কারণে তা নাও জ্বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্যাস হোল্ডারে জমাকৃত সম্পূর্ণ গ্যাস বের করে দিতে হবে। প্রথমেই úারীর সাথে কিছু পরিমাণ লাইম বা চুন (ঈধঙ) মিশিয়ে দিলে বায়োগ্যাস উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং কার্বন—ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হ্রাস পায়। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রতিদিন ৪/৫ বালতি গোবর ও সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে ফিডার চ্যানেলের মাধ্যমে ডাইজেস্টারে প্রবেশ করাতে হবে।

এখানে উলে­খযোগ্য যে, টংবফ ঁঢ় ংষঁৎৎু বা ঊভভষঁবহঃ গ্যাস উৎপাদনের পর যা বের হয়ে আসে তা অত্যন্ত উন্নত মানের জৈব সার হিসেবে মাটিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ সারে ১.৫৮% নাইট্রোজেন, ১.২% ফসফেট (চ২ঙ৫) এবং ০.৭% পটাশ (ক২ঙ) থাকে।

সতর্কতা

১। ডাইজেস্টারে যাতে বৃষ্টির পানি না ঢুকে তার জন্য ফিডিং ট্যাঙ্ক ডাইজেস্টার থেকে সামান্য উপরে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে উপরে শেড তৈরি করা যেতে পারে।

২। ডাইজেস্টারে গোবর—পানি প্রবেশকালে অন্য কোন আবর্জনা যাতে না ঢুকে তা লক্ষ রাখতে হবে।

৩। গ্যাস হোল্ডারটি মাঝে মধ্যে কেন্দ্রীয় পাইপের চারদিকে ঘুরিয়ে দিলে উপরে গোবর ও পানির মিশ্রণ শক্ত হতে পারবে না।

৪। কোন কারণে ইনলেট বা আউটলেট পাইপ বন্ধ হয়ে গেলে সোজা সরু কাঠি দিয়ে তা ছাড়িয়ে দিতে হবে।

৫। কোন সময় গ্যাস লাইনে পানি জমলে পানি জমাস্থান খুলে পানি বের করে দিতে হবে।

 

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ব্যবহার শেষে বস্তুর পরিত্যাক্ত যে কোন্ অংশের নামই বর্জ্য বা আবর্জনা। অন্যকথায়, পূণঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া কোন্ বস্তু তার ব্যবহার যোগ্যতা হারিয়ে ফেল্লে তাকেই বর্জ্য বলে। বর্জ্য িবভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনঃ কঠিন বর্জ্য ও ক্ষতিকারক বর্জ্য।ব্যবহার শেষে বস্তুর পরিত্যাক্ত যে কোন অংশের নামই বর্জ্য বা আবর্জনা। অন্যকথায়, পূণঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া কোন বস্তু তার ব্যবহার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললে তাকেই বর্জ্য বলে। বর্জ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনঃ কঠিন বর্জ্য ( ও ক্ষতিকারক বর্জ্য ।

১। কঠিন বর্জ্য ( ঃ কঠিন বর্জ্য বলতে বোঝায় বাড়ী ঘর থেকে ফেলে দেয়া অপ্রত্যাশিত বস্তু, রাস্তার ঝাড়ু দেয়া আবর্জনা, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কৃষি খামার প্রভৃতি স্থান হতে মানব কার্য কলাপ সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত বস্তুসমহকে। শহরাঞ্চলে এসব বর্জ্য ূ এবং গ্রামাঞ্চলে আবর্জনা হিসেবে পরিচিত। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপাদান রয়েছে, যেমনঃ ধুলা, খাদ্যজাত উচ্ছিষ্ট, কাগজ, ধাতব উপাদান, প্লাষ্টিক, রাবার কাঁচ, পরিত্যক্ত কাপড়, বাগানের আবর্জনা, নির্মাণ সামগ্রীর ফেলে দেয়া অংশ, প্যাকিং সামগ্রী, শিল্পজাত বর্জ্য, ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে আরও বহুবিধ দহনযোগ্য ও অদহনযোগ্য সামগ্রী এবং তেজষ্ক্রিয়া পদার্থ। বহু ধরনের খামারজাত উচ্ছিষ্টও কঠিন বর্জ্য শ্রেণিভুক্ত, যেমনঃ গোবর ও গৃহপালিত পশু—পাখির বিষ্ঠা, খড়কুটা, শস্যের পরিত্যাক্ত অংশ ইত্যাদি।

বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ , ইউনিট ৩ , পাঠ-৩.৫

বাংলাদেশে মাথাপ্রতি বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। যেমনঃ ঢাকায় মাথাপ্রতি প্রতিদিনের গড় যেখানে মাত্র ০.২২ কেজি সেখানে কলকাতায় ০.৫১ কেজি এবং নিউইর্য়কে ১.৮ কেজি। নগর বর্জে্যর বৈশিষ্ট্য নগরের অধিকাংশ কঠিন বর্জ্যই গৃহ, শিল্প ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে সৃষ্ট। প্রতিদিন জনপ্রতি কী পরিমাণ কঠিন বর্জ্য সংগৃহীত হবে তা নগরের আয়তন, এবং ঋতুর উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে মাথাপ্রতি বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।

যেমনঃ ঢাকায় মাথাপ্রতি প্রতিদিনের গড় যেখানে মাত্র ০.২২ কেজি সেখানে কলকাতায় ০.৫১ কেজি এবং নিউইর্য়কে ১.৮ কেজি। ঢাকায় এত কম হওয়ার প্রধান কারণ হয়ত সেখানকারচ্ছ’র্বল সংগ্রহ ব্যবস্থা। নগরের প্রধান প্রধান বর্জ্য সমূহের তালিকায় রয়েছে ফেলে দেয়া খাদ্য, বাজার এলাকার উচ্ছিষ্ট, পাতা, ঘাস, কাগজ, প্লাষ্টিক সামগ্রী, ধাতব পদার্থ, ক্যান, কাঁচ, বোতল, ইটের টুকরা, বস্ত্রাংশ, ভগ্নস্তুপ, ময়লা,
ছাই, কাঠ, চামড়া ও রাবারজাত দ্রবাদি।

২। ক্ষতিকারক বর্জ্য ঃ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম থেকেই ক্ষতিকারক বা বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব উপাদানে শতকরা ৭৫ ভাগের ওপরে থাকে রাসায়নিক দ্রব্য। উৎপন্ন হবার পর থেকেই এ সকল উপাদান দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করে। এটি যেমনঃ উন্নত বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি অনুন্নত বিশ্বের জন্যও প্রযোজ্য। এসকল রাসায়নিক দ্রব্যাদি বায়ু, পানি এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রবেশের সুযোগ করে নেয়। এক তথ্য বিবরণীতে প্রকাশ ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ৪৯,০০০ কি.গ্রা. শিল্পজাত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতেও প্রতিদিন ৪৫,০০০ কি.গ্রা. শিল্পজাত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।

এসকল বর্জে্যর কারণে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী নদীর পানিতে দস্তা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডিয়াম ও আরসেনিকের মতো ভারি ধাতুর মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নদী ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় মাছের চারণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে।

 

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল

আবর্জনা বা জঞ্জাল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের সামনে যে তিনটি পথ খোলা রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

(১) উন্মুক্তস্থানে, নদী, হ্রদ, সাগর বা অন্য কোন জলাশয়ে অশোধিত অবস্থায় নিক্ষেপন করা। এ প্রক্রিয়ার মূল দর্শন, “দূষণের সমাধান হচ্ছে হালকাকরণ” (“ঞযব ংড়ষঁঃরড়হ ঃড় ঢ়ড়ষষঁঃরড়হ রং ফরষঁঃরড়হ”)। বিশ্বের সর্বত্র এটিই বহুল প্রচলিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় হিসেবে বিবেচিত। যে কারণে নগর ও শিল্প কারখানাগুলো সাধারণত জলপথের তীর ধরে গড়ে উঠেছে।

(২) বিশেষভাবে নির্বাচিত স্থানে জঞ্জাল স্তুপীকৃতকরণ এবং প্রায় প্রাকৃতিক উপায়ে বিয়োজন ঘটিয়ে পূনঃব্যবহারযোগ্য সম্পদ সৃষ্টিকরণ। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দূষণ পরিহারকারী এটিই সহজতম পদ্ধতি। এর মাধ্যমে অধিক পরিমাণে বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন হুমকি সৃষ্টি না করেই পরিশোধন করা সম্ভব।

(৩) যান্ত্রিক—রাসায়নিক পদ্ধতি (ঈযবসড়—সবপযধহরপধষ ঢ়ৎড়পবংং) অনুসরণ করে পূনঃব্যবহারযোগ্য সম্পদ সৃষ্টিকরণ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে যান্ত্রিক উপায়ে রাসায়নিক শোধন দ্বারা বর্জ্য পরিশোধন করে পূনঃব্যবহার উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতি দূষণ নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী। কিন্তু ব্যয়বহুল পদ্ধতি বিধায় কিছু কিছু উন্নত দেশ ছাড়া সর্বত্র প্রচলিত নয়।

বাংলাদেশে যেসব বর্জে্যর কিছুটা বাজার চাহিদা রয়েছে সেগুলো তিন পর্যায়ে সংগ্রহ বা উদ্ধার করা হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে উদ্ধারের সাথে জড়িত থাকেন বাড়ীর গৃহিণীরা। তারা কাগজ, বোতল, কনটেইনার, পুরাতন কাপড়, জুতা ইত্যাদি দ্রব্যাদি (যাদের ভাল বাজার চাহিদা রয়েছে) বাছাই করেন এবং হকারদের নিকট বিক্রয় করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বস্তি এলাকার দরিদ্র শিশুরা যারা ‘টোকাই’ নামে পরিচিত। এরা ভাঁঙ্গা কাঁচ, ক্যান, কার্ডবোর্ড, ফেলে দেয়া কাগজ, ছিন্ন বস্ত্র, প্লাষ্টিক সামগ্রী, ধাতব পাত্র, ও ফেলে দেয়া অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। তৃতীয় পর্যায়েও রয়েছে দ্ররিদ্র শ্রেণির টোকাইরা। তারা পৌরসভার গাড়ী থেকে চূড়ান্ত নিগর্মন স্থানে বর্জ্য ফেলার সময় তা থেকে বাছাইকৃত বর্জ্য সংগ্রহ করে।

বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থা পুণঃব্যবহার উপযোগীকরণের পর্যায়গুলো চিত্র ৩.৫—৩ এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। হকার, টোকাই এবং আবর্জনা ফেলার স্থান থেকে সংগ্রহকারীদের মাধ্যমে সংগৃহীত দ্রব্যাদি পুরাতন দ্রব্য বিক্রয়কারীদের দোকানে পৌঁছে। তারা সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে, ধৌতকরণ, বাছাইকরণ প্রক্রিয়া শেষে ডিলারদের নিকট সরবরাহ করে। পুরাতন সামগ্রীর ডিলারগণ যথাযথ পৃথকীকরণের পর সরাসরি ব্যবহারকারীদের নিকট বিক্রয় করে। আর বিক্রয় অযোগ্য দ্রবাদি পণঃব্যবহারযোগ্যকরণ ু কারখানায় (জবসড়ষফরহম ভধপঃড়ৎরবং) প্রেরণ করে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর পুণরায় তা বাজারে ফিরে আসে।

 

চূড়ান্ত বিসর্জন ও বিকল্প ব্যবস্থা 

বাজারমূল্য আছে এমন সব বর্জ্য সামগ্রী অসাংগঠনিক পন্থায় পুণরুদ্ধার করা হয়। আর বিয়োজকযোগ্য জৈবিক উপাদানসমূহ খোলা অবস্থায় নগরের অপেক্ষাকৃত নিচুস্থানে স্তুপাকারে ফেলে দেয়া হয়। আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে এসব দ্রব্য দ্রুত পঁচনের ফলে তৎসংলগ্ন এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং অসস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। বৃষ্টির পানি ময়লার স্তুপের ভিতরে প্রবেশ করে পরিবেশ দুষণক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলে। এদের প্রচুর দূষণ ক্ষমতাযুক্ত চুয়ানি ভূমি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে। কম খরচে পরিবেশ দূষণমুক্ত জৈবপদার্থ বিসর্জনের উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যান্ডফিল (ঝধহরঃধৎু ষধহফ ভরষষ) পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে উচ্চ দূষক পদার্থ সংগ্রহের নিরাপদ ব্যবস্থা রাখা হয় এবং মিথেন গ্যাস সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যার বর্ণনা এ পাঠের প্রথমাংশে দেয়া হয়েছে। বাছাইকৃত জৈব বর্জ্য কমপোষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈবসারে রূপান্তরিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় পরিমিত পানি ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবের সাহায্যে জৈব উপাদানসমূহের দ্রুত পচন ঘটিয়ে তা জৈব সারে পরিণত করা হয়।

পানি সরবরাহের পরিমাণ জৈব বর্জে্যর ধরণের উপর নির্ভরশীল এবং এটি স্ববাত  অবস্থায় সম্পন্ন করা হয়। যান্ত্রিক উপায়ে স্ববাত গার্বেজ কমপোষ্ট প্রক্রিয়া বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয়নি। অবশ্য বাছাইকৃত কিছু কিছু জৈব বর্জ্য ভারত ও চীনে উদ্ভাবিত অবাত কম্পোষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অনুসৃতঃ পদ্ধতি চিত্র নং ৩.৫ — ৩ এর সাহায্যে দেখানো হয়েছে।

পৌর এলাকার অনিধনযোগ্য বর্জ্য নিচু এলাকা ভরাটের কাজে ব্যবহার করে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব।

আরও দেখুন :

Leave a Comment