মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আজকের আলোচনা। শিলাক্ষয় (Weathering) একটি ধ্বংসাত্বক প্রক্রিয়া কিন্তু মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া গঠনমূলক যা মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Profile) তৈরিতে সহায়তা করে। শিলাক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলা ও খনিজের উপর জলবায়ু ও বিভিন্ন ধরনের জীবের ক্রিয়ার ফলে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। ইহা একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া। শিলাক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট চূর্ণ-বিচূর্ণ মৃত্তিকার উৎস বস্তু প্রধানত তিনটি প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকায় রূপলাভ করে।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া, পাঠ ১.৫, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

যথা :

  • চুনীকরণ (Calcification)
  • ল্যাটেরাইজিকরণ (Laterization )
  • পড়জলিকরণ (Podzolization)

কী প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উৎস বস্তু থেকে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র সৃষ্টি হবে তা প্রধানত সেখানকার জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্র (Profile) গঠনে তিনটি ভৌত প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যথা হিউমিফিকেশন (Humification), চুয়ীসরণ (Eluviation.) এবং সঞ্চয়ন (Illuviation ) । মৃত্তিকা গঠনের প্রধান তিনটি প্রক্রিয়া আলোচনার পূর্বে উল্লিখিত তিনটি ভৌত প্রক্রিয়া আলোচনা করা প্রয়োজন।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ১ , পাঠ ১.৫

হিউমিফিকেশন (Humification ) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

নিরক্ষীয় (Tropical) ও অবনিরক্ষীয় (Sub-tropical) অঞ্চলে জীবদেহের (উদ্ভিদ ও প্রাণীর) অবশেষ বা জৈবপদার্থ বিয়োজিত হয়ে মাটির উপরের স্তরে হিউমাস স্তর গঠন করে। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি থাকার ফলে জৈব পদার্থের পচন দ্রুত সংঘটিত হয়। হিউমাস হলো জৈবপদার্থ পচনের বা বিয়োজনের সর্বশেষ অবস্থা। হিউমাস উৎপাদনের সময় নানা জৈব এসিড (হিউমিক এসিড) ও কার্বন-ডাই অক্সাইড (CO2) উৎপন্ন হয়। এসব জৈব এসিড মৃত্তিকার উপরের স্তরের খনিজ পদার্থসমূহকে দ্রবীভূত করে নিচের দিকে নিয়ে যায়। ফলে মৃত্তিকা প্রোফাইলে A ও B স্তর গঠন সহায়ক হয়।

চুয়ীসরণ এবং সঞ্চয়ন (Eluviation and Illuviation) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে চুইয়ে মৃত্তিকার গভীরে প্রবেশ করে। এই পানি উপরি স্তরের খনিজ পদার্থকে দ্রবীভূত করে ক্রমে নিচের দিকে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে চুয়ীসরণ (Eluviation) বলে। যে স্তর থেকে খনিজ পদার্থ অপসারিত হয় তাকে পরিস্রুত (Eluvial) স্তর বলে এবং যে স্তরে সঞ্চিত বা জমা হয় তাকে সঞ্চিত (Illuvial) স্তর বলে। খনিজ আয়নসমূহ উপরের স্তর থেকে চলে এসে নিচের স্তরে জমা হবার প্রক্রিয়াকে সঞ্চয়ন (Illuviation) বলে। চুয়ীসরণ আবার নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরেও ঘটতে পারে। যে সব অঞ্চলে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে বাষ্পীভবন বেশি সেখানে এ ধরণের চুয়ীসরণ ঘটে থাকে।

চুয়ীসরণ ও সঞ্চয়ন এর মধ্যে পার্থক্য (Differences between Eluviation & Illuviation) চুয়ীসরণ (Eluviation) ও সঞ্চয়নের (Illuviation) মধ্যে পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ

Capture 9 মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

চুনীকরণ (Calcification) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয় সেখানে এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। বৃষ্টিপাত কম হলে অনুসরন (Infiltration) কম হয়। উপরের স্তর থেকে খাড়াভাবে নিচের স্তরে পানির চলাচলকে অনুসরণ বলে। যেসব এলাকায় বাস্পীভবন বেশি হয় সেক্ষেত্রে নিচের স্তরের পানি দ্রবণীয় চুনজাতীয় আয়ন (ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) উপরের স্তরে জমা হয়। এ প্রক্রিয়ায় চুনজাতীয় পদার্থ মৃত্তিকার উপরের স্তরে জমা হয় বলে তাকে চুনীকরণ বলে। এ প্রক্রিয়ায় যে মাটি গঠিত হয় তাকে পেডোকেল (Pedocal) বা ক্যালসিয়ামযুক্ত মাটি বলে। ভারতের রাজস্থানে এ ধরণের মৃত্তিকা বেশি দেখা যায়।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ১ , পাঠ ১.৫

ল্যাটেরাইজিকরণ (Laterization ) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

উষ্ণমন্ডলীয় অতি বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায় এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। এসব এলাকায় জৈব পদার্থের বিয়োজন দ্রুত সংগঠিত হয়। অতিবৃষ্টির ফলে বিয়োজিত জৈব পদার্থ, ক্যালসিয়াম ও সিলিকা জাতীয় কর্দম নিচে চলে যায়। এ ছাড়া এসব এলাকায় মৃত্তিকার অনেক গভীর স্তর পর্যন্ত শিলাক্ষয় (Weathering) সংগঠিত হয়। ক্রমাগত শিলাক্ষয় ও জৈবপদার্থের বিয়োজন এবং অতিবৃষ্টির ফলে উপরের স্তরের বিশেষ করে ক্যালসিয়াম সম্পূর্ণরূপে অনুসাবিত (Infiltration) হয়ে নিচের স্তরে চলে যায়। লৌহ ও এলুমিনিয়াম ভূ-পৃষ্ঠে বা তার সন্নিকটে জমা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ল্যাটেরাইজিকরণ বলে এবং এর ফলে সৃষ্ট মৃত্তিকাকে পেডালফার (Pedalfer) মৃত্তিকা বলে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মাটির বর্ণ লাল এবং এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম কম পরিমাণে থাকে। দক্ষিণ ভারতের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার অধিকাংশই এ প্রক্রিয়াজাত।

পলিকরণ (Podzolization) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

আমরা জানি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে জৈবিক ও অজৈবিক পদার্থসমূহ এক স্তর হতে অন্য স্তরে অনুসারিত হয়। যে সব অঞ্চলের জলবায়ু আর্দ্র ও শীতল সে অঞ্চলে এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। আর্দ্র-শীতল জলবায়ু সম্পন্ন এলাকায় জৈবপদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্তিকা কণা, লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম যৌগসমূহ A স্তর থেকে অনুসারিত হয়ে প্রায় সম্পূর্ণরূপে B স্তরে জমা হয়। দ্রবণীয় ক্যালসিয়াম যৌগসমূহ সম্পূর্ণরূপে অনুসাবিত হয়ে বের হয়ে যায়। মৃত্তিকা গঠনের এ প্রক্রিয়াকে পলিকরণ (Podzolization) বলে। এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মৃত্তিকাকে পড়জল মৃত্তিকা বলে। ভারতের কাশ্মীরে এ ধরনের মৃত্তিকা পাওয়া যায়।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলাফল:

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ১ , পাঠ ১.৫

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলাফল তিনটি :

১।মৃত্তিকার উৎস বস্তুর উপাদানগুলির আকার কমে যায় এবং এসব উপাদান একত্রিত হয়ে মৃত্তিকার একটি সুনির্দিষ্ট সংযুক্তি (Structure) সৃষ্টি করে।

২। ভূ-পৃষ্ট বা তার নিকটবর্তী জৈবপদার্থসমূহ একত্রে জমা হয়।

৩। মৃত্তিকার একটি সুস্পষ্ট প্রোফাইল বা পার্শ্বচিত্র গঠিত হয়, যাতে A, B ও C স্তর (Horizon) নামে পরিচিত সুচিহ্নিত স্তরগুলি গঠিত হয়। জৈব পদার্থ সম্বলিত ভূ-পৃষ্ঠ সমপূর্ণ শিলাক্ষয় প্রাপ্ত (Completety weathered) মৃত্তিকাকে A স্তর বলে। এর নিচের উর্বর উপাদানগুলো B স্তর নামে পরিচিত। আংশিক শিলাক্ষয় প্রাপ্ত মৃত্তিকার উৎসবস্ত সম্পন্ন স্তরকে C স্তর বলে।

পরবর্তী পাঠে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Soil profile ) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

Capture 10 মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

সূত্র:

  • মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া, পাঠ ১.৫, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

আরও দেখুন:

Leave a Comment