আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শিম চাষ – যা কৃষিজ উৎপাদন: সবজি, ফুল, ফল চাষ এর অন্তর্ভুক্ত ।
Table of Contents
শিম চাষ
শিম আমিষ সমৃদ্ধ একটি সবজি। শিম এবং এর বীজ উভয়ই জনপ্রিয় শীতকালীন সবজি। এটি উচ্চ আঁশযুক্ত, ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ যা মানুষের জন্য খুবই উপকারী। এর মূলে নডিউল জাত আছে তা বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সংবন্ধ করে নাইট্রোজেন মাটিতে যুক্ত করতে পারে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি শিম-১, বারি শিম-২, বারি শিম-৩, বারি শিম-8 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভাবিত ইপসা শিম, এছাড়া কার্তিকা, বারমাসি জনপ্রিয় জাতের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন বীজ কোম্পানি থেকে নিত্য নতুন জাত বাজারজাত করছে।
জলবায়ু ও মাটি
শিম শীতকালীন এবং খরা সহিষ্ণু সবজি। দোআঁশ মাটি শিমের জন্য ভালো তবে সার ও পানি ব্যবস্থাপার মাধ্যমে যেকোন মাটিতে ভালো জন্মে। মাটির pH ৬.৫-৮.৫ হলে ভালো। ফসলের অঙ্গজবৃদ্ধি ও পুষ্পায়ন জন্য তাপমাত্রা ও দিবস দৈর্ঘ্য যথেষ্ট প্রভাব ফেলে ।
এ সবজি গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং দীর্ঘ দিবস প্রয়োজন। কিন্তু প্রজননের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা ও কম দিবস দৈর্ঘ্য প্রয়োজন। শীতকালীন জাতগুলোতে কেবল শীতের প্রভাবেই পুষ্পায়ন ঘটে গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় বছরের যে কোনো সময় বীজ বপন বা চারা রোপন করা হউক না কেন যথাসময়ে পুষ্পায়ন ঘটে থাকে।
সার প্রয়োগ, জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি
বানিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য ৪-৫ বার জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিতে হবে। এছাড়াও কৃষক তার বসত বাড়িতে, পতিত জমি, পুকুর পাড়ে রাস্তার ধারে শিমের চাষ করতে পারে। সাধারণত মাদা বা গর্ত করতে হবে। মাদা থেকে মাদা ৩ মিটার দূরত্ব রাখতে হবে। আগাম বীজ বপনের জন্য জুন মাস উত্তম। তবে স্বাভাবিক ভাবে জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাই পর্যন্ত বীজ বপন করা যায় ।
বীজের হার হেক্টর প্রতি ৭-৭.৫ কেজি যা নির্ভর করে বীজ বপনের সময়ের উপর। প্রতি মালায় ৫-৬ টি বীজ বপন করতে হবে। পরবর্তীতে ২ টি সুস্থ চারা রেখে অন্যগুলো তুলে ফেলতে হবে। প্রায় সব ধরণের মাটিতেই শিম জন্মে । তবে সুনিষ্কাশিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালো ফলনের উপযুক্ত।
বীজ বপনের সময়
মধ্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস।
বীজ হার
জমি, মাদা ও গর্ত তৈরি
৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গে জমি সমান করে ঝুর ঝুরে করে নিতে হয়। তারপর ২.৫-৩ মিটার দূরে দূরে এমনভাবে মাদা তৈরি করতে হবে যাতে মাদা উচ্চতায় ১৫-২০ সেমি, প্রস্থে ২.৫ মিটার, এবং দৈর্ঘ্য জমির সুবিধা মতো শিতে হয়। প্রতি মালার গর্তের আমার হচ্ছে ৪৫ সেমি x ৪৫ সেমি x ৪৫ সেমি।
গর্তে সার প্রয়োগ
প্রতিটি গর্তে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়:
গোবর, সালফার, বোরন ও টিএসপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। শিম জাতীয় ফসলে ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হয় । কারণ শিম লিগুম পরিবারের ফসল অর্থাৎ ডাল জাতীয় ফসল। এদের শিকড়ে গুটি (Nodule) তৈরি হয় যাতে প্রচুর পরিমাণে বায়ু মন্ডলীয় নাইট্রোজেন জমা থাকে।
মাদায় বীজ বপন
গর্তে সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বপন করতে হবে ।
আন্তঃ পরিচর্যা
- আগাছা দমন : জমিতে বা মাদার আগাছা দেখামাত্রই সরিয়ে ফেলতে হবে।
- চারা পাতলা করণ: প্রতি মাদায় ২টি সুস্থ, সবল চারা রেখে বাকিগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
- মাচা তৈরি: গাছ ২৫-৩০ সেমি উঁচু হলেই মাচা বা বাউনি তৈরি করে তাতে গাছগুলো উঠিয়ে দিতে হবে।
- সেচ প্রদান : গাছের গোড়ার মাটির রস যাচাই করে সেচ দিতে হবে। সাধারণত ১০-১২ দিন পরপর গাছে সেচ দিতে হবে।
- গোড়ায় মাটি উঠানো: গাছের গোড়ায় মাটি উঠিয়ে দিতে হবে যাতে বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় পানি না উঠতে পারে।
- প্রুনিং করা: পুরাতন পাতা ও ফুলবিহীন ডগা বা শাখা কেটে ফেলতে হবে ।
- সারের উপরি প্রয়োগ: বীজ বপনের ১ মাস পর অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে। হবে । চারা বড় হতে থাকলে আরও ১৫-২০ দিন পর বাকি ইউরিয়া ও এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে ।
পোকা ও দমন পদ্ধতি
জাব পোকা : শিমের প্রধান ক্ষতিকারক পোকা হলো জাব পোকা (Aphid)। এরা গাছের কচি ডগা, পাতা, ফুল ও ফল ইত্যাদির রস চুষে খায়। ফলে ফলনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সরাসরি ক্ষতি ছাড়াও এ সব পোকা মোজাইক ভাইরাস রোগ ছড়ায়।
ফল ছিদ্রকারী পোকা : শিমের আর একটি ক্ষতিকারক পোকা হলো ফল ছিদ্রকারী পোকা। এ সব পোকার ডিম থেকে বের হয়ে আসা কীড়া ফুল, ফুলের কুঁড়ি, কচি ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
পিস ( Thrips): শিমের আর একটি ক্ষতিকর পোকা হলো থ্রিপস। এ সব পোকার আক্রমণে শিমের উৎপাদন ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে। এ সব পোকা পাতা থেকে রস চুষে খায়।
পোকা দমন পদ্ধতি উল্লেখিত পোকা ৩টির প্রতিকারের জন্য নিম্নের বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে: 4 আক্রান্ত অংশ তুলে ফেলে দিতে হবে। গুড়া সাবান পানিতে মিশ্রিত করে স্প্রে করতে হবে।
আঠা ফাঁদ পেতে অর্থাৎ জমিতে ৩ মিটার দূরে দূরে ৩০ সেমি x ৩০ সে.মি. আকারের বোর্ডে গ্রিজ/আঠা লাগিয়ে আঠা ফাঁদ পেতে থ্রিপস পোকাকে আকৃষ্ট করে মারা যায়। গাছগুলো আক্রান্ত বেশি হলে মেলাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (২ মিলি) ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। নিমের বীজের শাস পিষে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যায়। ভাইরাস আক্রান্ত গাছগুলো মাটিসহ উঠিয়ে গভীর গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে।
রোগ ব্যাধি ও দমন ব্যবস্থা
শিম গাছে এনথ্রাকনোজ বা ফল পঁচা রোগ হয়। এ রোগ দমনে রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে। ছত্রাক নাশক যেমন- ব্যাভিস্টিন/ নোইন/একোনাজল প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
আশ্বিন-কার্তিক মাসে শিম গাছে শিম ধরে। জাত ভেদে বীজ বপনের ১৫-১৪৫ দিন পর শিম গাছ থেকে শিম ওঠানো যায়। বীজ হিসেবে শিম সংগ্রহ করতে হলে শিম যখন গাছে শুকিয়ে হলদে বর্ণ হয়, তখন সংগ্রহ করা হয়। শিম থেকে বীজ বের করে তা নিমের শুকনা পাতার গুড়াসহ সংরক্ষণ করতে হয়।
ফলন
জাত ভেদে শিমের ফলনের তারতম্য হয়ে থাকে। সবজি হিসেবে শিম পুরা মৌসুমে উঠানো যায়। নিম্নে বারি (BARI) শিমের ফলনের তালিকা দেয়া হলো:
সারসংক্ষেপ
শিম আমিষ জাতীয় একটি জনপ্রিয় সবজি। শিম গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য উষ্ণ, আর্দ্র জলবায়ু ও দীর্ঘ দিবস প্রয়োজন । কিন্তু পুষ্পায়নের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা ও কম দিবস দৈর্ঘ্য প্রয়োজন। সবজি হিসেবে শিম পুরো মৌসুমে উঠানো যায় ।