সমন্বিত খামার ব্যবস্থা ও কৃষি পরিবেশ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সমন্বিত খামার ব্যবস্থা ও কৃষি পরিবেশ

সমন্বিত খামার ব্যবস্থা ও কৃষি পরিবেশ

 

 

সমন্বিত খামার ব্যবস্থা

ইতোমধ্যেই আমরা খামার এবং খামার ব্যবস্থা কী জেনেছি। আর এটাও জেনেছি যে, বিশেষভাবে পরিকল্পিত মিশ্র খামারকে সমন্বিত খামার বলে। এবার সমন্বিত খামার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। সমিন্বত খামার ব্যবস্থা হলো খামারের সামগ্রিক পরিবেশ উপযোগী কৌশল/প্রযুক্তি ব্যবস্থা যা খামারের বিভিন্ন অঙ্গের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) পরিকল্পিত সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ/উপাদান/ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে।

ব্যবস্থার ধর্ম অনুসারে খামারের অঙ্গসমূহ আন্তঃসম্পর্কিত হয় এবং আন্তঃক্রিয়া করে থাকে। অনুরূপভাবে খামারের বসতবাড়ি, পুকুর, পশুপাখি, কৃষিবন, পালান ও অন্যান্য জমি ত নিয়ে খামার পরিবেশের সীমা নির্ধারিত হয়। এখানে প্রযুক্তি কথাটির ব্যাখ্যা করা হলো। প্রযুক্তি (Technology) হলো উপায় বা ব্যবস্থাপনা যা একক বা যৌথভাবে ফসল, পশুপাখি, মাৎস্য বা গাছপালার উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পাদন ও নিশ্চিত করতে স ম।

সমন্বিত খামার ব্যবস্থার প্রকারভেদ

ইতোমধ্যেই আমরা খামার ব্যবস্থার পাঁচটি অঙ্গ সম্পর্কে জেনেছি। বসতবাড়ি অঙ্গ যেহেতু সকল খামারেই উপস্থিত, সেহেতু চারটি অঙ্গের বিভিন্ন সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। অঙ্কের মাধ্যমে অসংখ্য সমন্বয় সম্ভব হলেও বাস্তবে এর সমন্বয় অত্যন্ত কঠিন প্রক্রিয়া। কেননা এগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকতে হবে ও আন্তঃক্রিয়া ঘটাতে হবে।

তদুপরি পরিবেশ, সম্পদ ও কৃষকদের চাহিদা এবং বিভিন্ন সুযোগের বিষয়গুলোও এ েত্রে বিবেচনা করতে হয়। বাস্তবে দেখা যায় যে, কৃষক প্রথমে তাঁর সুবিধাজনক একটি অঙ্গ সুশৃঙ্খল ও উৎপাদনশীল করে গড়ে তোলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঙ্গ বা অঙ্গের উদ্যোগ সৃষ্টি করছেন। এই পরের অঙ্গ বা অঙ্গের উদ্যোগ মূলত: প্রথম অঙ্গটির পরিপূরকভাবে সৃজন করা হয়।

কেননা খামারের মোট উৎপাদন বা আয়ের বিরাট অংশ যোগান দেয় সেই প্রথম অঙ্গটি। অর্থাৎ প্রথম অঙ্গটি হচ্ছে খামারের ভিত্তি, যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী অঙ্গ বা উদ্যোগগুলো গড়ে উঠে। প্রথম বা প্রধান অঙ্গের ভিত্তিতে সমন্বিত খামার ব্যবস্থা প্রধানত পাঁচ প্রকার। যথা-

১। ফসল ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা (Crop based integrated farming systems)

২। ডেয়রী বা দুধাল গাভী ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা (Dairy based integrated farming systems)

৩। পোল্ট্রি বা হাঁসমুরগি ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা (Poultry based integrated farming systems)

৪। মাত্স্য ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা (Fisheries based integrated farming systems)

৫। বসতবাড়ি ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা (Homestead based integrated farming systems)

উপরে বর্ণিত বিভিন্ন অঙ্গভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থাগুলোর প্রতিটি আবার বহু প্রকার হতে পারে। যেমন- ফসল ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থাকে ধান ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা, ই ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা, কলা ভিত্তিক সমন্বিত খামার ব্যবস্থা ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করা যায়।

 

 

পরিবেশ

পরিবেশের ধারণা খুবই ব্যাপক। তবে এখানে আমরা তা বাংলাদেশের প্রেেিত আলোচনা করবো। মানুষ এবং চারপাশের জীবিত গাছপালা, প্রাণী ও অণুজীব এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- মাটি, পানি, বায়ু, সূর্যালোক এবং আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং সমস্ত কিছুর আন্তঃসম্পর্কই হলো পরিবেশ। বুঝার সুবিধার জন্য তাই পরিবেশকে বিভিন্ন ভৌগলিক, সামাজিক বা কৃষি সীমানায় বর্ণনা করে আলোচনা করা হয়।

পরিবেশের অঙ্গ

পরিবেশের বেশ কিছু অঙ্গের আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠে। পরিবেশের অঙ্গ প্রধানত: তিনটি। এগুলো হলো-

১। জৈব অঙ্গ (Biotic components)

২। অজৈব অঙ্গ (Abiotic components )

৩। আর্থ-সামাজিক অঙ্গ (Socio-economic components)

জৈব অঙ্গ

মানুষসহ অতি দ্র অণুজীব হতে শুরু করে বৃহৎ হাতি পর্যন্ত প্রাণী, বিভিন্ন জলজ প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, ঘাস, লতা-পাতা, বৃ প্রভৃতি সবই পরিবেশের জৈব অঙ্গ ।

অজৈব অঙ্গ

মাটি, পানি, বাতাস, সূর্যালোক, শক্তি, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা,খনিজ প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ ভিত্তর পরিমাণ ও গুণগত বিস্তৃতি রয়েছে।

আর্থ-সামাজিক অঙ্গ

মানুষের পুঁজি, ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, সুযোগ-সুবিধা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, রাজনীতি, ধর্মীয় অবস্থা প্রভৃতির পরিমাণ, গুণগত ও আধ্যাত্মিক বিস্তৃতি রয়েছে। মানুষের সৃষ্ট ভৌগলিক এলাকায় বিভিন্ন সময়ে উপরোক্ত অঙ্গসমূহের আন্তঃসম্পর্ক সেখানকার পরিবেশ বুঝায়। পরিবেশের বিভিন্ন অঙ্গের বৈচিত্র্য ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ক সৃজন প্রচেষ্টা পরিবেশকে প্রভাবিত করে থাকে। তবে জীব-পরিবেশের স্থায়িত্ব নির্ভর করে পরিবেশের জৈব বৈচিত্রতার (Biodiversity) উপর।

বর্তমান কৃষি পরিবেশ

আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আন্তঃক্রিয়ার দ্বারা কৃষি পরিবেশের বিভিন্ন অঙ্গ আন্তঃসম্পর্কিত। সুনির্দিষ্ট কৃষি কর্মের দ্বারা বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশের উপর প্রভাব আলোচনার পূর্বে বর্ধিত জনসংখ্যার ফলে সৃষ্ট কৃষি পরিবেশের উপর সামগ্রিক প্রভাব আলোচনা করা হলো।

 

দারিদ্র্যের দুর্বিসহ চক্র ( Vicious cycle of poverty)

বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশের বর্তমান অবস্থান নিম্নরূপ-

  • কম জমিতে অধিক জনসংখ্যার চাপ,
  • উজাড়কৃত বনভূমি,
  • য়প্রাপ্ত মাটি,
  • বিলুপ্ত প্রায় জ্বালানী-উৎস,
  • য়িষ্ণু জীব সম্পদ,
  • বন্যা-খরা-লবণাক্ততা এবং
  • বিরূপ পরিবেশে দরিদ্র কৃষক।

এ অবস্থা কীভাবে সৃষ্টি হয় তা নিচে আলোচনা করা হলো :

জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই মাটি, পানি, বনজ ও জলজ সম্পদের মত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার বেড়ে যায়। এতে মাটি, বন-জঙ্গল ও জলজ সম্পদ য়িষ্ণু হতে থাকে। বন উজাড় ও গাছপালা নির্বিচারে কেটে অধিক খাদ্য ও রান্নার জ্বালানী সংস্থান করা হয়। ফলে মাটির জৈব পদার্থের উৎস কমে যায়, মাটি পানি ধরে রাখতে পারে না, মাটির য় শুরু হয়।

মাটির গুণাগুণ/উর্বরতা কমে যায়। চাষাবাদ, পানীয় ও গৃহস্থলী কাজে পানির অভাব দেখা দেয়। পরিবেশ দূষণ শুরু হয়। এর প্রভাবে কৃষি উৎপাদন কমে যায়। মানুষের খাদ্য, আশ্রয় ও রান্নার প্রয়োজনে দরকার হয় অধিক পুঁজি, প্রযুক্তি ও শ্রম ব্যবহারের। কিন্তু দরিদ্র দেশে পুঁজি ও প্রযুক্তি— দুটোরই অভাব থাকে। এ অভাব পুষিয়ে নিতে মানুষকে অধিক শ্রম দিতে হয়।

এতে অধিক মানুষ জন্মে। এরা বড় হয় অপুষ্টি, অশি া ও অদ তায়। প্রযুক্তি শেখার জানার তেমন সুযোগ পায় না। তাই এরা পুনরায় পরিবেশকে তিগ্রস্ত করে। ফলে এরা আরও দরিদ্র হয়। এভাবেই ঘূর্ণায়মানভাবে চলতে থাকে দারিদ্র্যের এই দুর্বিসহ চক্র।

অধিক জনসংখ্যা, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি, অধিক শিশু মৃত্যু ও অধিক সন্তান আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এবং এর ফলে কৃষি পরিবেশের য়িষ্ণু অবস্থার আন্তঃক্রিয়া সমেত দারিদ্র্যের দুর্বিসহ চক্রটি চিত্র ১০ এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হলো। দেশের শতকরা প্রায় ৮৫ জন কৃষক এহেন অভিশপ্ত দারিদ্র্য চক্রে বন্দী।

 

চিত্র : দারিদ্র্যের দুর্বিসহ চক্র ও কৃষি পরিবেশ

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version